ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে পূর্ব আফ্রিকায় রেলওয়ে নির্মিত হওয়ার পর, পাশ্চাত্যের পর্যটকরা কেনিয়ায় এসে বন্য পশু শিকার করা শুরু করে। এ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেনিয়ার তত্কালীন সরকার দেশটিতে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে বন্য পশু রক্ষা এলাকা নির্মাণ করে। ১৯৪৬ সালে কেনিয়ার প্রথম জাতীয়পার্ক 'নাইরোবি জাতীয় পার্ক' নির্মিত হয়। ১৯৯০ সালে কেনিয়া 'বন্য পশু পরিচালনা ব্যুরো' প্রতিষ্ঠা করে। এই ব্যুরোর কাজ বিশেষ করে জাতীয় পার্ক ও সুরক্ষিত এলাকাগুলোর দেখভাল করা।
এ পর্যন্ত কেনিয়ায় ২৩টি জাতীয় পার্ক, ৩১টি প্রাকৃতিক সুরক্ষা এলাকা ও ৪টি সমুদ্রপার্ক নির্মিত হয়েছে। এসব পার্ক ও এলাকার আয়তন কেনিয়ার মোট ভূখন্ডের ৮ শতাংশ। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি জাতীয় পার্ক ব্যবস্থাপনা করে এবং স্থানীয় সরকার সুরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনা করে। জাতীয়পার্কের সুরক্ষা কঠিন ব্যাপার। বন্য পশু পরিচালনা ব্যুরোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এডিন কালা বলেন, 'কেনিয়ায় জাতীয় পার্ক ও জাতীয় পরিবেশ সুরক্ষা এলাকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি জাতীয় পার্ক পরিচালনা করে এবং সুরক্ষিত প্রাকৃতিক এলাকা স্থানীয় সরকার পরিচালনা করে। জাতীয় পার্কে পর্যটন ও গবেষণা ছাড়া যে-কোনো তত্পরতা নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রাকৃতিক সুরক্ষিত এলাকায় মাছ ধরা ও ক্যাম্প করা যেতে পারে।'
কেনিয়ার অর্থনীতি অনুন্নত। তাহলে দেশটি কিভাবে এত বেশি জাতীয় পার্ক ও সুরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনা করে? এডিন বলেন, পার্কের টিকিট হল অর্থের প্রধান উত্স। অবশ্যই অন্য উত্স আছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় সরকার মূলত পেশাদার কর্মী প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে। কিন্তু আমাদের আয়ের মূল উত্স পার্কের টিকিট। পাশাপাশি পার্কগুলোতে অবস্থিত হোটেল থেকেও অর্থ আসে। এসব হোটেলের সাথে আমাদের চুক্তি আছে। হোটেলগুলো নিয়মিতভাবে আমাদেরকে কর দেয়। কিন্তু বন্য পশু পরিচালনা ব্যুরো এসব অর্থ সংগ্রহ করে প্রতিটি পার্কের বাজেট অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করে।'
পর্যটন উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বাণিজ্যিক স্বার্থ সৃষ্টি হয়। কিন্তু কেনিয়া প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য সুরক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এ সম্পর্কে এডিন বলেন, 'আমরা জাতীয় পার্ক ও পার্কের পরিবেশগত বৈচিত্র্যের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। পর্যটন উন্নয়নের অবস্থান এর পরে। পরিবেশ ও বন্য পশু সুরক্ষা হল আমাদের লক্ষ্য। যেমন, আমরা জাতীয় পার্কে মাত্র দুই বা তিনটি হোটেল নির্মাণের অনুমতি দেই।'
এখানকার নিয়মকানুনও কড়া। এ নিয়ম যেমন পর্যটকদের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য পার্কের কর্মী ও কর্মকর্তাদের জন্যও। এ সম্পর্কে এডিন বলেন, 'আমাদের সংশ্লিষ্ট আইন ও নিয়ম আছে। পার্কে পর্যটকদের বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলতে হয়। পার্কে গাড়ি থেকে নামা নিষিদ্ধ। কারণ, আপনি জানেন না গাছের পেছনে কী আছে। আপনি হিংস্র প্রাণির আক্রমণের শিকার হতে পারেন। যদি কোন গাড়ি নির্ধারিত পথে না-যায়, তবে পরবর্তী দু'বছরের জন্য লাইসেন্স হারাবে।'
পরিচালনা ব্যুরোর আরেকটি কাজ হচ্ছে স্থানীয় নাগরিকদের সাথে বন্য পশু সুরক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। এ সম্পর্কে এডিন বলেন, 'নাইরোবি জাতীয় পার্ক বিশ্বের একমাত্র জাতীয় পার্ক যা দেশের রাজধানীতে অবস্থিত। পার্কের কাছাকাছি অঞ্চলে বাসিন্দাদের সংখ্যা বেড়েছে। এ ছাড়া, পার্কের দক্ষিণ দিকটা খোলা। বৃষ্টির সময় পশুগুলো পার্কের বাইরে চলে যায়। কিন্তু পানির স্বল্পতা দেখা দিলে পশুগুলো পার্কে ফিরে আসে। এর মাধ্যমে একটি ক্ষুদ্র মাইগ্রেশন হয়। তৃণভোজী পশু বাইরে যাওয়া মানে সেগুলোর পিছনে পিছনে মাংসাসী পশুরও বাইরে যাওয়া। এ সমস্যা সমাধানে আমরা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি, যা সিংহ বা বাঘের আক্রমণ থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের বাঁচানো যায়।'
স্থানীয় নাগরিকরা এখন বন্য পশু সুরক্ষার গুরুত্ব বোঝে। কারণ, পরিচালনা ব্যুরো বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের জাতীয় পার্ক ও সুরক্ষিত এলাকাসম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এডিন বলেন, 'আমরা কেনিয়া বন্য পশু পরিচালনা ব্যুরো দেশের বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। শিক্ষার্থীরা সামান্য অর্থ ব্যয় করে জাতীয় পার্ক পরিদর্শন করতে পারে। এ ছাড়া, আমরা নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার ওপর প্রশিক্ষণ দেই।'
কেনিয়ার মানুষ বলেন, ঈশ্বরের আশীর্বাদে তাঁরা আফ্রিকার প্রায় সকল ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও সমৃদ্ধ বন্য পশুসম্পদের অধিকারী। তাঁরা তাই এ দানকে রক্ষায় আন্তরিক। জাতীয় পার্কব্যবস্থা তারই একটা নমুনা।