৩০ মে চীনের 'তুয়ান উ চিয়ে' বা ড্রাগন নৌকা উত্সব।
চীনের বিভিন্ন বাজার বা শপিং মলে যখন অনেক ঐতিহ্যবাহী রাইস ডাম্পলিং বা জোংযি (traditional chinese rice-dumpling,zongzi) বিক্রি করতে দেখা যায়, তখন বুঝতে হবে, 'তুয়ান উ চিয়ে' আসছে! চীনে যেন সবসময় খাবার ও উৎসব একে অপরের সঙ্গে জড়িত। সত্যিই, এ উৎসবে মৌসুমি খাবার খাওয়া হয়। তবে, 'তুয়ান উ চিয়ে' কোনো বিশেষ খাবারের উৎসব নয়। চীনের প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই 'তুয়ান উ চিয়ে' বা ড্রাগন নৌকা উৎসব। এর বেশ কিছু গল্প প্রচলিত রয়েছে।
উত্সবের উত্স
উত্সবের নাম
চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি বছরের পঞ্চম মাসের পঞ্চম দিন হলো 'তুয়ান উ চিয়ে'। 'তুয়ান' চীনা ভাষায় মানে শুরু, 'উ' মানে দুপুর। আর পাঁচ শব্দের উচ্চারণও 'উ'। প্রতি মাসে রয়েছে পাঁচ, পনের, পঁচিশ। এর মধ্যে পাঁচই প্রথম । তাই এদিনই তুয়ান উ চিয়ে।
উত্সবের ইতিহাস
তুয়ান উ চিয়ের ইতিহাস খুব দীর্ঘ, প্রায় ২৫০০ বছর। চীনে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতি এ উৎসব পালন করে থাকে।
আচ্ছা, 'তুয়ান উ চিয়ে' কখন, কিভাবে শুরু হয়েছিল? এর মধ্যে দু'টি ধারণা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।
একটি হলো এরকম। প্রায় ২৫০০ বছর আগে ছাং চিয়াং নদীর মধ্য ও নিম্ন অববাহিকার পাই ইউয়ে জাতির লোকেরা ড্রাগনকে তাদের টোটেম হিসেবে মনে করত। ড্রাগনের উদ্দেশ্যে বলিদানের মাধ্যমেই তারা 'তুয়ান উ চিয়ে' উৎসব শুরু করে।
আরেকটি ঘটনা চীনের বিখ্যাত দেশপ্রেমিক কবি ছু ইউয়ানের সঙ্গে জড়িত। ছু ইউয়ান ছিলেন ছু রাজ্যের মন্ত্রী। তিনি একজন প্রতিভাবান এবং দেশপ্রেমিক মন্ত্রী ছিলেন। তিনি আন্তরিকভাবে তার দেশ ও রাজার সেবা করতেন। দেশের মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য ও সমৃদ্ধি অর্জন এবং শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রস্তাব দিতেন। তবে অন্যের অপবাদে রাজা তার প্রস্তাব গ্রহণ করতেন না। এক সময় ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে রাজা তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। পরে ছিন রাজ্য ছু রাজ্যকে পরাজিত করে। এ খবর শুনে ছু ইউয়ান বিষণ্ণ হয়ে প্রচণ্ড দুঃখে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সেদিন ছিল চীনের চান্দ্রপঞ্জিকার ৫ম মাসের ৫ম দিন। প্রতি বছরে লোকেরা এদিন তাকে স্মরণ করে। আর এভাবেই 'তুয়ান উ চিয়ে' শুরু হয়।
কবি ছু ইউয়ান তার অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা ও উন্নত আচরণের জন্য সবার কাছে খুবই প্রিয় ছিল। তাই দ্বিতীয় ধারণাটি চীনের সমাজে খুব জনপ্রিয় হয়েছে।
তবে প্রতিটি উৎসব, বিশেষ করে দীর্ঘ ইতিহাসের উৎসবগুলো আসলে বিভিন্ন কারণে বিবর্তিত হয়েছে। এ দুটি ধারণার পাশাপাশি 'তুয়ান উ চিয়ে' চীনের তাও ধর্ম, চান্দ্রপঞ্জিকার ২৪টি সৌরপর্যায় ও সাধারণ লোকের স্বাস্থ্য ও বুদ্ধির সঙ্গে জড়িত। 'তুয়ান উ চিয়ে' দিবসটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গার বিভিন্নভাবে উদাযাপিত হয়।
উত্সবের বিভিন্ন রীতিনীতি
ড্রাগন নৌকায় চড়া
ওপরে আমি 'তুয়ান উ চিয়ে'র অর্থের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। আপনারা হয়তো জানতে চাইবেন, এ দিবসের সঙ্গে ড্রাগন নৌকার কী সম্পর্ক? এবার সে কথাই বলছি।
এ উত্সবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হলো, ড্রাগন নৌকায় চড়া। এদিন লোকেরা ড্রাগনের মতো নৌকায় চড়ে, এবং নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। প্রতিযোগিতার সময় নৌকায় লোকেরা ঢাক বাজাতে বাজাতে স্লোগান দেয়। আর নদী তীরে দাঁড়িয়ে অনেক লোক তাদের উৎসাহ দিতে থাকে। এ দৃশ্যটি অনেক চমৎকার। ঠিক যেন নদীবিধৌত বাংলাদেশের নৌকাবাইচ উৎসবের মতো!
