সীমান্তে রোহিঙ্গার ঢল: বাংলাদেশের করণীয়
  2017-08-27 18:17:03  cri

১১ মাসের মাথায় আবারো সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষ্যিত রাখাইন রাজ্যে। আর বরাবরের মতোই এবারো হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। অনেকেই এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। অনেককে আটক করে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড। আবারো নতুন করে আলোচনায় এসেছে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি, আর রয়েছে নিরাপত্তার খাতিরে আশ্রয় না দেওয়ার যুক্তিও।

২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা একটি সেনাঘাঁটি ও ৩০টি পুলিশ স্টেশনে হামলা চালায়। পরদিন ২৫ আগস্ট থেকে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এসব হামলা ও পাল্টা অভিযানে ৮৯ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে ১২ জন পুলিশ সদস্য। বাকি ৭৭ জনকে বিদ্রোহী বলে দাবি করা হয়েছে সরকারের তরফে। আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি এক টুইট বার্তায় এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। সামনে আরো হামলা চালানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা। হামলার নিন্দা জানিয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সুচি বলেছেন, সহিংসতার মাধ্যমে রাখাইনে শান্তি ও সংহতি নষ্ট হতে দেওয়া হবে না।

প্রতিবেশি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এ সমস্যা বাংলাদেশের জন্য বড় মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে তারা অবস্থান করছে। এসব রোহিঙ্গার অনেকে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে যা বাংলাদেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। গত বছরের অক্টোবরে সেনা অভিযানে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এবারের সেনা অভিযানেও প্রাণভয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে জড়ো হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। তারা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশে ঢোকার। গত দুতিন দিনে বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। অনেককে আটক করে মানবিক সাহায্য দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। তবে গুলিবিদ্ধ অন্তত ১২ জন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও চিকিৎসা দিচ্ছে বাংলাদেশ। এদের মধ্যে একজন মারাও গেছেন।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনজুরুল হাসান খান জানান, সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন তারা। এবিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারও। ২৬ আগস্ট ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অং মিন্টকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুব জামান। যেহেতু এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা তাই এ বিষয়ে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানানো হয় মিয়ানমার সরকারে প্রতি। ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকেও এ বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

এমন এক পরিস্থিতিতে আবারো সেই পুরনো প্রশ্ন উঠে এসেছে রোহিঙ্গা শরণর্থীদের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে। কেউ বলছেন মানবিক কারণে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া উচিত। আবার নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে কেউ কেউ এর বিরোধিতা করছেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, রোহিঙ্গাদের সীমান্তে আটকে দিয়ে লাভ হচ্ছে না। তারা কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশে ঢুকছেই। কাজেই তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক তৎপরতার বাড়াতে হবে। অন্যদিকে সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।

তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবুদর রশীদ মনে করেন রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো ছাড়া বাংলাদেশের কোনো বিকল্প নেই। মানবিক দিক বিবেচনা করে কোনো ধরনের শিথিলতা দেখালে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি। এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক জোর দিয়ে বলেন, সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে যেন সেখানকার রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশ চলে আসে। এছড়াও রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ রয়েছে তারা দেশিয় জঙ্গিদের সঙ্গে মিলে সহিংসতা উস্কে দিতে পারে। তাই রোহিঙ্গাদের আশ্রয়া না দিয়ে ফেরত পাঠানোই সরকারের দক্ষতার পরিচয় হবে বলে মনে করেন জেনারেল রশীদ।

বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি দুদিক থেকেই সমস্যার। প্রথমত সীমান্তে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা অসহায় মানুষ-যাদের মধ্যে অনেকে আহত- রয়েছে নারী-শিশু-বৃদ্ধ- তাদের প্রতি মানবিক আচরণের দায় রয়েছে। অন্যদিকে এতে করে বাংলাদেশ যে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে তাও মাথায় রাখতে হবে। এদুটি বিষয়ের মধ্যে যথাযথ সমন্বয়-সাধন করেই বিষয়টিকে মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে- এমনটাই অভিমত বিশ্লেষকদের।

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040