0513kholamela
|
বর্তমানে 'বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর' এই রেশমপথের অংশ হিসেবে তার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সত্তা। রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল কেবল এক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অঞ্চলই নয়, বরং মানবসভ্যতা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-অর্থনীতির সমন্বয়ে গঠিত এক 'সভ্যতার অঞ্চল'ও বটে।
এ উদ্যোগ গ্রহণের ৩ বছর পর অনেক দেশ ও অঞ্চল সক্রিয় সাড়া দিয়েছে এবং প্রাথমিক ফলাফল অর্জিত হয়েছে। এর ভিত্তিতে আগামী ১৪ ও ১৫ মে 'এক অঞ্চল, এক পথ'বিষয়ক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ফোরাম বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হবে। তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষনেতারা এ ফোরামে একত্রিত হয়ে বিশ্ব উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করবেন। এবারের ফোরামের প্রতিপাদ্য 'আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করে এক অঞ্চল, এক পথের যৌথ নির্মাণের মাধ্যমে অভিন্ন উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা'। এতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, গোলটেবিল বৈঠক এবং উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনসহ তিনটি অংশ থাকবে।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর আগে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, এবারের ফোরামের ৪টি লক্ষ্য রয়েছে, সহযোগিতার লক্ষ্য ও মূলনীতি আরো সুস্পষ্ট করা, পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রকল্প নির্ধারণ করা, জনকল্যাণের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এবং সহায়তার পরিষেবা ব্যবস্থা আরো উন্নত করা। দু'দিনব্যাপী ফোরামে প্রায় ১২০০ অংশগ্রহণকারী অবকাঠামো খাত, পুঁজি বিনিয়োগ, আর্থ-বাণিজ্যিক সহযোগিতা, জ্বালানি সম্পদ, অর্থায়ন, সাংস্কৃতিক বিনিময়, পরিবেশ রক্ষা এবং সামুদ্রিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করবেন।
আজকের খোলামেলা অনুষ্ঠানে 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাব এবং আসন্ন শীর্ষফোরাম নিয়ে কথা বলছি চীনের উহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলাজির 'এক অঞ্চল, এক পথ গবেষণা কেন্দ্রের' গবেষক ডাঃ মোস্তাক আহমেদ গালিবের সঙ্গে। তিনি বর্তমানে চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি করছেন। (স্বর্ণা/তৌহিদ/মুক্তা)
নিচে ড. মোস্তাক আহমেদ গালিবের সাক্ষত্কারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-
'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাবের আসল লক্ষ্য এবং এই প্রস্তাবে বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ড. মোস্তাক আহমেদ গালিব বলেন,
রেশমপথ খুব বড় একটি প্রস্তাবনা। প্রাচীনকালে এটি ছিলো রেশম বাণিজ্যের একটি পথ। এই পথের আরেকটি অংশ ছিলো সামুদ্রিক রেশমপথ। এই সামুদ্রিক রেশমপথেই বাংলাদেশের অবস্থান। বর্তমানে দু'দেশের মধ্যকার যোগাযোগে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। যার মূল ধারক ও বাহক হচ্ছে চীন সরকারের 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাব। 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক উপাদান ও উপকরণসমূহের অঞ্চলভিত্তিক সহজ প্রবাহ, প্রাপ্ত সম্পদের সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণ, যৌথ, সমন্বিত ও সুষম আঞ্চলিক বাজার প্রতিষ্ঠাকরণ।
এই মূল উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ কৌশলগত। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান চীনের ইয়ুন নান, ছিচুয়ান ও তিব্বতের নিকটবর্তী। এই কারণে বাংলাদেশ তার বন্দর সুবিধা ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।পাশাপাশি বাংলাদেশে আধুনিককালের অর্থনীতিবিদরা যে সস্তা শ্রমের কথা বলে থাকেন, বাংলাদেশে চীনের তুলনায় সস্তা শ্রম পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের আরেকটি সুবিধা আছে তা হলো 'অ্যাকসেস টু ওয়েস্টার্ন মানি'। বিদেশে উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশের একটি ভালো ভ্যালু (মূল্য) আছে। এই জিনিসগুলো আরো বড় আকারে বাংলাদেশের জন্য চীনা 'এক অঞ্চল, এক পথ' এই কৌশলপথে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আরো বড় আকারের সুযোগ সুবিধা বয়ে আনতে পারে বলে আমি মনে করি।
