চীনের কুয়াং সি জাতীয় যাদুঘরে ভিডিওর মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতির বৈশিষ্টপূর্ণ সংস্কৃতি ও জীবনরীতি রের্কড করা হচ্ছে
  2017-08-02 09:07:56  cri


 

কথায় বলে, কোনো জাতিকে জানতে চাইলে তাদের যাদুঘরে যেতে হবে। যাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন পুরাকীর্তি, ছবি, যন্ত্রপাতি, বই-পুস্তক ইত্যাদির মাধ্যমে জানা যায় একটি জাতির অতীতকে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের কুয়াং সি জাতীয় যাদুঘরে আপনাদের নিয়ে যাবো। এ যাদুঘরের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: এখানে মূলত ভিডিওর মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতির বৈশিষ্টপূর্ণ সংস্কৃতি ও জীবনরীতি রের্কড করা হচ্ছে।

কুয়াং সি জাতীয় যাদুঘর দ্বিতীয় গবেষণালয়ের পরিচালক মাই সি বলেন, "২০০৩ সালে কুয়াংসি জাতীয় যাদুঘর প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই প্রতিষ্ঠিত হয় কুয়াং সি ইকো-জাদুঘর এবং এর মাধ্যমে শুরু হয় সংস্কৃতি রক্ষার কাজ। বর্তমানে 'সংস্কৃতির স্মরণ' শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের অধীনে আমরা তথ্যচিত্রের মাধ্যমে জাতীয় সংস্কৃতিকে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করছি।"

সংখ্যালঘূ জাতিঅধ্যুষিত অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ইকো যাদুঘরের সংরক্ষিত এলাকা। এ সংরক্ষিত এলাকা যেমন সাধারণ গ্রামবাসীদের একটি মিলনস্থল, তেমনি জাতির ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রদর্শনকেন্দ্রও বটে।

যারা যাদুঘরের সংরক্ষিত এলাকায় তথ্যচিত্র তৈরি করেন, তারা পেশাদার নন। তাঁরা স্থানীয় এবং এলাকার সংখ্যালঘু জাতির মানুষ। ২০১০ সাল থেকে কুয়াং সি জাতীয় যাদুঘর প্রতিবছর তথ্যচিত্র তৈরির প্রশিক্ষণ ক্লাসের আয়োজন করে। এ আয়োজনে সামিল হতে আহ্বান জানানো হয় যাদুঘরের কর্মী এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের। তাদের ভিডিওচিত্র তৈরির কলাকৌশল ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখানো হয়।

মাই সি মনে করেন, কর্মী ও স্থানীয় মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতি সংরক্ষণের কাজটি উত্তম উপায়ে করা হচ্ছে। তিনি বলেন, "দু'ধরনের মানুষ সাংস্কৃতি সংরক্ষণে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে: তরুণ-তরুণীরা এবং গ্রামবাসীরা। জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি যুব সমাজকে যত সচেতন করে তোলা যাবে, সংরক্ষণের কাজটি তত সহজ হবে। আর গ্রামবাসীরা তো তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বরাবরই গর্বিত। তাদের কাজে লাগানোও সহজ। তো, এ দুটি ধরনের মানুষকে সংস্কৃতি সংরক্ষণে কাজে লাগাতে চেয়েছি আমরা।"

ছেন মিং কুয়াং

৬০ বছর বয়সী ছেন মিং কুয়াং শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের অন্যতম। তিনি কুয়াং সি প্রদেশের বহুজাতি অধ্যুশিত স্বায়ত্বশাসিত জেলা লংসেংয়ের একজন কৃষক। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে তিনি শখের বসে স্থানীয় রীতিনীতি ও সংস্কৃতিকে ক্যামেরাবন্দি করা শুরু করেন। ২০১৪ সালে তিনি কুয়াং সি জাতীয় যাদুঘরের উদ্যোগে আয়োজিত 'গ্রামীণ তথ্যচিত্র প্রশিক্ষণ ক্লাস'-এ অংশগ্রহণ করেন। ছবি তোলা ও ভিডিওচিত্র তৈরির কৌশল শেখার পর এখন তিনি নিজের ক্যামেরা নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ান এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন অনুষ্ঠান রেকর্ড করেন। তিনি বলেন, "আমি জুয়াং জাতির মানুষ। আমাদের জাতির গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহ্য লোকসঙ্গীত। লোকজন যখন গান গায়, আমি তাদেরকে ভিডিও ক্যামেরায় বন্দি করি। আমার এ কাজ তারা পছন্দ করেন, কারণ এ ছবি একসময় তাদের বংশধররা দেখতে পাবেন। চার-পাঁচ বছর আগে নির্মিত তথ্যচিত্রগুলোতে স্থান-পাওয়া অনেক প্রবীণ মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তাদের স্মৃতি, কথা, চলাফেরা রয়ে গেছে তথ্যচিত্রে। আগামী প্রজন্মের জন্য এগুলো খুবই গুরুত্ববহ।"

