সুর ও বাণী: 'সংগীত কবি' লি চিয়ান
  2017-04-05 14:58:36  cri


বন্ধুরা, প্রথমে শুনুন 'বৈকাল হ্রদের তীরে' নামের গান। ২০১১ সালে লি চিয়ান রাশিয়ার ইরকুতস্ক্‌ শহরে বেড়াতে যান। সেখানে বৈকাল হ্রদের সুন্দর দৃশ্য তাকে মুগ্ধ করে। মাত্র সাত লাখ মানুষের ছোট এ শহরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবন রয়েছে। গির্জায় নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। তাদের অর্থনীতি অনুন্নত। তবে সেখানকার অধিবাসীদের আধ্যাত্মিক জীবন বৈচিত্র্যপূর্ণ। সবাই যেন সংস্কৃতির অনুরাগী! যা এক অভাবনীয় ব্যাপার। এসব দেখে লি চিয়ান 'বৈকাল হ্রদের তীরে' গানটি রচনা করেন। এ গানটি শ্রোতাদের সরল শান্ত ও মনোরম এক ভূমিতে নিয়ে যায়। বাহিরের কোলাহল মনের গভীরের শান্তিকে ছুঁতে পারে না। লি চিয়ানের শান্ত কণ্ঠস্বরে যেনো নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। বন্ধুরা, শুনুন 'বৈকাল হ্রদের তীরে' গানটি।

লি চিয়ান

'বৈকাল হ্রদের তীরে' গানটি ২০১৪ সালের 'স্বর্ণ গানের' পুরস্কার লাভ করে। এ গানটি শুনে আপনিও একটি হ্রদকে ভালোবাসবেন। গানটির কথা ও সুর করেছেন লি চিয়ান। গানের কথাগুলো এমন,

'আমার কোলে, তোমার চোখে, সেখানকার বসন্ত বাতাস ও সবুজ ঘাস চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। চন্দ্রালোকের প্রেমে ভরে গেছে হ্রদ। দু'জনের প্রেমে উজ্জ্বল এ প্রেমময় রাত! এ জীবনে কত প্রেমিক, এমন চন্দ্ররাতে হারিয়েছে! এমন দিন আবার ফিরে আসুক! যখন বৈকাল হ্রদের তীর থেকে চলে যাবার কথা ভুলে যাবো। বন্ধুরা, শুনুন থান চিং ও তাসখানের গাওয়া 'বৈকাল হ্রদের তীরে' গানটি।

লি চিয়ান ১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হেইলোংচিয়াং প্রদেশের হার্বিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুত প্রকৌশল বিভাগ থেকে পাশ করেন। তবে তিনি কখনো বিদ্যুত সম্পর্কিত চাকরি করেননি। ছাত্র জীবন থেকেই সংগীত ছিলো তার সঙ্গী। বাজারের চাহিদা, গণমাধ্যমের মূল্যায়ন যাই হোক না কেন, লি চিয়ানকে তা ছুঁতে পারেনি। তিনি সবসময় নিজের মতো থেকেছেন। তিনি নিজের মনের আনন্দে গান লিখেন, সুর করেন এবং গানে কণ্ঠ দেন।

বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন ওয়াং ফেইয়ের গাওয়া 'কিংবদন্তি' নামের গান। এ গানটির কথা লিখেছেন লিউ পিং, সুর করেছেন লি চিয়ান। ২০১০ সালে চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন কেন্দ্রের বসন্ত উত্সবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওয়াং ফেই এ গান গেয়েছেন। সে বছর এ গানটি চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন কেন্দ্র এবং সংগীত টেলিভিশনের যৌথ আয়োজনের সংগীতানুষ্ঠানে 'বার্ষিক সবচেয়ে জনপ্রিয় স্বর্ণ গান' হিসেবে নির্বাচিত হয়।

২০০২ সালের শীতকালে বেইজিংয়ে ঠান্ডা ঘরে বসে অনেক চলচ্চিত্র দেখেন এবং বই পড়েন লি চিয়ান। অস্ট্রিয়ার লেখক স্টেফান জভিগের উপন্যাস 'এক অপরিচিত নারীর চিঠি' তার মনে গভীর দাগ কেটেছে। তিনি মনে করেন, উপন্যাসের ওই নারী চরিত্র যুগে যুগে পুরুষের জীবনে কিংবদন্তির মতো। এরপর তিনি এমন একটি গানে সুরারোপ করেন। আসলে এ গান রচনার সময় লি চিয়ান তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছিলেন। বেইজিংয়ে শীতকালে তাপমাত্রা শূন্যের দশ/বারো ঘর নিচে নেমে যায়। গরম ব্যবস্থা ছাড়া ঘরে থাকা খুব কষ্টকর! তখন লি চিয়ানের বাসায় ঘর গরমের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। কিন্তু তার রচিত গানে আমরা কষ্টের কোনো ছাপ দেখি না। তিনি প্রেমের প্রশংসা করেন। 'কিংবদন্তি' গানটি কিছুটা অসাধারণ, স্পষ্ট আবেগ বোঝা যায় না, মনে হয় একজন চুপি চুপি নিজের মনের কথা বলছে। কথাগুলো এমন,

'জনারণ্যে তোমাকে শুধু একবার দেখেছি, তোমার মুখ আর ভুলতে পারিনি। ভাবছি, আবারো একদিন তোমার দেখা পাবো। তুমি রয়েছো আমার মনে। কখনো চোখের সামনে, কখনোবা আকাশের সীমানায়, কখনো মনের গহীনে! আমি বিশ্বাস করি, আগের জীবনে আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাই এ জীবনেও আমাদের প্রেম রবে। আমি সারা জীবন তোমার অপেক্ষায় থাকতে চাই। একদিন তুমি বুঝবে, সবসময় আমি তোমার পাশে ছিলাম, কখনো যাইনি দূরে। ' বন্ধুরা, শুনুন লি চিয়ানের কণ্ঠে 'কিংবদন্তি' গানটি।

