সিনচিয়াংয়ে চীনের বৃহত্তম রেশমপথ বৈজ্ঞানিক তদন্ত অনুষ্ঠান শুরু
  2017-06-13 15:20:43  cri
সুপ্রিয় বন্ধুরা, আপনারা শুনছেন চীন আন্তর্জাতিক বেতার থেকে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠান 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি'। আর এ অনুষ্ঠানে আপনাদের সঙ্গে আছি আমি আপনাদের বন্ধু ওয়াং ছুই ইয়াং জিনিয়া।

প্রথমে কয়েকটি সাংস্কৃতিক খবর শুনবো।

১. সম্প্রতি বেইজিংয়ের থিয়েন ছিয়াও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ফরাসি বিখ্যাত কমেডি লেখক মলিয়েরের সাহিত্যকর্ম 'দ্য মিজার'-এর চীনাভাষার পাণ্ডুলিপি আবৃত্তি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এতে ৩২ জন আবৃত্তিকার অংশ নেন এবং চমত্কার আবৃত্তি করেন।

এবারের এ অনুষ্ঠানে চীনের বিখ্যাত মঞ্চ নাটক পরিচালক, অভিনেতা, ডাবিং পরিচালক ও আবৃত্তি শিক্ষক ছেন জে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি ফরাসি সাহিত্য জগতে মলিয়েরের অবস্থান ও তার সাহিত্যকর্মের সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। এর পর পাণ্ডুলিপি আবৃত্তি অনুষ্ঠানে তিনি আবৃত্তির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য জোর দিয়ে ব্যাখ্যা করেন এবং আবৃত্তি করেন। তার পেশাগত আবৃত্তি দর্শকদের তুমুল করতালি লাভ করে।

এবার যারা এ আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করেন তাদের অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের মধ্যে শাংহাই থিয়েটার একাডেমির নিউ লিয়াং 'দ্য মিজার'-এর হার্পাগনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তার এ চমত্কার আবৃত্তিও দর্শকদের তুমুল করতালি লাভ করে।

ঘণ্টাব্যাপী এ অনুষ্ঠানটি উপস্থিত সবাইকে ভীষণ মুগ্ধ করে। শিক্ষক ছেন প্রতিটি দলের অভিনয় নিয়ে আন্তরিক মন্তব্য প্রকাশ করেন।

দ্বাদশ 'চীন-ফ্রান্স সাংস্কৃতিক বসন্ত' অনুষ্ঠানের প্রধান নাটক হিসেবে কমেডি লেখক মলিয়েরের সাহিত্যকর্ম 'দ্য মিজার' ৩০ জুন বেইজিংয়ে থিয়েন ছিয়াও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিবেশিত হবে।

২. 'চীনের তিব্বত সংস্কৃতি—কাঠমান্ডু ফোরাম' ৬ জুন নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে উদ্বোধন হয়। চীনের তিব্বতলজি গবেষণা কেন্দ্র, নেপালে চীনা দূতাবাস, চীনের তিব্বত সংস্কৃতি রক্ষা ও উন্নয়ন কমিটি, নেপালের আনিকা অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে এ ফোরাম আয়োজিত হয়। এর লক্ষ্য হলো নেপালিদের চীনের তিব্বতের সত্যিকারের অবস্থা জানানো এবং দু'দেশের জনগণের পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতা গভীর করা।

নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী মাহারা বলেন, 'চীনের তিব্বতের আধুনিকীকরণ নেপালের জন্য গভীর তাত্পর্যপূর্ণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নেপাল ও চীনের পণ্ডিতরা এ ফোরামে মিলিত হন, তারা অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন, যা দু'দেশের সম্পর্ককে আরো গভীর করবে।'

নেপালে চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়ু হং ফোরামে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চীন-নেপাল বিনিময়ের ওপর তিব্বত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। নেপালের উত্তরাঞ্চলের উপকরণের ঘাটতি মোকাবিলায় প্রতিবছর তিব্বত সামগ্রী সহায়তা দেয়। প্রতিবছর নেপালও তিব্বতের সড়কের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলে সামগ্রী পরিবহন করে।

