20170516yinyue.mp3
|
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি আনন্দী বেইজিং থেকে আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজকের 'সুর ও বাণী' আসরে চীনের চিয়াংসু প্রদেশের সুন্দর নগর সুচৌর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরবো এবং শুনাবো এ নগরসম্পর্কিত কয়েকটি গান।
সুচৌ চিয়াংসু প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাচীনকালে এর নাম ছিল 'উ', 'গুসু' অথবা 'পিং চিয়াং'। সুচৌ চীনের ঐতিহাসিক নগর। সংস্কৃতি ও পর্যটনের জন্য এটি বিখ্যাত। ছাংচিয়াং নদীর বদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ এই কেন্দ্রীয় শহরটিতে আছে উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প। শহরের পূর্ব দিকে শাংহাই, দক্ষিণে চিয়া সিং, পশ্চিমে থাই হু হ্রদ, এবং উত্তরে ছাং চিয়াং নদী। সুচৌর ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছরের। সুচৌবাসীরা সাধারণত 'উ ইয়ু' নামক আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। সুচৌর বাগান বিশ্ববিখ্যাত। ইউনেস্কো সুচৌর বাগানকে 'বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বন্ধুরা, চলুন শুরুতেই 'সুচৌর সুন্দর দৃশ্য' শীর্ষক গানটি উপভোগ করি।
সুচৌ শহর প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে আসবে সুচৌ নদীর কথা। সুচৌ নদী ছাং ছিয়াং নদীর শাখা উসোং নদীর শাংহাই অংশ। সুচৌ নদীর তীরে ছিল শাংহাইয়ের প্রাথমিক কেন্দ্র, যা থেকে প্রাচীনকালের শাংহাই গড়ে ওঠে। তারপর প্রায় ১০০ বছর ধরে ধাপে ধাপে আন্তর্জাতিক মহানগর শাংহাইয়ের জলসীমার কাঠামো গঠিত হয়। সুচৌ নদীর নামটি দেওয়া হয়েছে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। তখন কিছু বিদেশি অভিবাসী শাংহাই থেকে উসোং নদী দিয়ে জাহাজে করে সুচৌ যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে তারা এ নদীর নাম রাখেন 'সুচৌ নদী'। ১৮৪৮ সালে শাংহাইয়ের স্থানীয় সরকারের সাথে শাংহাইয়ে বৃটিশ কনস্যুলেটের উপনিবেশ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে 'উসোং নদীর' নাম লেখা হয় 'সুচৌ নদী'। এর পর থেকে ধীরে ধীরে 'সুচৌ নদী' নামটি প্রচলিত হয়ে যায়।
বন্ধুরা, শুনুন ফেই ইয়ু ছিংয়ের গাওয়া 'সুচৌ নদীর তীরে' গানটি।
সুচৌর স্থানীয় ভাষা হান জাতির সাতটি প্রধান আঞ্চলিক ভাষার অন্যতম। এ ভাষার নাম 'উ ইয়ু'। সুচৌর স্থানীয় ভাষার ইতিহাস ৩২০০ বছরের। মাঝখানে প্রায় ১০০০ বছর উ ভাষা সেখানকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে সুচৌর স্থানীয় ভাষা 'উ' কেন্দ্রীয় ভাষার মর্যাদা পায়। তাই আজও এ ভাষার মধ্যে অনেক প্রাচীন শব্দ রয়ে গেছে। সুচৌর স্থানীয় ভাষা শুনলে মনে হবে কেউ নরম কণ্ঠে গান গাইছে। বন্ধুরা, এবার শুনুন 'সুচৌ নদীর প্রেমের গান'। শিল্পী সুচৌর স্থানীয় ভাষায় এ গানটি গেয়েছেন।
সুচৌ 'খুন' অপেরা ও 'সু' অপেরার জন্মস্থান। 'খুন' অপেরা হচ্ছে চীনের প্রথম বিশ্ব অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। ইউয়ান রাজবংশের শেষে ও মিং রাজবংশের প্রথমে সুচৌ শহরের নিকটে খুনশান ও থাই ছাং অঞ্চল থেকে এ অপেরার সৃষ্টি। ছিং রাজবংশ আমলে 'খুন' অপেরা সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, সুচৌর শহর ও গ্রামাঞ্চলের লোকজন 'খুন' অপেরা শুনতে ও শিখতে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। তখন প্রতিবছর হুছিউ অপেরা মেলার আয়োজন করা হতো। এমনকি, 'খুন' অপেরা চীনের বড় বড় শহরে টানা দু'শ বছর ধরে শীর্ষ স্থানে ছিল। 'খুন' অপেরা সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে অনেক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও অভিনেত্রী এবং বিখ্যাত লেখকেরও আবির্ভাব ঘটে।
বন্ধুরা, সময় স্বল্পতার কারণে আমি এ অনুষ্ঠানে আপনাদের 'খুন' অপেরা শুনাতে পারছি না। তবে, 'জি জুন তিয়াও' নামে একটি স্থানীয় লোকসংগীত শুনাবো। এ থেকে আপনারা সুচৌর স্থানীয় সংগীত সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা পাবেন।