প্রথমে লোকেরা নৌকায় চড়ে নদীতে ছু ইউয়ানের মৃতদেহের খোঁজ করেছিল। নৌকার রূপ দেওয়া হয়েছিল ড্রাগনের মতো। কারণ লোকেরা বিশ্বাস করত, যে সব মাছ ছু ইউয়ানের মৃতদেহ খেতে চায়, তাদেরকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে পারে ড্রাগন। ঢাক-ঢোল বাজালেও মাছগুলো ভয় পায়। এটা ছাড়াও ড্রাগন নৌকায় চড়া পাই ইউয়ে জাতির বলিদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বর্তমান ড্রাগন নৌকা উৎসব একটি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে তার গুরুত্ব অপরিবর্তিত রয়েছে। ড্রাগন নৌকা উত্সবের নাম দেখে এটা সহজেই বোঝা যায়।
ক্যালামুস (Calamus) ও এই সাও(Ay Tsao) ঝোলানো
এদিন লোকেরা এ দু'টি উদ্ভিদ বাড়ির দরজা বা ঘরের মধ্য ঝুলিয়ে রাখে। এটাও 'তুয়ান উ চিয়ে'র একটি সংস্কৃতি। ছবিতে দেখে নিন বিশেষ এ দু'টি উদ্ভিদ।
ক্যালামুস ও এই সাও বিশেষ সুগন্ধযুক্ত। এর গন্ধে মশা, মাছি জাতীয় ছোট ছোট পোকা-মাকড় কাছে আসে না এবং বাতাস বিশুদ্ধ থাকে। এ দুটি উদ্ভিদ চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 'তুয়ান উ চিয়ে'র সময় আবহাওয়া বেশ গরম হয়ে ওঠে, হরেক রকম পোকা-মাকড়ের উৎপাত শুরু হয়। পাশাপাশি এ সময় মানুষও খুব সহজে অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রাচীনকালে লোকদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এত ভালো ছিল না। তাই লোকেরা ক্যালামুস ও এই সাও ঝুলিয়ে রাখার মাধ্যমে রোগ-বালাই প্রতিরোধ করত।
জোংযি খাওয়া
জোংযি চীনের ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু একটি খাবার, সাধারণত 'তুয়ান উ চিয়ে'র সময় এটি খাওয়া হয়।
কিংবদন্তি অনুসারে, প্রথমে লোকেরা ছু ইউয়ানের মৃতদেহের খোঁজে নদীতে যায়। সেখানকার মাছগুলো যাতে তার মৃতদেহ না খায় সেজন্য নদীতে খাবার ছিটিয়ে দেয়। এটাই ধীরে ধীরে জোংযি সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। আর আগেই বলেছি, জোংযি পাই ইউয়ে জাতির বলিদানের একটি অংশ।
জোংযি চাল দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার। লোকেরা নলখাগড়ার পাতাতে চাল জড়িয়ে স্টিম বা বাষ্পের আঁচে রান্না করে খায়। চালের সঙ্গে থাকে আরও অনেক উপাদান। যেমন সবুজ ও লাল শিমের বীজ, কুল, চীনাবাদাম, ডিমের কুসুম ইত্যাদি।
অঞ্চলভেদে জোংযি'র স্বাদও আলাদা। কোনো অঞ্চলের মানুষ মিষ্টি জোংযি খায়, কোনো অঞ্চলে লোনা জোংযি খাওয়া হয়। কোনো অঞ্চলে শুধু নিরামিষ জোংযি'র প্রচলন রয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে মানুষ মাংসের জোংযি খেতে পছন্দ করে।
বর্তমান 'তুয়ান উ চিয়ে' ছাড়া, প্রায় সারা বছরই সুপারমার্কেটে জোংযি পাওয়া যায়। সেখান থেকে আপনি ভিন্ন স্বাদের জোংযি বাছাই করতে পারেন। দেখুন তো, কোন ধরনের জোংযি আপনার পছন্দ!
