সুর ও বাণী: কবি সুই চি মো
  2017-06-15 22:19:30  cri


বন্ধুরা, এখন আপনারা 'আকস্মিক' শীর্ষক গান শুনছেন। সুই চি মো ১৯২৬ সালের মে মাসে এ গানের কথাগুলো কবিতা আকারে লিখেছিলেন। কবির জীবনে অনেক আকস্মিক ঘটনা ঘটেছে। তার জীবনকে এমন অনেক ঘটনার সমষ্টি বলা যেতে পারে। তিনি বিয়ে করেছেন; প্রেমে পড়েছেন; ব্রিটেনের ক্যামব্রিজে পড়েছেন; এমনকি তিনি বিমান দুর্ঘটনার শিকারও হয়েছেন। তিনি লিখেছেন: "আমি হচ্ছি আকাশের এক খণ্ড মেঘ; আকস্মিকভাবে তোমার মনে ছায়া দিয়েছি। তুমি বিস্মিত হয়ো না। আনন্দিত হবারও দরকারও নেই। এক পলকে নিখোঁজ হই, তুমি আর আমি অন্ধকার সাগরে মিলিত হই। তোমার নিজের দিক আছে, আমার নিজের দিক আছে। তোমার মনে থাকলে ভালো, ভুলে গেলে সবচেয়ে ভালো। মিলিত হবার সময় পরস্পরের কাছে আমরা উজ্জ্বল হই।"

সুই চি মো ১৮৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি চেচিয়াং প্রদেশের হাইনিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চীনের আধুনিককালের কবি ও প্রবন্ধকার। তিনি শাংহাইয়ের হুচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়, থিনচিংয়ের বেই ইয়াং; বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে লেখাপড়া করেছেন। ১৯১৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তখন মাত্র দশ মাসে তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং প্রথম শ্রেণীর সম্মান লাভ করেন। একই সালে তিনি নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে তিনি ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন। ক্যামব্রিজের দু'বছরে পশ্চিমা শিক্ষা এবং ইউরোপ ও আমেরিকার রোমান্টিক কবিতা তার ওপর গভীর ছাপ ফেলে। তার রোমান্টিক কবিতার স্টাইল অর্জিত হয় এখান থেকেই। চীনে ফিরে আসার পর তিনি বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়াং হুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, দা সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ও নান চিং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন।

'বিদায়, ক্যামব্রিজ' সুই চি মো'র প্রতিনিধিত্বকারী কবিতা। ২০০৮ সালের ২ জুলাই ক‍্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজের বাগানে এক সাদা মার্বেল পাথরে তার এ কবিতা খোদাই করা হয়। কবিতায় বলা হয়েছে: 'ধীরে ধীরে আমি চলে যাই, যেন আমি হালকা করে চলে এসেছি। আমি হাত তুলে পশ্চিম আকাশের মেঘের কাছ থেকে বিদায় নিই। নদীর তীরে সোনালী উইলো গাছ যেন সূর্যাস্তের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা বিয়ের কনে। ক্যামব্রিজ নদীর নরম তরঙ্গে আমি এক সামান্য শৈবাল হতে চাই।' বন্ধুরা, শুনুন এ কবিতার কথাগুলো দিয়ে সৃষ্ট গান; গেয়েছেন ছাই ছিন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুই চি মো আর রিন হুই ইন

সুই চি মো'র প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা না বললেই নয়। ১৯২৩ সালের বসন্তকালে সুই চি মো বেইজিংয়ে একটি সাংস্কৃতিক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা সংগ্রহের নামানুসারে তিনি এই ক্লাবের নাম দেন 'নতুন চাঁদ ক্লাব'।

১৯২৪ সালের ১২ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চীনের শাংহাই ভ্রমণে আসেন। সুই চি মো শাংহাই বন্দরে গিয়ে তাকে অর্ভ্যথনা জানান। পুরো সফরকালে দোভাষী হিসেবে কবির সঙ্গে ছিলেন তিনি। তাদের মধ্যে বয়সের বড় ব্যবধান হলেও গভীর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল। তারা পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। বেইজিং আসার আগে সুই চি মো কবিকে নিয়ে হাংচৌ বেড়াতে যান। হাংচৌর পশ্চিম হ্রদে নৌকা চালিয়ে সারারাত জেগে তারা গল্প করেছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন। তিনি কবিকে জানান, লিন হুই ইন নামের এক মেয়েকে ভালোবাসেন। এরপরে কবি বেইজিংয়ে আসেন। লিন হুই ইনও তার দোভাষী ছিলেন। তিনি দেখলেন, লিন হুই ইন পীচ ফুলের মতো সুন্দর এবং খুব বুদ্ধিমান। ফলে কবি লিন হুই ইনের সঙ্গে সুই চি মোর মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেন। পরিতাপের বিষয়, মেয়েটি রাজি হয়নি। তখন তাদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দু'টি চরণ রচনা করেছিলেন: 'আকাশের নীল বনের শ্যামলে চায়/ মাঝখানে তার হাওয়া করে হায়-হায়।'

