20170621yinyue.mp3
|
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি আনন্দী বেইজিং থেকে আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজকের সুর ও বাণী আসরে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো চীনের শেনশি প্রদেশের রাজধানী সি আনের সাথে, শোনাবো এ প্রাচীন নগর সম্পর্কিত কয়েকটি গান।
সি আন, প্রাচীনকালে এর নাম ছিল ছাং আন বা হাও চিং। প্রাচীনকালে পর পর পশ্চিম চৌ, ছিন, পশ্চিম হান, পূর্ব হান, পশ্চিম চিন, পর্ব চাও, পূর্বের চাও, পূর্বের ছিন, পরের ছিন, পশ্চিম ওয়েই, উত্তর চৌ, সুই ও থাং সহ মোট ১৩টি রাজবংশের রাজধানী ছিল এখানে। প্রাচীন এ নগর ছিল চীনা সভ্যতা আর চীনা জাতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জন্মস্থান এবং প্রাচীন রেশমপথের প্রাচ্যের উৎপত্তিস্থল। হোয়াংহো নদীর আটটি শাখা নদী এ শহরের চারপাশ বেষ্টন করে আছে। ফলে প্রাচীনকাল থেকে 'আটটি নদী ছাং আন নগর ঘিরে রাখার' বর্ণনা রয়েছে। বন্ধুরা, শুনুন হাও মেংয়ের গাওয়া 'আটটি নদী ছাং আন নগর ঘিরে রাখে' শিরোনামের গান।
সি আন মধ্য চীনে অবস্থিত। এ শহর শেন শি প্রদেশের রাজধানী। চীনের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা, শিক্ষা ও শিল্প কেন্দ্র। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর জাতিসংঘ মহাসচিব, মার্কিন প্রেসিডেন্ট, রুশ প্রেসিডেন্ট, জার্মান চ্যান্সেলর, ব্রিটিশ রাণী, জাপানের সম্রাট ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দু'শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান সিআন সফর করেছেন। ১৯৮১ সালে ইউনেস্কো সিআনকে 'বিশ্বের ঐতিহাসিক খ্যাতি নগর' ঘোষণা করে। মার্কিন গনমাধ্যম সিআনকে বিশ্বের সেরা দশটি প্রাচীন নগরের অন্যতম নির্বাচন করেছে। বন্ধুরা, শুনুন শি ল্য ফাংয়ের গাওয়া 'মহান সি আন' শিরোনামের গান।
অনাদিকালে 'লান টিয়ান মানব' এখানে বসবাস করতো। নবপ্রস্তর যুগে 'বানপো' সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষরা এখানে বাস করতো। তাদের জীবনে কৃষি উত্পাদনের গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা ছিল। তারা গাছ গাছালা আগুনে পুড়িয়ে পরিস্কার করে ফসলের ক্ষেত তৈরি করে জোয়ার চাষ করতো। তখন তারা পাথর, প্রাণীর হাড়, হরিণের শিঙ আর মৃন্ময় পাত্রাদি দিয়ে নানা যন্ত্র উত্পাদন করতো। শিকার আর মাছ ধরা ছিল তখনকার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্ম। ১৯৫৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ভিত্তিতে সিআন পানপো জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি হলো চীনের প্রথম নবপ্রস্তর যুগের ধ্বংসাবশেষ জাদুঘর। এ জাদুঘরের আয়তন প্রায় ৩০০০ বর্গমিটার। এখানে অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে পানপো আদিম সমাজের পল্লীর আসল রূপ সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বন্ধুরা, শুনুন 'সিআনের লোকসংগীত' নামে একটি গান। গেয়েছেন মা চিয়ান ফেন আর সোং মা ছাও
সি আন চীনের সেরা পর্যটন স্থানের অন্যতম। এখানকার ছয়টি পর্যটন স্থান 'বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায়' অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছিন রাজবংশীয় আমলের প্রথম সম্রাট শি হুয়াংয়ের কবরস্থান আর এর ভেতরের সৈন্য ও ঘোড়ার টেরাকোটা বিশ্ববিখ্যাত। ছিন শি হুয়াং কবরস্থানকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সৈন্য ও ঘোড়ার টেরাকোটা জাদুঘরকে 'বিশ্বের অষ্টম বিস্ময়' নামে অভিহিত করা হয়। এটা ছিল আধুনিককালে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের অন্যতম।
ছিন রাজবংশীয় সৈন্য টেরাকোটা
