চীনের সবচেয়ে কম বয়সী 'ব্যাকপ্যাকার' ওয়েন ওয়েন
  2017-04-12 12:59:43  cri

 



একটি আলোকচিত্র। গত জুনে আলোকচিত্রটি চীনের ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যায়। আলোকচিত্রটিতে স্থান পেয়েছে কালো ত্বক ও ছোটো করে ছাঁটা চুলের একটি ৪ বছর বয়সী মেয়ের ছবি। মেয়েটির পিঠে বড়সড় একটি ব্যাকপ্যাক। আর তার হাতে একটি বোর্ডে লেখা: 'হিচহাইকিং'।

চিয়াং সি প্রদেশের সাং রাও শহরের বাসিন্দা ওয়েন ওয়েন। সে তার বাবা-মার সঙ্গে ইতোমধ্যেই অর্ধেক চীন ঘুরে বেড়িয়েছে। ওয়েন ওয়েনের বাবার শিক্ষাসম্পর্কিত ধারণা প্রচলিত ধারণার চেয়ে ভিন্ন। তিনি তার প্রিয় কন্যাকে স্কুলে না-দিয়ে, ভ্রমণের মাধ্যমে তাকে হাতেকলমে শেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার এ ধারণা চীনে বেশ একটা হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে।

কিছুদিন আগে, গত ৬ এপ্রিল, ওয়েন ওয়েনের বাবা ভান থু ফেং মেয়েকে নিয়ে আসেন সি ছুয়ান প্রদেশের রাজধানী ছেং তু শহরে। সেখান থেকে তাদের লাওসে যাবার কথা। লাওসে তারা আদিম বন অতিক্রম করবে, মোটামুটি এই হচ্ছে পরিকল্পনা। এবার ওয়েন ওয়েনের বড় ভাই, ভান থু ফেংয়ের ছেলে পাই রুও তাদের সঙ্গী। প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র পাই রু। এবার ভ্রমণের জন্য সে স্কুলে দু'মাসের ছুটির আবেদন করে।

ভান থু ফেং জানালেন, তিনি তার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে চীনের 'মৃত্যু সাগর' Lop Nur-এ যাবেন।

প্রাচীনকাল থেকে চীনে এমন একটি কথা প্রচলিত: ১০ হাজার বই পড়ার চেয়ে ১০ হাজার মাইল ভ্রমণ করা বেশি ভালো। ওয়েন ওয়েনের বাবা-মা কি এ কথায় প্র্রভাবিত হয়েছেন? তাদের সিদ্ধান্ত কি সঠিক? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সম্প্রতি আমাদের সাংবাদিক গিয়েছিলেন ছেন তুতে; কথা বলেছেন ওয়েন ওয়েন ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

 

ওয়েন ওয়েন তখন হোটেলের সামনে বড় ভাইয়ের সঙ্গে খেলছিল। সাংবাদিক দেখলেন, গোলাপী স্কার্ট পরা ওয়েন ওয়েনের চুল আগের চেয়ে একটু লম্বা হয়েছে। ভান থু ফাং জানালেন, এবারও ভ্রমণে যাওয়ার আগে তিনি মেয়ের চুল ছোটো করে ছাটতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওয়েন ওয়েন রাজি হয়নি।

গত জুলাই মাসে পরিবারটি সিছুয়ান-তিব্বত হাইকিং শেষ করে এবং লাসাতে হঠাত্ করেই ভান থু ফেং ও তার স্ত্রী নেপালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নেপালে ওয়েন ওয়েন হিমালয়ের কাছে হাঁটাহাঁটি করে; অংশ নেয় প্যারাগ্লাইডিংয়েও। ভান থু ফেং বলেন, অন্য শিশুরা যখন শুধু বই বা টিভির মাধ্যমে হিমালয় পাহাড় দেখছে, তখন ওয়েন ওয়েন নিজ চোখে সেটি দেখলো এবং নিজের পায়ে হিমালয়ের পাদদেশে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করলো। বই পড়ে জানা আর নিজের চোখে দেখার মধ্যে পার্থক্য নিশ্চয়ই অনেক!

আসলে এ অভিজ্ঞতার ব্যাপারে ওয়েন ওয়েন তেমন একটা সচেতন নয়। সে জানে না নেপাল ঠিক কোথায় অবস্থিত। তবে যখন প্যারাগ্লাইডিংয়ের কথা উঠলো, তখন তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

অনেকে বলেন, ওয়েন ওয়েন অনেক ছোট। তাই এ ধরনের ভ্রমণ তার ছোট মনে তেমন একটা ছাপ বা প্রভাব ফেলবে না। তবে ভান থু ফেং তা মনে করেন না। তিনি মনে করেন, শিশুরাও সুন্দর সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করে এবং তাদের মনের ওপর এর দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ও ইতিবাচক প্রভাব পরে। তা ছাড়া, কঠিন ও ক্লান্তিকর ভ্রমণ তাদের বিরূপ পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

ওয়েন ওয়েনের মা'ও মনে করেন, গেল বছরের ভ্রমণ তার মেয়ের মধ্যে পরিবর্তন এনেছে। তার শরীর এখন আগের চেয়ে শক্ত ও ভালো। এখন যে আগের মতো ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে কান্নাকাটি করে না।