বন্ধুরা, চীনের চারটি অঞ্চলের সূচিকর্ম সবচেয়ে বিখ্যাত। এগুলো হচ্ছে: হুনান প্রদেশের সুচিকর্ম 'সিয়াং সিউ', সিছুয়ান প্রদেশের সূচিকর্ম 'শু সিউ', কুয়াং তুং প্রদেশের সূচিকর্ম 'ইয়ুন সিউ', এবং সুচৌর সূচিকর্ম 'সু সিউ'। সু সিউ'র ইতিহাস ২৬০০ বছর আগের 'বসন্ত ও শরত্ যুগ' থেকে শুরু। সু সিউ'র প্রধান বিষয় হচ্ছে মানুষের মূর্তি, পাখি, ফুল, প্রাণী ও প্রাকৃতিক দৃশ্য। কাপড়, পাখা, খাতা বা পর্দার ওপর এ সূচিকর্ম করা যায়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর সুচৌর শিল্পীরা সাফল্যের সঙ্গে পটের দু'দিকে সূচিকর্ম করার কৌশল আবিষ্কার করেন। তাদের প্রতিনিধিত্ব শিল্পকর্ম হলো 'দু'দিক বিড়াল'। আপনারা সুচৌ যাওয়ার সুযোগ পেলে সেখান থেকে কিছু 'সু সিউ' সূচিকর্ম ক্রয় করতে পারেন, উপহার হিসেবে। যেমন, রুমাল বা মাফলার। এগুলো খুব বেশি দামি নয়, তবে দেখতে খুব সুন্দর। বন্ধুরা, শুনুন ছাও ফু চিয়ার গাওয়া 'সু সিউ' নামের গান।
সুচৌ খুব শান্ত ও সুন্দর শহর বলে প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন রাজবংশের কবি ও লেখক একে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন। চীনারা এ শহর পছন্দ করেন। বিদেশিদের পছন্দের তালিকাতেও এ শহরটি উপরের দিকেই আছে।
জাপানের সুরকার রিয়োছি হাতোরি চীনে কিছুদিন ছিলেন। চীনের লোকসংগীত সম্পর্কে তার ভালো ধারণা আছে। তার একটি চীনা নামও রয়েছে। একবার তিনি সুচৌ ভ্রমণে যান এবং সেখানকার মানুষ ও সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন। পরে তিনি স্থানীয় লোকসংগীতের উপাদান ব্যবহার করে 'সুচৌর রাত্রির সুর' লেখেন। বন্ধুরা, শুনুন জাপানি ভাষার এ গানটি।
চীনারা নদনদী ও পাহাড় পছন্দ করেন। চীনের সাহিত্যিক ও শিল্পীরা বিভিন্ন জায়গার নদনদী ও পাহাড় নিয়ে অনেক কবিতা ও গান রচনা করেছেন। তাদের কবিতা ও গানের মাধ্যমে সেসব নদনদী ও পাহাড়ের নাম দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন, হাংচৌ শহর বললে পশ্চির হ্রদের কথা মনে পড়ে; আর সুচৌ বললে আমাদের মনে পড়ে 'থাই হ্রদ'-এর কথা। থাই হ্রদ ছাং চিয়াং নদী বদ্বীপের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। ১৯৭৮ সালে লেখক রেন হোং জুই 'থাই হ্রদের সৌন্দর্য' নামে একটি গান লেখেন। গানে সুর দেন সুরকার লোং ফেই। 'থাই হ্রদের সৌন্দর্য' গানটি শুনলে দক্ষিণ চীনের জলমাতৃক গ্রামের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এ গানটিতে থাই হ্রদের প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রশংসার পাশাপাশি সুন্দর আগামীর প্রত্যাশাও করা হয়েছে।
সুচৌ পূর্ব চীনের খাদ্য সংস্কৃতির তিনটি প্রধান কেন্দ্রের অন্যতম। বাকি দুটি হচ্ছে বেইজিং ও কুয়াংতোং। সুচৌতে অনেক নামকরা সুস্বাদু খাবার আছে। সেখানকার রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের দামও জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। সেখানে অনেক ধরনের নুডুলস রেস্তোরাঁ আছে। একইরকম নুডুলস হলেও ভিন্ন রান্নার পদ্ধতিতে ভিন্ন স্বাদ সৃষ্টি হয়। খেতে অনেক মজা।
সুচৌ 'প্রাচ্যের জলীয় নগর' নামেও খ্যাত। সেখানে আপনি দেখতে পাবেন বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র সেতু আর সুন্দর করে সাজানো পুরোনো বাড়িঘর। সুচৌর প্রাচীন বাগানগুলো দক্ষিণ চীনে অত্যন্ত নামকরা। ১৪.২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুচৌ প্রাচীন নগর ও সুচৌর নয়টি প্রাচীন বাগান যথাক্রমে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিশ্ব অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের খেতাব অর্জন করেছে। সবচেয়ে পুরোনো বেসরকারি বাগান হলো পূর্ব চিন আমলে অর্থাত্ চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত পিচিয়াং বাগান। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে সুচৌতে প্রায় দু'শতাধিক বাগান ছিল। তখন সুচৌকে 'পৃথিবীর স্বর্গ' বলা হতো।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি আমরা। এখন শুনুন 'সুচৌ ভ্রমণ করুন' নামের গানটি।
প্রিয় বন্ধুরা, এতোক্ষণ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিলাম চীনের ঐতিহাসিক ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুন্দর নগর সুচৌয়ের সাথে, শোনালাম কয়েকটি গান। সুযোগ পেলে আপনারা সুচৌতে বেড়াতে যাবেন আশা করি। চীনে বেইজিং, শাংহাইয়ের মতো আন্তর্জাতিক মহানগর ছাড়াও দেখার মতো অনেক সুন্দর শহর আছে। সুচৌ সেগুলোর একটি। সেখানে গেলে আপনারা মুগ্ধ হবেন। তো, আজকের 'সুর ও বাণী' আসর এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকুন। আবার কথা হবে। (ইয়ু/আলিম)