ইয়ু হং আরো বলেন, চীনা পণ্ডিতরা বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে ফোরামে তিব্বতের তথ্য পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। নেপালি পণ্ডিতরাও বিভিন্ন দিক নিয়ে চীন-নেপাল সংস্কৃতির ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি আশা করেন, এবারের ফোরামের গভীর আলোচনার মাধ্যমে প্রচুর ফলাফল অর্জিত হবে, দু'দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার সামাজিক ভিত্তি আরো দৃঢ় হবে।

৬ থেকে ৭ জুন পর্যন্ত চীন ও নেপালের পণ্ডিতরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এতে রয়েছে তিব্বতি চিকিত্সা, বৌদ্ধ সংস্কৃতি, দু'দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিময়, তিব্বতের দারিদ্র্য বিমোচনের পথ, শিক্ষা ও চিত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র।

৩. এবার শুনুন 'সিনচিয়াংয়ে চীনের বৃহত্তম রেশমপথ বৈজ্ঞানিক তদন্ত অনুষ্ঠান শুরু' শিরোনামে একটি সাংস্কৃতিক প্রবন্ধ।

'রেশমপথ থিয়েন সান তাও ২০১৭' সার্বিক বৈজ্ঞানিক তদন্ত অনুষ্ঠান ৩ জুন সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়। ২০ দিনের সার্বিক বৈজ্ঞানিক তদন্তবিষয়ক ট্যুর এদিন থেকে শুরু হয়।

চীনা সামাজিক বিজ্ঞান একাডেমি, বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়, রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং চীনের জাতীয় যাদুঘরসহ বিভিন্ন সংস্থার ২০'জনেরও বেশি বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিত এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। চীনা সামাজিক বিজ্ঞান একাডেমির সিনচিয়াং প্রত্নতাত্ত্বিক দলের পরিচালক, এবারের বৈজ্ঞানিক তদন্তবিষয়ক দলটির নেতা ড. উ সিন হুয়া জানান, রেশমপথের অর্থনৈতিক অঞ্চলের পূর্বাঞ্চলে চীনকে কেন্দ্র হিসেবে একটি শক্তিশালী এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল আছে, মধ্যাঞ্চলে সম্পদে সমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া আছে; পশ্চিম দিকে দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সত্তা আছে। রেশমপথ 'বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা, সবচেয়ে সুপ্তশক্তিসম্পন্ন এক অর্থনৈতিক করিডোর'। ইতিহাসে থিয়েন সান রেশমপথের প্রাচীন পথও চীন-পশ্চিমা সংস্কৃতির বিনিময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। উ সিন হুয়া বলেন,

"চীনের পশ্চিমাঞ্চল প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চীনের এই অঞ্চল সারা পূর্ব এশীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র; বিশেষ করে সামুদ্রিক পথ উন্নয়নের আগে। সেজন্য আগে চীনা সংস্কৃতির বিনিময় ও উন্নয়ন প্রচারে সিনচিয়াং ছিলো একমাত্র পথ। আর সিনচিয়াংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হলো থিয়েন সান। থিয়েন সানের আবহাওয়া এ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। সেজন্য থিয়েন সান রেশমপথের প্রাচীন পথ নিয়ে এবার আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"

থিয়েন সান রেশমপথের প্রাচীন পথের স্বতন্ত্রতা ও গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ২০১৬ সালে বৈজ্ঞানিক তদন্তের প্রত্নতাত্ত্বিক ধারণা আরো উন্নয়ন করতে চায়। আগের ফলাফলের ভিত্তিতে সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি বিনিময় ও সংলাপ আরো জোরদার করতে চায়।

