সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ানো যায়। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে মৈত্রী আরো জোরদার করে। চীনের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় আছে বিগত দুই হাজার বছর ধরে। আর বর্তমানে 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশল এবং 'বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর'-এর আওতায় চীনের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অর্থনৈতিক যোগাযোগের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো সময় সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত ইউন নান প্রদেশ সাংস্কৃতিক শিল্প উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে অনেক সাফল্য লাভ করেছে। ইউননান সাংস্কৃতিক শিল্প কোম্পানি হল একটি সরকারি পর্যটন ও সংস্কৃতি কোম্পানি। কোম্পানিটির জেনারেল ম্যানেজারের সহকারী ইয়াং চিনসং হলেন চীনের জাতীয় কংগ্রসের (এনপিসি) একজন সদস্য। তিনি দ্বাদশ এনপিসির পঞ্চম অধিবেশনে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন ইউন নান প্রদেশকে সাংস্কৃতিক শিল্পে অনেক সহায়তা দিচ্ছে। তাঁর কোম্পানি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এ সহযোগিতার আওতায় কোম্পানিটি কোনো কোনো দেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিশেষ করে প্রতি বছরের বসন্ত উত্সবে এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় মানুষ আরো ভালভাবে চীনা সংস্কৃতিকে জানতে পারে। আর কোম্পানিটি অন্য দেশের সাংস্কৃতিক পণ্য চীনে আমদানি করে। এতে চীনের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়। এতে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়।
তিনি আরও বলেন, এখন দক্ষিণ এশিয়ার কোনো কোনো দেশ তাঁদের সাথে সংস্কৃতি ও পর্যটন খাতে সহযোগিতা করতে চায়। তিনি আশা করেন, সাংস্কৃতিক শিল্প ও সাংস্কৃতিক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ইউননান প্রদেশকে আরো বেশি সমর্থন করা হবে। তিনি বলেন, 'আমি আশা করি, কেন্দ্রীয় সরকার সংস্কৃতি প্রচার ও সাংস্কৃতিক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো বেশি সমর্থন দেবে। আমাদের বর্তমান পরিকল্পনাও ভবিষ্যতে আরো উন্নত হবে। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, প্রকাশনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাওয়া হবে। আমি আশা করি, ইউননান প্রদেশের সংস্কৃতি বিদেশে প্রচারের পরিকল্পনা দেশের সার্বিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আশা করি, কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকারের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করবে, যাতে আমাদের সাংস্কৃতিক শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরো সুবিধাজনক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়।'
তিনি সাংস্কৃতিক শিল্পে কাঠামোমূলক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
যোগাযোগের লক্ষ্য হল পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ানো। আবার বোঝাপড়া বাড়লে যোগাযোগও বাড়ে। চীনের সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগ ক্রমশ বাড়ছে। চীন প্রকাশনা এসোসিয়েশন বিশেষ করে চীন-দক্ষিণ এশিয়া সাংস্কৃতিক সহযোগিতা প্রকাশনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এসোসিয়েশনটির স্থায়ী উপপরিচালক সিয়ে আইওয়েই বলেন, 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশর উত্থাপনের পর চীনের সাথে সহযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রকাশনা মহলের আগ্রহ বেড়েছে। তাঁরা চীনের বই তাঁদের ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ ও বিক্রী করতে চায়। তাঁরা আশা করে, এর জন্য একটি সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে এবং একটি কমন প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় প্রচারণা বিভাগ ও জাতীয় তথ্য, প্রকাশনা, বেতার ও টেলিভিশন ব্যুরোর অনুমোদনে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে চীনের প্রকাশনা এসোসিয়েশন ও ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রেস যৌথভাবে চীন-দক্ষিণ এশিয়া সাংস্কৃতিক সহযোগিতা প্রকাশনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। এ সম্পর্কে সিয়ে আইওয়েই বলেন, 'চীনের পাঁচ শতাধিক প্রকাশনালয় বিদেশে সাংস্কৃতিক পণ্য রফতানি খাতে অবদান রাখছে। চীন-দক্ষিণ এশিয়া সাংস্কৃতিক সহযোগিতা প্রকাশনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হল, দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতা, অভিন্ন কল্যাণ, পারস্পরিক যোগাযোগ ও মৈত্রী বৃদ্ধির একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করা। আমরা এমন একটি পদ্ধতি খুঁজছি, যে পদ্ধতিতে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো যায়। সাংস্কৃতিক সহযোগিতার আওতা বাড়ানো উচিত।'
