প্রাচীন সিল্করোড বা রেশমপথ পুননির্মাণের মাধ্যমে এশিয়া-আফ্রিকা ও ইউরোপকে এক উন্নয়নের সূতোয় বাঁধতে ২০১৩ সালে 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাব উত্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তাঁর এই প্রস্তাব গত কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় চীনের রাজধানী পেইচিংয়ে রোববার থেকে শুরু হয়েছে এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় ফোরাম। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফ, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেসসহ বিশ্বের ২৯টি দেশের শীর্ষ নেতা এবং বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ ৭০টি বেশি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। ফোরামে সহযোগিতা ও অভিন্ন কল্যাণের আলোকে নীতিগত যোগাযোগ, সড়ক যোগাযোগ, সুস্থ-বাণিজ্য, মানবিক যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হবে দুদিনের ফোরামে।
প্রধান উন্নয়ন সহযোগী ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ শুরু থেকেই চীনের প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাবকে জোরালোভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে। পেইচিং ফোরামে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি উভয় মহলেই চীনরে এ উদ্যোগের প্রতি জোর সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন থিংকট্যাঙ্ক ও গণমাধ্যম বিষয়টিকে বরাবরই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
'এক অঞ্চল, এক পথ' সম্মেলনকে সামনে রেখে ৮ মে ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ-বিসের চেয়ারম্যান ও চীনের বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ। সেমিনার আলোচক ছিলেন বেসরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সাবে রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান প্রমুখ। বক্তারা বলেন, এক অঞ্চল এক পথ ধারনা কার্যকর করতে হলে চীনকেই এর নেতৃত্ব দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণেও চীনকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। এ অঞ্চলের আরেক বৃহৎ দেশ ভারতের এ উদ্যোগে অংশগ্রহণ জরুরি বলেও মনে করেন তারা।
পেইচিং শীর্ষ ফোরামের চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের উদ্বোধনী ভাষণে এ বিষয়গুলোকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। চীনের প্রেসিডেন্ট 'এক অঞ্চল এক পথ' উদ্যোগকে শান্তি, সমৃদ্ধি, উন্মুক্ততা ও উদ্ভাবনের স্বার্থে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচ নীতির ভিত্তিতে এ উদ্যোগে অংশগ্রহণকারী সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক চায় পেইচিং। চীন এ উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগেও যে পিছ পা নয় তাও প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তার ভাষণে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। রেশমপথ তহবিলে চীন ১০০ ট্রিলিয়ন ইউয়ান রেনমিনপির বিশাল তহবিল যোগান দেবে বলেও ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট সি। চীনের জাতীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও চীনের আমদানি-রপ্তানি ব্যাংক যথাক্রমে ২৫০ বিলিয়ন ও ১৩০ বিলিয়ন ইউয়ান সমমূল্যে ঋণ দেবে যা দিয়ে 'এক অঞ্চল এক পথ' উদ্যোগের আওতায় অবকাঠামো নির্মাণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক খাতে সহযোগতা করা হবে।
এ ছাড়াও চীন এক অঞ্চল এক পথ উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে 'অবাধ বাণিজ্য জাল প্রতিষ্ঠা করবে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিনিময় বাড়াবে। আগামী তিন বছরে এক অঞ্চল এক পথ সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোকে ৬০ বিলিয়ন ইউয়ান সহায়তারও ঘোষণা দেন চীনের প্রেসিডেন্ট।
'আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার, যৌথভাবে 'এক অঞ্চল এক পথ' উদ্যোগের বাস্তবায়ন, অভিন্ন কল্যাণ ও উন্নয়ন অর্জন'- প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে শুরু হওয়া পেইচিং শীর্ষ ফোরাম সফল হবে বলে আশা সকলের। তবে শেষ মুহূর্তে ভারত সম্মেলনে প্রতিনিধি না পাঠানোয় হতাশা ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকরা। সাবেক জজ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালও সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশের শীর্ষ নেতারা এ ফোরামে যোগ দিয়েছেন। এ অবস্থায় ভারত সম্মেলনে প্রতিনিধি না পাঠানো ঠিক হয়নি।
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের মধ্য দিয়ে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর নিয়েই ভারতের মূল আপত্তি। নয়দিল্লি ১৩ মে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে এ জাতীয় প্রকল্প নিতে হয়। তবে ইকতেদার আহমেদ বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন। যে কারণেই হোক না কেন ভারত যদি এ উদ্যোগে অংশীদার না হয় শেষ পর্যন্ত দেশটি একঘরে হয়ে পড়বে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
মাহমুদ হাশিম, ঢাকা থেকে।