সুই মু নিয়ান হুয়া

২০০১ সালে লি চিয়ান এবং লু গেং সুই  'সুই মু নিয়ান হুয়া' নামে সংগীত ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। তারা দু'জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সংগীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা থাকায় তারা একসাথে সংগীত জগতে প্রবেশ করেন এবং জনপ্রিয়তা পান। লি চিয়ানের কণ্ঠস্বর শান্ত ও কিছুটা বিষণ্ণ। অন্যদিকে লু গেং সুই'র কণ্ঠস্বর উদ্যম ও কিছুটা কর্কশ। তাদের গান শুনে অতীতের স্মৃতি ভেসে ওঠে। তাদের অ্যালবাম বাজারে মুক্তির পর রাতারাতি জনপ্রিয়তা পায়। সে বছর তারা চীনা সংগীত জগতের প্রায় সব পুরস্কার পান। বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন তাদের গাওয়া 'সারা জীবন তুমি আছো' নামের গান। এ গানটি আয়ারল্যান্ডের কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের কবিতা 'যখন তুমি বৃদ্ধ হবে' থেকে তৈরি করা হয়েছে।

'সুই মু নিয়ান হুয়া' ব্যান্ড জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর লি চিয়ান ও তার অংশীদার লু গেং সুইয়ের মধ্যে সংগীত ধারণা নিয়ে মতভেদ তৈরি হয়। লি চিয়ান নিজের সংগীত স্বপ্ন নিয়ে জিদ করেন এবং সুই মু নিয়ান হুয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তার বন্ধুরা বলেন, 'লি চিয়ান এক অসাধারণ ব্যক্তি। এ পৃথিবীর সঙ্গে তার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি কেবল নিজের পছন্দের ওপর মনোযোগ দেন। তার পছন্দের বিষয়ে অন্যের আগ্রহ বা বাণিজ্যিক মূল্য আছে কিনা, তা তিনি কখনো ভাবেন না। তার একটি নিজস্ব পৃথিবী আছে। তার কল্পনার সে বিশ্ব বাস্তব জগতের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ। আর সে কথা শুধু তিনি নিজেই জানেন।

২০১৫ সালে লি চিয়ান হুনান টেলিভিশন কেন্দ্রের 'আমি গায়ক' নামের গান প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার পর আবার সারা চীনের দর্শকদের সামনে হাজির হন। এ প্রতিযোগিতায় তিনি নিজের গান গাওয়ার পাশাপাশি অন্য শিল্পীর গানও গেয়েছেন। তার পরিষ্কার ও শান্ত কণ্ঠস্বর সব দর্শককে মুগ্ধ করে। বন্ধুরা, শুনুন দক্ষিণ কোরিয়ার রোমান্টিক চলচ্চিত্র 'দ্য ক্লাসিক'-এর থিম সং থেকে লি চিয়ানের রূপান্তরিত চীনা ভাষার গান।

লি চিয়ান

'আমি গায়ক' গান প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সাধারণ দর্শক ও শ্রোতারা বেশ ভালোভাবে লি চিয়ানকে জানতে পেরেছেন। এর আগে শুধু সংগীত জগতের পেশাগত শিল্পী ও অল্প কিছু শ্রোতা তার অনুরাগী ছিলেন। এর পর তিনি চীনে ব্যাপক সমাদর পান। তিনি বলেন, 'গায়ক মঞ্চে আমি নিজের মতো ভিন্ন ধরনের গান পরিবেশন করতে চাই, হালকা ও নরম আবেগ প্রকাশ করতে চাই।' তাকে 'বাজার অর্থনীতি উত্থানের যুগে একজন সংগীত কবি' বলা হয়।

লি চিয়ান বহুবার বলেছেন, তিনি বেশি ফুল ও করতালি চান না। গেল বছরগুলোতে তিনি সংগীত জগতের অনেক বন্ধুদের দেখেছেন যে, তারা অনেকে বেশ বিখ্যাত হলেও তাদের মনে আনন্দ নেই। কিন্তু লি চিয়ানের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। তাকে দেখে মনে হয়, সময় তার ওপর এসে থেমে গেছে। তাকে দেখে সঠিক বয়স বোঝা যায় না। তিনি মনে করেন, এর মূল কারণ হলো, অনেকে নিজের মনের প্রকৃত আওয়াজ শোনেন না। নিজে কীভাবে জীবন কাটতে চান, তা জানেন না। অথচ সামাজিক চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের চাহিদাকে চেপে রাখেন। দীর্ঘদিন ধরে মুখোশ পড়ে থাকলে মনে সমস্যা তৈরি হবে। লি চিয়ান বলেন, বহির্বিশ্বের ঝামেলা আমার মনের শান্তি নষ্ট করতে পারে না। কোনো একদিন যদি আমি ক্লান্ত হয়ে যাই, তাহলে চুপচাপ চলে যাবো। কোনো কথা বলবো না।

বন্ধুরা, আজ চীনের সংগীত কবি লি চিয়ানের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। তার কয়েকটি গানও আপনারা শুনলেন। তার জীবনের কথাগুলো ভেবে দেখুন, কোনো শক্তি পান কি? 'সুর ও বাণী' আসর আজকের মতো এখানে শেষ করছি। ভালো থাকুন সবাই। আবার কথা হবে।

(ইয়ু/তৌহিদ)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040