(সিয়ে আই ওয়েই'র সাথে সাক্ষাত্কার নেয় মুক্তা)
সাংস্কৃতিক যোগাযোগের পদ্ধতি বহুমুখী। বই সাংস্কৃতিক যোগাযোগের স্থায়ী মাধ্যম। চীনের ইয়ানশি প্রকাশনালয়ের উপ সম্পাদক ফেং চাং বলেন, চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বই আমদানি-রফতানির মাধ্যমে পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও বাড়াতে পারে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "সাংস্কৃতিক যোগাযোগ 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বই হল এক ধরনের পদ্ধতি। প্রকাশনা মহলের উচিত আরো ব্যাপক ভূমিকা পালন করা। বই আমদানির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ আরো ভালভাবে আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারেন; আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারেন। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাই।'
ফেং চাং ও ইয়াং চিনসং আশা করেন, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সরকারের সমর্থন বৃদ্ধি পাবে। আসলে কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে সচেতন আছে। জাতীয় তথ্য, প্রকাশনা, বেতার ও টেলিভিশন ব্যুরোর আমদানি পরিচালনা বিভাগের উপপরিচালক চাও হাইইউন বলেন, সরকার বই'র মাধ্যমে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ জোরদার করার বিষয়টি সমর্থন করে। চাও হাইইউন বলেন, "দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো 'এক অঞ্চল, এক পথ'-সংশ্লিষ্ট। আর চীন সরকার যে 'রেশমপথ বই প্রকাশনা পরিকল্পনা' গ্রহণ করেছে, সেটি একটি খোলা প্ল্যাটফর্ম। এ পরিকল্পনার আওতায়, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আয়োজিত বিভিন্ন বই মেলায় অংশ নেবে এবং সেসব দেশের ভাষার ওপর গুরুত্ব দেবে। চীনা বইয়ের ডিজিটাল প্রকাশনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে।'
(কিশোর বিশ্বাস)
বাংলাদেশের কিশোর বিশ্বাস বেইজিং ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টাডিজ একাডিমি'র 'এক অঞ্চল, এক পথ' পরিকল্পনার একজন বাংলা ভাষা শিক্ষক। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সাথে চীনের যোগাযোগ প্রাচীনকালে ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু কয়েক দশক আগে সে সম্পর্কে ভাটা পড়ে। চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশল দু'পক্ষকে আবারও কাছাকাছি এনে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা, পর্যটন, রাজনৈতিক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দু'পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তিনি বলেন, 'মানুষ ও সমাজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম রয়েছে। ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজের সমস্যায় বিভিন্ন পক্ষ রয়েছে। এ পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া সৃষ্টি সহজ কাজ নয়। কিন্তু মৈত্রী ও সম্পর্কের উন্নয়নকে একটি অভিন্ন বিষয় ধরা উচিত। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ হল একটি সাগ্রহে গৃহীত পদ্ধতি। সেজন্য সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যমে দু'টি দেশ ও অঞ্চলের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হবে।'
চীনের সামাজিক বিজ্ঞান একাডেমির দক্ষিণ এশিয়া গবেষণালয়ের বিশেষজ্ঞ লিউ চিয়ান বলেন, বিগত কয়েক বছরে চীন দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ ও সহযোগিতা ছাড়াও, জনগণ পর্যাযের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতর করেছে; শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পর্যায়ে যোগাযোগ বেড়েছে। চীনের শিক্ষকরা স্থানীয় কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটগুলোতে চীনা ভাষা শেখাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, চীনের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগ একটি বড় কাজ। তাই দু'পক্ষে মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের জন্য একটি স্থায়ী পরিকল্পনা থাকা উচিত। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "এখন অর্থনীতির বিশ্বায়ন হচ্ছে। চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশলের ফলে চীন-দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্ক দিন দিন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে। এ সময় সাংস্কৃতিক যোগাযোগ আরো গুরুত্বপূর্ণ।'