'এক অঞ্চল, এক পথ' উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের লক্ষ্য নিয়ে মি. গালিব বলেন,
বাংলাদেশে বর্তমানে উন্নয়নের একটি জোয়ার পরিলক্ষিত হচ্ছে, অর্থাত্ বাংলাদেশ বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বেশ শক্তভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি এতে গর্ব বোধ করি। কিন্তু এখানে পাশাপাশি আরো কিছু বিষয়ে সাবধানতার সুযোগ রয়েছে। যেমন-আমরা অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে ৮% জিডিপির কথা বলে আসছি। কিন্তু এখন ৮% জিডিপি পেতে গেলে যে জিনিসগুলো আমাদের করতে হবে, তা হলো বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এখন বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যে শুধু সস্তা শ্রমই যথেষ্ট এই কথাটি কিন্তু সব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে খুব বেশি সঠিক নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যদি আমরা খুব গভীরভাবে পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যায় যে, তা একটি বা দু'টি খাতের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল, যেটি অর্থনীতির জন্য খুব শুভ নয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরো সতর্ক হতে হবে এবং 'এক অঞ্চল, এক পথ' এরকম কোনো পরিকল্পনার মাধ্যমে মাল্টি পারপাস অর্থনীতি অর্থাত্ বহুমুখী দেশজ অর্থনীতির সুযোগ যদি সৃষ্টি করা যায়, সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দেশের লাভ হবে বলে মনে করি। পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিদ্যুত্ উত্পাদন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ৮% জিডিপি হতে হলে বা পেতে গেলে অবকাঠামো এবং বিদ্যুত্ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে ১৫৩৭৯ মেগাওয়াট। তো আগামী চার বছরে বাংলাদেশ সরকারের আরো ১১৬০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুত্ বাড়াতে হবে, যদি পাওয়ার প্লান্ট মাস্টার সেক্টর অনুসারে বাংলাদেশ এগোতে চায়। এখন কথা হচ্ছে এই যে, এত বড় আকারের বিদ্যুত্ মানে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ যদি আমরা পেতে যাই, সেক্ষেত্রে বর্তমানে যে গ্যাস আছে বাংলাদেশে সেই গ্যাস অপ্রতুল বা যে পরিমাণ কয়লার মজুদ আছে সেটাও অপ্রতুল। তাহলে কি করতে হবে? আমাদেরকে কয়লা বা গ্যাস আমদানি করতে হবে। এখন কয়লা বা গ্যাস আমদানি করতে হলে আমাদের দরকার কয়লা বা গ্যাস আমদানি করার মতো যোগ্য বন্দর। বন্দরের গভীরতা ইত্যাদি বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য। এখন আমাদের দরকার একটি গভীর বন্দর, যেখান দিয়ে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ কয়লা বা গ্যাস আমদানি করতে পারবো বা গ্যাস আমদানি করার জন্য স্পেসিফাইড এলএমজি টার্মিনাল এই জিনিসগুলো। আবার এই জিনিসগুলো করতে গিয়ে যদি আমরা ওই ১১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্ল্যান থেকে যদি পিছিয়ে যাই তাহলে আবার ওই জিডিপি ৮% থেকে আমরা পিছিয়ে যাবো। এখন এই জিনিসগুলো একটার সাথে আরেকটা রিলেটেড।
এখন আমাদের ১১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত লাগবে, পাশাপাশি আমাদের বন্দর লাগবে, জ্বালানি লাগবে এবং এই সবকিছুর মাধ্যমে আমাদের ৮% জিডিপিতে পৌঁছতে হবে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের মূল উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং যার মাধ্যম সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এর সুফল ভোগ করবে এবং বাংলাদেশ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে এগিয়ে যাবে। এখন 'এক অঞ্চল, এক পথ' পরিকল্পনার মধ্যেও এই জিনিসগুলো রয়েছে। কারণ যদি বিদ্যুত্ না থাকে তাহলে আপনি যোগাযোগ করতে পারবেন না, কানেক্টিভিটি বাড়বে না, বিদ্যুত্ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখি 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রকল্পের বেশিরভাগ দেশেই বিদ্যুত্ প্রকল্প বর্তমান। তো এই জিনিসগুলো যদি আমরা খুব সার্বিকভাবে খুব ডিপলি (গভীরভাবে) দেখতে যাই, তাহলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে 'এক অঞ্চল, এক পথ' একটা খুব ভালো ম্যাচ (মানানসই), মানে একটি আসলে আরেকটির পরিপূরক।