১৯৯০ সালে হংকংয়ের লেখিকা লি বি হুয়ার উপন্যাস 'ছিন রাজবংশের সৈন্য টেরাকোটা' থেকে রূপান্তরিত চলচ্চিত্র 'টেরাকোটার প্রেম' মুক্তি পায়। এ চলচ্চিত্রে যথাক্রমে ছিন রাজবংশ, চীন প্রজাতন্ত্র আর বিংশ শতাব্দীর ৭০'র দশকের তিনটি সময়ে জেনারেল মাং টিয়ান ফাং আর কিশোরী হান তোং আর এর তিন প্রজন্মের প্রেমের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। ১৯৯১ সালে প্যারিস চলচ্চিত্র উত্সবে 'টেরাকোটার প্রেম' সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ছিন রাজবংশের সৈন্য ও ঘোড়ার টেরাকাটা সারা বিশ্বের দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। বন্ধুরা, শুনুন এ চলচ্চিত্রের থিম সং 'মন আগুনে পুড়িয়ে দেয়'। গেয়েছেন ইয়ে ছিয়ান ওয়েন।
২০১৩ সালের শীতকালে আমি তিন দিনের জন্য সিআনে গিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম একটি শহরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ জানার জন্য তিন দিন মোটামুটি যথেষ্ট। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর আমি উপলব্ধি করি যে, এ নগরে দেখার মতো অনেক জায়গা আছে। যে কোন একটি জাদুঘরে গেলে বা কোন একটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত পর্যটনস্থানে গেলে কমপক্ষে এক বেলা দরকার। তিন দিন সময় কোনভাবে যথেষ্ট নয়।
দা ইয়ান প্যাগোডা
সি আনে গেলে ছিন রাজবংশের সৈন্য ও ঘোড়ার টেরাকোটা জাদুঘর দেখার পাশাপাশি দা ইয়ান প্যাগোডায়ও যেতে ভুলে যাবেন না। দা ইয়ান প্যাগোডা দা সি আন মন্দিরে অবস্থিত। ৬৫২ সালে থাং রাজবংশের বিশিষ্ট সন্ন্যাসী হিউয়েন সাং ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মের মর্মবাণী নিয়ে আসার পর তা সংরক্ষণের জন্য ছাং আনে দা ইয়ান প্যাগোডা নির্মাণ করেন। এ প্যাগোডা মোট সাত তলা, তার উচ্চতা ৬৪.৫১৭ মিটার। এটা হলো বর্তমানে সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত থাং রাজবংশের চার কোণা ইটের তৈরি প্যাগোডা। দা সি আন মন্দিরে সন্ন্যাসী হিউয়েন সাংয়ের মূর্তিও রয়েছে। স্থানটি চীন ও ভারতের ঐতিহাসিক ধর্মীয় বিনিময়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
২০১৬ সালে 'থাং রাজবংশের হিউয়েন সাং' নামে চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এ চলচ্চিত্রে ১৩০০ বছর আগে সন্ন্যাসী হিউয়েন সাং এর বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র সূত্র জানার উদ্দেশ্যে কষ্ট করে মরুভূমি ও তুষারাবৃত পাহাড় অতিক্রম করে, পথে নানা বিপদ মোকাবেলা করে মহান ভারতে আগমন এবং বৌদ্ধ ধর্মের মর্ম শেখার কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। সব শেষে তাঁর ছয় শতাধিক ধর্মগ্রন্থ চীনে নিয়ে আসার গল্প বর্ণিত হয়েছে। তখন চীনের রাজধানী ছিল সি আন। হিউয়েন সাং সি আনে এসে দা সি আন মন্দিরের প্রধান সন্ন্যাসী মনোনীত হন। তার পরিচালনায় দা ইয়ান প্যাগোডা নির্মিত হয়েছে। তিনি ১৯ বছর ধরে মোট ৭৫টি ধর্মীয় গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনুবাদ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালান। বন্ধুরা, শুনুন এ চলচ্চিত্রের থিম সং 'হাজার বছরের প্রতিশ্রুতি। গেয়েছেন হান লেই।
হিউয়েন সাং
সি আন রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। নতুন ইউরেশীয় মহাদেশীয় সেতুবন্ধন আর হোয়াং হো নদী অববাহিকার বৃহত্তম শহর। এ শহরে চীনের ৫২টি সংখ্যালঘু জাতির লোক একসাথে সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থানে বসবাস করেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সি আনের স্থায়ী জনসংখ্যা ছিল ৮৭ লাখ ৫ হাজার ৬০০। এখন চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সড়ক, রেলপথ বা বিমানে চড়ে সিআনে যাওয়া যায়। সি আনের সিয়ান ইয়াং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিমান বন্দর। প্রতিদিন ৪০০টির ও বেশী ফ্লাইট এ বিমানবন্দরে উঠানামা করে। বন্ধুরা, শুনুন 'সি আন এক যুব নগর' শিরোনামের গান। গেয়েছেন চাং ছাও ইয়াং আর হুয়াং লু শাং।
প্রিয় বন্ধুরা, এতোক্ষণ আপনারা চীনের প্রাচীন নগর সি আন সম্পর্কে কিছু তথ্য জানলেন। শুনলেন এ শহর সম্পর্কিত কয়েকটি গান। আশা করি, সুযোগ পেলে আপনারা সি আনে ভ্রমণে আসবেন। 'সুর ও বাণী' আসর আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। এতোক্ষণ সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন সবাই। আবার কথা হবে।
(ইয়ু/মহসীন)