বন্ধুরা, শুনুন সুই চি মোর 'আমি জানি না, বাতাস কোন দিকে বয়ে যাচ্ছে' কবিতার কথাগুলো নিয়ে গীত গান; গেয়েছেন হুয়াং লেই।

লিন হুই ইন

আসলে ১৯২১ সালের শরত্কালে সুই চি মো'র সঙ্গে লিন হুই ইনের পরিচয় হয়। দু'জনের সুসম্পর্ক ছিল; একে অপরকে বিয়ে করার ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দেশের বাড়িতে সুই চি মোর স্ত্রী আছেন। তার স্ত্রীর নাম চাং ইয়ো ই। সুই চি মো স্ত্রীকে ভালোবাসতেন না। তিনি প্রেম করে বিয়ে করেননি। তো, তিনি চাইলেন স্ত্রীকে ছেড়ে লিনকে বিয়ে করতে। তিনি লিন হুই ইনকে তার ইচ্ছার কথা জানালেন। তিনি লিন হুই ইনকে নিয়ে অনেক প্রেমের কবিতাও লিখেছেন। কিন্তু লিন হুই ইন ছিলেন রক্ষণশীল। তিনি চাননি, তার জন্য অন্য এক নারীর সংসার ভেঙে যাক। তিনি নিজেকে সংযত করেন এবং সুই চি মোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

সুই চি মোর কবিতা 'দুর্লভ'-ও গান হয়েছে। এখন এ গানটি শুনুন; গেয়েছেন আন লেই নিং।

লিন হুই ইনকে অনেক কষ্টে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তিনি বাবার সঙ্গে ব্রিটেন ত্যাগ করে চীনে ফিরে যান। যাওয়ার সময় তিনি সুই চি মোর কাছ থেকে বিদায়ও নেননি। দেশে ফেরার পর লিয়ান সি চেন নামের একটি ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে তিনি ছেলেটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করেন। একসময় তাদের বিয়ে হয়। বহু বছর পর তিনি নিজের সন্তানকে বলেছিলেন, "সুই চি মো আসলে আমাকে ভালোবাসেননি। তিনি কবির রোমান্টিক কল্পনা দিয়ে তৈরি এক লিন হুই ইনকে ভালোবেসেছেন। সেই কল্পনার মানুষটি আমি নই।"

বন্ধুরা, এবার শুনুন সুই চি মোর কবিতা 'সাইয়াংনালা' অবলম্বনে রচিত গান। এ কবিতায় জাপানি নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করা হয়েছে।

সুই চি মোর স্ত্রী লু সিয়াও মানের আঁকা ছবি

সু্‌ই চি মো সত্যি সত্যিই রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বেইজিংয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটক 'চিত্রা' মঞ্চস্থ করেন। এ নাটকে তিনি প্রেমের দেবতার চরিত্রে অভিনয় করেন। আর লিন হুই ইন অভিনয় করেন রাজকুমারীর চরিত্রে। মঞ্চে তাদের প্রেম হয়। হয়তো তিনি নাটকের মাধ্যমে মনের কষ্ট প্রকাশ করতে চেয়েছেন। হয়তো তিনি মনে করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এ নাটক তার জন্যই রচিত হয়েছে। হয়তো তার চোখে লিন হুই ইন ছিলেন তার রাজকুমারী।

একসময় তিনি প্রথম স্ত্রী চাং ইয়ো ইর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান। লিন হুই ইনের সঙ্গে অবশ্য তার বিয়ে হয়নি। তার শেষ স্ত্রীর নাম লু সিয়াও মান। তবে তাদের অত্যন্ত সুখী বিবাহিত জীবন টিকে ছিল মাত্র চার বছর। ১৯৩১ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি নানচিং থেকে বিমানযোগে বেইজিংয়ে আসার পথে দুর্ঘটনায় মারা যান।

টিভি নাটক 'জীবনের এপ্রিল'

২০০০ সালে চীনের তাইওয়ানের চোং হেং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র লিমিটেড কোম্পানি সুই চি মোর জীবনভিত্তিক একটি সিরিজ টিভি নাটক প্রচার করতে শুরু করে। নাটকের নাম 'জীবনের এপ্রিল'। চীনের মূল ভূভাগ এবং তাইওয়ানের শিল্পীদের অনেকে এ নাটকে অভিনয় করেন এবং ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। নাটকে মূলত সুই চি মোর সঙ্গে লিন হুই ইন, লু সিয়াও মান, ও চাং ইয়ো ই এ তিন নারীর প্রেমের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের এমি পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার টিভি নাটক ক্যাটাগরিতে এটি মনোনয়ন পেয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলা বিভাগের সাবেক বিশেষজ্ঞ মহিউদ্দিন তাহের এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রে অভিনয় করেন।

বন্ধুরা, শুনুন এ টিভি নাটকের থিম সং 'আমি তোমাকে ঈর্ষা করি'।

বন্ধুরা, এতোক্ষণ আপনারা চীনের বিখ্যাত কবি সুই চি মোর জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য শুনলেন, শুনলেন তার কবিতার কথা দিয়ে রচিত কয়েকটি গান। আজকের 'সুর ও বাণী' এখানে শেষ করছি। অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন সবাই। আবার কথা হবে। (ইয়ু/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040