২০১৬ সালে কুয়াং সি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে স্থান পায় ছেন মিং কুয়াংয়ের তথ্যচিত্র 'মা হাই গ্রামের হস্তনির্মিত কাগজ'। তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, মিং রাজবংশ আমলে জুয়াং জাতির মানুষ কুয়াং সি লং সেং জেলায় এসে বসতি স্থাপন করে। তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসে হাতে কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। তথ্যচিত্রটি তৈরি করতে ছেন মিং কুয়াংয়ের লেগেছে দীর্ঘ ২ বছর। তিনি দমে যাননি। কাগজ তৈরির ১৫টি ধাপের ৭২টি পদ্ধতির সবকটি তিনি রেকর্ড করেছেন তার তথ্যচিত্রে। ছেন মিং কুয়াং বলেন, "আমি একটু একটু করে শিখেছি। আমার শিক্ষার দৌড় প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত। কিন্তু আমি ছবি তুলতে ও ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে পছন্দ করি। আমি মনে করি, জাতীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখার এ এক উত্তম পদ্ধতি। এ কাজ চট করে শিখে ফেলা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে শিখতে হয়।"

স্থানীয় রীতি অনুযায়ী, বিয়ে, প্রবীণদের জন্মদিন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। ছেন মিং কুয়াং এখন গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রধান আলোকচিত্রী। তিনি নিজের অর্থে একটি ডিভিও ক্যামেরা কিনেছেন। তার প্যাশন ও প্রতিভা সবার স্বীকৃতি পেয়েছে। স্থানীয় ইকো যাদুঘর এবং কুয়াং সি জাতীয় যাদুঘর তার তথ্যচিত্রগুলোর কদর করে। ছেং মিং কুয়াংয়ের সামনে বড় বাধা ছিল তিনটি: বয়স, স্বল্প শিক্ষাগত যোগ্যতা, ও দূরবর্তী গ্রামের বাসিন্দা হওয়া। তবে তিনি সকল অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, "যে-কোনো একটি নতুন জিনিস শেখা অবশ্যই কঠিন। সমস্যায় পড়লে আমি শিক্ষকদের ফোন করি এবং তারা ফোনের মাধ্যমে আমাকে পরামর্শ দেন। কষ্ট হলেও আমি একটি কাজ শেষ পর্যন্ত করতে চাই। ভাল করতে পাড়া বা না-পাড়া পরের ব্যাপার।"

কুয়াং সি জাতীয় যাদুঘর দ্বিতীয় গবেষণালয়ের পরিচালক মাই সি মনে করেন, ছেন মিং কুয়াংয়ের মতো মানুষ যারা নিজের সংস্কৃতিকে ভালবাসেন ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন, তাদের গুরুত্ব অনেক। তিনি বলেন, "গ্রামবাসীরা যেসব ভিডিওচিত্র বানায়, সেগুলোর উপজীব্য সাধারণত তাদের দৈনন্দিন জীবন। তারা পেশাদার নন, তাই তাদের ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিও অন্যরকম। আমরা তাদের ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। তারা তাদের পছন্দ অনুসারে কাজ করে থাকে।"

ছেং মিং কুয়াং বলেন, হস্তনির্মিত কাগজের ওপর নির্মিত ভিডিওচিত্রটি নিয়ে আরও কিছু কাজ করার পর তিনি ভিন্ন বিষয়ের ওপর তথ্যচিত্র বানানোর কাজ করতে ইচ্ছুক।

এক-একটি ভিডিওচিত্র সংখ্যালঘু জাতির এক-একটি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। এর মাধ্যমে আমরাও সংখ্যালঘু জাতির রীতিনীতি সম্পর্কে সহজে জানতে পারি। বই-পুস্তক পড়ে জানার চেয়ে, এভাবে জানা অনেক বেশি কার্যকর ও আনন্দদায়ক। (শিশির/আলিম/সুবর্ণা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040