এখন ব্যাপারটি হচ্ছে আমরা আসলে এটিকে কিভাবে ব্যবহার করি। আমাদের উচিত আরো ইফিসিয়ান্টলি 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাবনা ব্যবহার করা, বা এটি অনুধাবন করা। সে ক্ষেত্রে আমি আশা করি, আমাদের যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ঘোষণা করার যে পরিকল্পনা আমরা আশা করি সেটি সম্ভব এবং 'এক অঞ্চল, এক পথের' বহুমাত্রিক ব্যবহার মাধ্যমে সেক্ষেত্রে আমরা বেশ দ্রুত এগিয়েও যেতে পারি বলে আমি মনে করি'।
'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রস্তাব সম্পর্কিত নীতিগত যোগাযোগ, অবকাঠামোগত সমন্বয়, অবাধ বাণিজ্য, অর্থসংগ্রহ ও মানুষে মানুষে বন্ধন নিয়ে মি. গালিব বলেন,
নীতিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। যেমন- বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যদি যোগাযোগ বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে একটি ভালো ফলাফল আশা করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, আমরা বিগত কয়েকবছর যাবত দেখছি, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পিপিপি অর্থাত্ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ, এই পিপিপি প্রকল্পের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু যদিও সরকার এ ব্যাপারে বেশ উদার, বর্তমান সরকার পিপিপি প্রকল্পের ব্যাপারে বেশ উদার এবং মনোযোগী, তারপরও পিপিপি প্রকল্পে আমরা তেমন কোনো বাস্তবিক অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। তো, এখন আমরা যদি এই 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশলপথের সাথে বাংলাদেশ সরকারের পিপিপি প্রকল্পের একটি যোগসূত্র স্থাপন করতে পারি, সেক্ষেত্রে একটি ভালো ফলাফল উভয় দেশের জন্য বয়ে আসতে পারে।
তার পাশাপাশি কানেক্টিভিটি বা যোগাযোগ বৃদ্ধি, কানেক্টিভিটির জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের কোনো বিকল্প নাই। যেমন আমি একটু আগেই বলেছি যে, বাংলাদেশে সস্তা শ্রম আছে। এখন সস্তা শ্রম থাকলেই হবেনা, সস্তা শ্রমটাকে যদি আমরা অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চাই বা ব্যবহার করতে যাই, সেক্ষেত্রে কানেক্টিভিটি ছাড়া বিকল্প নাই, অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। তারপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগাযোগ বৃদ্ধি জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের জন্য গ্যারান্টর বা প্রকল্প গ্যারান্টের দরকার হয়, তো প্রকল্প গ্যারান্টের অনেক টার্মস অ্যান্ড কনডিশন্স আছে। এই জিনিসগুলো হয়তো অনেক ক্ষেত্রে যদি আমরা আগে থেকে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে রাখি সেক্ষেত্রে এই সম্ভাব্য গ্যারান্টের কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে।
তারপর মানুষে মানুষে যোগাযোগ। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধির মূল বিষয়টা হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা অর্জন। কারণ পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস না থাকলে কোনো প্রকল্প খুব বেশি দূর আগায় না। তো মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য আমরা আসলে উভয় দেশের সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষক, গবেষক তাদের মধ্য একটা যোগাযোগের সেতুবন্ধন করতে পারি। সেই ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে যোগাযোগও বৃদ্ধি পাবে এবং পারস্পরিক আস্থার গভীরতা বাড়বে। (টুটুল)