এবার বৈজ্ঞানিক তদন্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সিনিয়র মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সুও কুই চুন বলেন, রেশমপথ ও প্রত্নতত্ত্বের বিষয়ে অনেক মানুষ, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কিছু কম আগ্রহ দেখা যায়। সেজন্য এবার এ অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হলো এ ধরনের সকল বাধা দূর করা। তিনি বলেন, "আমরা আশা করি ঐতিহ্যিক মিডিয়া ও নতুন মিডিয়ার মাধ্যমে, ভিডিও, ছবি, নানা ধরনের পদ্ধতিতে এবার প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। এতে নাগরিক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিনিময় বাড়বে। যাতে আরো বেশি মানুষ এবারের অনুষ্ঠানের অবস্থা সরাসরি জানতে পারে। সিনচিয়াংয়ের সংস্কৃতিও আরো জানতে পারে। এতে করে রেশমপথের তাত্পর্য আরো বাড়বে।"

বন্ধুরা, এখন শুনুন আমার সহকর্মী টুটুলের উপস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক পর্ব।

পুরাতাত্ত্বিক, প্রাচীন পুঁথি সংগ্রাহক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (১৯১৮ - ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য শৌখিন পুরাতাত্ত্বিক, গবেষক, প্রাচীন পুঁথি সংগ্রাহক এবং প্রত্নবস্তু সংগঠক।

জন্ম ও শৈশব

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দরিকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া।

শিক্ষাজীবন

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন, বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে আইএ পাশ করেন মেধাতালিকায় দশম হয়ে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজিতে অনার্স এবং ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে এমএ সমাপ্ত করেন। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ডিপ্লোমা করে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে আসেন ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে।

ব্যক্তিজীবন

জনাব যাকারিয়ার মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও আরও দখল ছিলো ফার্সি, ফরাসি, উর্দু, ইংরেজি, আরবি ভাষায়। জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও পেয়েছিলেন, কিন্তু তা ছেড়ে চলে আসেন দেশের টানে।

কর্মজীবন

শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়টায় তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক ছিলেন। এরপর যোগ দেন সিভিল সার্ভিসে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন।

সেই ছাত্রজীবন থেকেই তার কীর্তিময় জীবনের সূত্রপাত। তখন ছিলেন ভালো ফুটবলার। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের সম্পাদক (সেক্রেটারি) ছিলেন।সিভিল সার্ভিসের ক্যাডার হিসেবে, ময়মনসিংহের এডিসি থাকাকালীন ময়মনসিংহ শহরের উপকণ্ঠে দেশের প্রথম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলা একাডেমি আর শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায়ও ছিলো তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দকালীন তিনি সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির, এছাড়া সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদেরও। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রথম সারির একজন তিনি, এমনকি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার জন্য বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক গঠিত প্রথম কমিটিতেও ছিলেন তিনি। নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমে যুগ্ম সচিব ও পরে পূর্ণ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দকালীন ছিলেন বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটিরও সভাপতি ও সদস্য ছিলেন। ছেলেবেলার ফুটবল স্পৃহা আবারও পূর্ণতা পায়, যখন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দকালীন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দকালীন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনে। এছাড়াও তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার কমিটির সদস্য ও পরে সহসভাপতি ছিলেন।

কীর্তি

তিনি তার এই বহুল কর্মময় জীবন পার করে এলেও বাংলার ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তার শৌখিন কার্যকলাপের কারণে। এমনকি তার এসব শৌখিন কার্যকলাপ ঐ পেশার পেশাদারী ব্যক্তিত্বের চেয়েও সমৃদ্ধ। তার এসব শৌখিন কার্যকলাপের কারণেই আজ বাংলাদেশের পুরাতত্ত্বের ইতিহাসে সীতাকোট বিহার নামটি যুক্ত হয়েছে। তারই প্রচেষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম জাদুঘর দিনাজপুর মিউজিয়াম। তারই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত হয়েছে প্রাচীন দুর্লভ অনেক পুঁথি। এছাড়াও রেখে গেছেন নিজের এক বিপুল সংগ্রহশালা, যেখানে স্থান পেয়েছে অনেক দুর্লভ পুস্তকসহ ছোটোখাটো প্রত্নসামগ্রী।