গেল ১০ মাসের অধিকাংশ সময়ই ভ্রমণ করেছে ওয়েন ওয়েন। তাদের বাড়িতে ছিল টিভি ও কম্পিউটার নেই। বাড়ির পাশে একটি পাথরের গাদা ওয়েন ওয়েন ও তার বড় ভাইয়ের 'বিনোদন পার্ক'। পাথরের গাদার ওপর ওঠা এবং সেখান থেকে নামা ওয়েন ওয়েনের প্রিয় খেলা। ভান থু ফেং তার কন্যাকে এ কাজে বাধা দেন না। তবে, তিনি পাথরগুলোকে চেক করে নিয়েছেন এবং যখন নিশ্চিত হয়েছেন যে, এখানে খেললে তার ছেলেমেয়েরা কোনো বিপদে পড়বে না, তখনই তিনি তাদের সেখানে খেলার অনুমতি দিয়েছেন। তিনি মনে করে, এই খেলা তাদের পাহাড়ে আরোহণ-ক্ষমতা বাড়াবে।

একবার ওয়েন ওয়েন ও পাই রু ঝলসানো মিষ্টি আলু খেতে চাইলো। ভান থু ফেং তাদেরকে বললেন, নিজেরা মিষ্টি আলু ঝলসে খাও। তখন দুই ভাইবোন পাহাড় থেকে গাছের শুকনো ঢাল সংগ্রহ করে আনলো এবং আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনে মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে খেলো। ভান থু ফেং বলেন, প্রথমবার তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু কয়েকবারের চেষ্টায় ঠিকই বাচ্চারা কাজটা করতে পেরেছে। এ অভিজ্ঞতা তাদের বন-জঙ্গলে টিকে থাকতে সাহায্য করবে।

চীনে সবচেয়ে কমবয়সী 'ব্যাকপ্যাকার' হিসেবে ওয়েন ওয়েন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে, তাদেরকে ভান থু ফেং যেভাবে শিক্ষা দিচ্ছেন, তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এপ্রিল মাসে যখন অন্যান্য ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, তখন তার দুই সন্তান থাকে স্কুলে বাইরে। ব্যাপারটা অনেকেই স্বাভাবিক বা যৌক্তিক মনে করেন না।

স্কুল থেকে ভান থুন ফেংয়ের ছেলে প্রায়ই ছুটি নেয়। স্কুলের বিগত চূড়ান্ত পরীক্ষায়ও সে অংশ নেয়নি। গত মাসে ছেলেটা চীনা ভাষা পরীক্ষায় খারাপ করেছে। কিন্তু এতে ভান থু ফেং মোটেই চিন্তিত নন। তিনি জানালেন, প্রথম বছরের তুলনায় তার ছেলে ভালো করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে। কারণ যে জ্ঞান ও তথ্য বইতে লেখা থাকে, তা সবই জীবন ও প্রকৃতি থেকেই আসে। তার ছেলেমেয়েরা বই থেকে নয়, বরং জীবন ও প্রকৃতি থেকে সরাসরি শিখছে। এই শিক্ষা অনেক বেশি কার্যকর।

ভান থু ফেং তার দুই শিশুকে আতশি কাচ দিয়ে আগুন জ্বালানো শিখিয়েছেন; শিখিয়েছেন কীভাবে সূর্য ও ছায়ার মাধ্যমে সময় বোঝা যায়। অথচ এ শিক্ষা তাদের পাঠ্যপুস্তকে ছিল না।

ভান থু ফেং স্বীকার করেন, প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা থাকে। তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। ওয়েন ওয়েনের বয়স যখন এক বছর, তখন থেকেই তিনি তাকে নিয়ে চীনের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করা শুরু করেন। ভ্রমণের জন্য সাধারণত তারা বেছে নেন দূরবর্তী জায়গা। তাদের বাড়িতে একটি ম্যাপ আছে। কোনো স্থানে ভ্রমণে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি ম্যাপের নির্দিষ্ট জায়গায় একটা লাল চিহ্ন এঁকে দেন। ম্যাপে সিন চিয়াং দক্ষিণ-পূর্বের Lop Nur-এও লাল কালি দিয়ে চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। এটা তাদের পরবর্তী গন্তব্য।

মালভূমি, সমুদ্র সব দেখেছে শিশুরা। এখন ভান থু ফেং তাদেরকে দেখাতে চান মরুভূমি।

ওয়েন ওয়েনকে নিয়ে ইতোমধ্যেই কয়েকটি টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন ভান থু ফেং। কেউ কেউ বলেন, ভান থু ফেং নিজের মেয়েকে ব্যবহার করে নিজেকে জনপ্রিয় করে তুলতে চান।

এ ব্যাপারে ভান থু ফেং বলেন, একাধিক কোম্পানি ওয়েন ওয়েনকে বিজ্ঞাপনে কাজে লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সেসব প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার পরিবার অনলাইনে মধু বিক্রি করে। এটাই তাদের আয়ের উত্স। তবে তিনি স্বীকার করেন, ওয়েন ওয়েন বিখ্যাত হয়ে যাবার পর তাদের ব্যবসা আগের চেয়ে চাঙ্গা হয়েছে।

ভান থু ফেং সাক্ষাত্কার দিতে অস্বীকার করেন না। মাঝে মাঝে তিনি উইচ্যাটে নিজের মেয়েসম্পর্কিত প্রবন্ধ বা খবরাখবর শেয়ার করেন। ভান থু ফেং বলেন, 'আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সবাইকে বলতে চাই, আমাদের শিশুদের মধ্যে অফুরন্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। তারা অনেককিছুই করতে পারে, যদি আমরা তাদের তা করার সুযোগ করে দিই।' (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040