সিয়ং হুয়াং (realgar) মদ খাওয়া
প্রাচীন চীনে সিয়ং হুয়াং গুঁড়া করে মদের সঙ্গে রেখে সিয়ং হুয়াং মদ তৈরি করা হত। এই মদ সুস্থতা ও বিষাক্ত পোকা তাড়াতে সাহায্য করে।
এ রীতিনীতি ছু ইউয়ানের সঙ্গে জড়িত। লোকেরা ছু ইউয়ানের মৃতদেহ মাছের হাত থেকে রক্ষার জন্য নদীতে সিয়ং হুয়াং মদ ঢেলে দিয়েছিল। দেখুন বন্ধুরা, লোকজন ছু ইউয়ানকে কতটা পছন্দ করত! (আর প্রাচীন চীনের মানুষ কিন্তু মৃতদেহকে বেশ সম্মান করত)
সিয়ং হুয়াং মদও এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী ওষুধ। লোকেরা সিয়ং হুয়াং মদ দিয়ে পোকামাকড়ের বিষ তাড়ানো এবং কিছু রোগের চিকিত্সা করে থাকে। প্রাচীনকালে চীনারা সিয়ং হুয়াং মদ দিয়ে সাপ-বিচ্ছু জাতীয় পোকামাকড় তাড়াত।
'তুয়ান উ চিয়ে'র সময়ে লোকেরা সিয়ং হুয়াং মদ খেয়ে রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য রক্ষা করে। শিশুরা মদ খেতে পারে না, তাই লোকেরা সিয়ং হুয়াং মদ তাদের হাতে কপালে মাখে, যাতে পোকাগুলো তাদেরকে কামড় না দেয়।
অন্যান্য রীতিনীতি
'তুয়ান উ চিয়ে' ব্যাপকভাবে প্রচলিত হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রীতিনীতি দেখা যায়। এতক্ষণ যে রীতিনীতির কথা বললাম, তা ছাড়া আরও কিছু নিয়ম রয়েছে। যেমন,
ডিম ঝোলানো।
এদিন শিশুদের হাতে ডিম ঝুলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সারা বছর সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কামনা করা হয়।
গায়ে ছোট থলি ঝোলানো।
ছোট আকারের এসব থলিতে সিয়ং হুয়াং, ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ও সুগন্ধযুক্ত বস্তু রাখা হয়। এসবের গন্ধে পোকামাকড় দূরে চলে যায়, পাশাপাশি ভূতও কাছে আসবে না বলে বিশ্বাস করা হয়।
রঙ্গিন সুতা দিয়ে এসব থলি ঝোলান হয়। প্রাচীন চীনারা লাল হলুদ সাদা কালো সবুজ এ পাঁচটি রংকে শুভ রং হিসেবে বিবেচনা করত। তাই লোকেরা এসব রংয়ের কাপড় বা সূতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন জিনিস শিশুদের কব্জি বা গলায় ঝুলাত।
মূলত, 'তুয়ান উ চিয়ে' সবার সুস্থতা ও নিরাপদ রাখার একটি দিবস। এ দিনের পর থেকে চীনের আবহাওয়া বেশ গরম হয়ে ওঠে। চীনের 'তুয়ান উ চিয়ে' আপনাদের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বয়ে আনুক এ আশা ব্যক্ত করছি।
(তুহিনা/তৌহিদ)