সীতাকোট বিহার আবিষ্কার

জনাব যাকারিয়া ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশে ফেরত এসে যোগ দেন দিনাজপুরে যুগ্ম সহকারী কমিশনার (রেভেনিউ) পদে। এ কাজেই তিনি একদিন নবাবগঞ্জ যান। সেখানকার প্রত্যন্ত গ্রাম ফতেপুর মারাজে গিয়ে তিনি অদ্ভুত এক জায়গার দেখা পান। এই জায়গাটিকে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের তদানিন্তন জেলা প্রশাসক এফ ডব্লিউ স্ট্রং স্থানীয় লোকশ্রুতির উপর ভিত্তি করে জেলা গেজেটিয়ারে রামায়ণে উল্লেখিত সীতার দ্বিতীয় বনবাসস্থল হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ১৮৭৪ সালের দিনাজপুরের প্রশাসক ও পুরাতাত্ত্বিক ওয়েস্টম্যক্ট এই জায়গাটিকে মনে করেছিলেন বাঁধানো পুকুর। কিন্তু তিনি এদের কারো কথাই মানতে পারলেন না। নিজের মতের উপর অটল থেকে বললেন এটা একটা বৌদ্ধবিহার। তার কথায় কেউ কান না দিলেও এর প্রায় নয় বছর পর ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুরে বদলি হয়ে গেলেন নিজে।সিদ্ধান্ত নিলেন জায়গাটা খুঁড়ে দেখতে হবে। এরূপ পুরাতাত্ত্বিক খননের জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার হয় তা সংগ্রহের জন্য জেলা বোর্ডকে দশ হাজার টাকা দেবার জন্য রাজি করালেন আর কারিগরি সহায়তার জন্য রাজি করালেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে। প্রয়োজনীয় কর্মীবাহিনীসহ নিকটস্থ ডাকবাংলোতে ক্যাম্প স্থাপন হলো আর শুরু হলো খননকাজ। খননকাজে বিহারের প্রবেশপথ আর ছাত্রাবাসসহ পুরো কাঠামোটার যে রূপ বেরিয়ে এলো, ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে করা তার আনুমানিক নকশার সাথে তা হুবহু মিলে গেলো। শুধু তাই নয়, অনেকে বিহারটিকে সপ্তম শতকের বলতে চাইলে তিনি তা নাকোচ করে দেন। তার বিশ্বাস ছিলো মাৎসান্যায়ের যুগে এত বড় বিহার কিছুতেই তৈরি হতে পারে না, তাছাড়া পরবর্তীকালের বিহারগুলোর মতো এখানে কোনো কেন্দ্রীয় মন্দির নেই; তিনি ব্যক্তিগত অভিমত দিলেন যে, এটি পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকের বিহার। তার কথাই সত্যি বলে প্রমাণিত হলো।

প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ

সীতাকোট বিহারে খনন চলাকালীন তিনি ঘুরতে থাকেন প্রাচীন প্রত্নসম্পদের খোঁজে। ঘোড়াঘাট ডাকবাংলোর চৌকিদার নইমউদ্দিন সরকারের সাথে পরিচয় হওয়ার পর বুঝতে পারেন এই ব্যক্তি স্থানীয় প্রাচীন ইতিহাসের একজন বোদ্ধা আর ইতিহাসকেন্দ্রীক অনেক প্রাচীন পুঁথিও তার মুখস্থ। তারই সূত্র ধরে তিনি যান গোবিন্দগঞ্জ থানার চকনেওয়া গ্রামের তৈয়ব আলী সরকারের বাড়িতে। তৈয়ব আলী সরকারের বাবা খয়রুজ্জামান সরকার ছিলেন অনেক প্রাচীন পুঁথির লিপিকার। এখান থেকে তিনি সংগ্রহ করেন অনেক মূল্যবান পাঁচটি প্রাচীন পুঁথি:

১. গুপিচন্দ্রের সন্যাস, কবি শুকুর মাহমুদ

২. গাজী কালু চম্পাবতী, শেখ খোদা বখশ

৩. বিষহরার পুঁথি, জগজ্জীবন ঘোষাল

৪. বিশ্বকেতু, দ্বিজকাশুপতি

৫.সত্যপীরের পুঁথি, কৃষ্ণ হরিদাস

এছাড়াও দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থান, রংপুর, বগুড়া ও চট্টগ্রামের নানা স্থান থেকে সংগ্রহ করেছেন বহু বিখ্যাত বাংলা, সংস্কৃত পুঁথি। যার মধ্যে রয়েছে: 'হালুমীরের পুঁথি, মালাধর বসুর পুঁথি।

দিনাজপুর মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা

সীতাকোট বিহার আবিষ্কারের পর প্রাচীন প্রত্নসম্পদ খোঁজার কাজে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন জনাব যাকারিয়া। এজন্য তিনি পুরো উত্তরবঙ্গ চষে বেড়িয়েছেন। ঘুরলেন বৃহত্তম দিনাজপুরের আনাচে-কানাচে, রংপুর-বগুড়ার গ্রাম থেকে গ্রামে। খবর পেলেন নবাবগঞ্জে খ্রিষ্টান মিশনারিদের কুষ্ঠ হাসপাতালে প্রত্যন্ত গ্রামে কুড়িয়ে পাওয়া প্রাচীন একটি মূর্তি রয়েছে। তিনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তা নিজ হস্তগত করেন। এভাবেই ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠায় কয়েক শ অমূল্য আর দুষ্প্রাপ্য প্রত্নসামগ্রী যোগাড় করলেন তিনি। মূর্তি পাচারকারী দল নানা প্রলোভন দেখিয়ে তা হাতিয়ে নেয়ারও চেষ্টা করলো। অনেকেই নানা কৌশলে হস্তগত করতে চাইলেন এই অমূল্য সম্পদ। কিন্তু তিনি মাথা নত না করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

এইসব সংগ্রহকে পুঁজি করে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় কয়েকজনের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন দিনাজপুর মিউজিয়াম। নিজের সংগৃহীত দুষ্প্রাপ্য মূর্তি, মুদ্রা, শিলালিপিসহ সব প্রত্নসামগ্রী দান করে দিলেন জাদুঘরে। তার প্রচারণায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে বহুজন নিজেদের সংগ্রহে থাকা প্রত্নবস্তু দান করে জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ করলেন। এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, সংগ্রহ করা সকল প্রত্নসামগ্রীর বিস্তারিত পরিচিতিসহ একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন, যা পরে বই আকারে বের হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের হিসাবে জাদুঘরটিতে প্রায় ৮০০ প্রত্নবস্তু ছিলো। এখন এটি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাচীন নিদর্শনের সংগ্রহশালা।

যাকারিয়া সংগ্রহশালা

ঢাকার কলাবাগান লেক সার্কাসে অবস্থিত তার নিজ বাড়ির দোতলায় তার একান্ত নিজস্ব একটি সংগ্রহশালা রয়েছে, যার নাম যাকারিয়া সংগ্রহশালা। এই ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা দুষ্প্রাপ্য তালপাতার অনেকগুলো পুঁথি আছে যাকারিয়া সংগ্রহশালায়। সারা পৃথিবী চষে খুঁজে আনা বিভিন্ন গবেষণা নিবন্ধে সমৃদ্ধ বহু পত্রিকাও আছে। আর আছে দুষ্প্রাপ্য বই। অনেক দান-দক্ষিণা আর হারিয়ে যাওয়ার পর এখনও সংগ্রহে আছে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি, ফার্সি ভাষার কয়েক হাজার বই। এসব বইয়ের অনেকগুলোরই মাত্র একটি কপি বাংলাদেশে আছে।

লেখালেখি

নিজের কর্মময় জীবন ছাড়াও নিজের গবেষণা, আবিষ্কারকে নিজের লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও নিজের বিভিন্ন ভাষার দখলকে কাজে লাগিয়েছেন মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদে।

বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ

পুরাতত্ত্ব নিয়ে তার সারা জীবনের গবেষণা বই আকারে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ নামক বইতে। ছয় শতাধিক পৃষ্ঠার বিশাল এই গবেষণাগ্রন্থটির অনেক তথ্য তিনি ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দকালীন দিনাজপুর অঞ্চলসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বইটি প্রকাশ করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিহীন কোনো ব্যক্তির এধরণের একখানি তথ্যবহুল ও বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ লেখার ইতিহাস বিরল। অনেকেই এটিকে বাংলাদেশের পুরাতত্ত্বের বাইবেলও আখ্যা দিয়ে থাকেন। বইটি এতটাই মৌলিক যে, তা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরাতত্ত্বের পড়াশোনায় পাঠ্যবই হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

দিনাজপুর জাদুঘর

১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুর জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর এই জাদুঘরে রক্ষিত সকল প্রত্নসামগ্রীর বিস্তারিত পরিচিতিসহ একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন জনাব যাকারিয়া। এই তালিকা বিবৃতি আকারে বেরিয়ে আসে দিনাজপুর জাদুঘর নামের বইতে। বইটি একটি পৃথক গবেষণাগ্রন্থ হিসেবেও খুব সমৃদ্ধ।

অনুবাদ

এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাসনির্ভর বিভিন্ন ভাষায় লেখা কিছু দুষ্প্রাপ্য বইও বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অনূদিত বইগুলর মধ্যে রয়েছে:

১. তবকাত-ই-নাসিরি, মূল লেখক: মিনহাজ-ই-সিরাজ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা (১৯৮৩ খ্রি.)

২.মোজাফফরনামা

৩.নওবাহার-ই-মুরশিদ কুলি খান, মূল লেখক: করম আলী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

৪. সিয়ারুল মুতাখখিরিন

সম্পাদনা

তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পাদনার কাজও করেন। সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে আছে:

১.কুমিল্লা জেলার ইতিহাস

২.বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস

এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আর্কিওলজিকাল হেরিটেজ অফ বাংলাদেশ, গ্রাম-বাঙলার হাসির গল্পসহ সাতটি উপন্যাস। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ঝিনুক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রশ্নোত্তরে বাংলাদেশের প্রত্নকীর্তি বইটির প্রথম খণ্ড। দিব্যপ্রকাশ থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি বইটি। প্রথম খণ্ডে হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগ আর দ্বিতীয় খণ্ডে মুসলিম যুগের আলোচনা স্থান পেয়েছে। আরো প্রকাশিত হয় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা বইটি। এছাড়াও দেশি-বিদেশি পত্রিকা-সাময়িকীতে একাধিক ভাষায় ছাপা হয়েছে তার অসংখ্য লেখা।

পুরস্কার ও সম্মাননা

জনাব যাকারিয়া ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ২০১৫ সনে গবেষণায় একুশে পদক লাভ করেন।

মৃত্যু

আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে তার গ্রাম দড়িকান্দির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। (বাংলা উইকিপিডিয়া)

প্রিয় শ্রোতা, আজকের অনুষ্ঠান আপনাদের কেমন লাগলো? আপনারা যদি 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি' বিষয়ক কোনো কিছু জানতে বা আলোচনা করতে চান, তাহলে আমাকে চিঠি লিখবেন বা ই-মেইল করবেন। আপনাদের কাছ থেকে চমত্কার পরামর্শ আশা করছি। আর আপনাদের জানিয়ে রাখি, আমার ইমেইল ঠিকানা হলো, hawaiicoffee@163.com

চিঠিতে প্রথমে লিখবেন, 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি' অনুষ্ঠানের 'প্রস্তাব বা মতামত'। আপনাদের চিঠির অপেক্ষায় রইলাম।

বন্ধুরা, আজকের অনুষ্ঠান এখানেই শেষ করছি। শোনার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আগামী সপ্তাহে একই দিন, একই সময় আপনাদের সঙ্গে আবারো কথা হবে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাইচিয়ান। (জিনিয়া/টুটুল)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040