20170305yinyue.mp3
|
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি আনন্দী বেইজিং থেকে আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজকের 'সুর ও বাণী' আসরে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো চীনের সুরকার লিউ ছি মিংয়ের সঙ্গে; শোনাবো তার সৃষ্টি কিছু সুর ও গান।
লিউ ছি মিং
বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'লাল পতাকার প্রশংসা' নামের সুর। ১৯৬৫ সালে ৩৫ বছর বয়স্ক লিউ ছি মিং ষষ্ঠ 'শাংহাইয়ের বসন্ত' শীর্ষক সংগীতানুষ্ঠানের উদ্বোধনী সুর রচনা করেন। এটি ছিল চীনে লাল পতাকা নিয়ে রচিত প্রথম যন্ত্রসঙ্গীতের কাজ। এ সুরারোপের সময় সুরকারের চোখে ভেসে ওঠে জ্বলন্ত গ্রাম, যুদ্ধক্ষেত্রের ধোঁয়া, শত্রুদের সঙ্গে লড়াইরত সাহসী সেনা, থিয়েন-আন-মেন মহাচত্বরে উত্তোলিত পাঁচ তারকা খচিতো লাল পতাকা। এসব ভেবে তিনি ব্যাপক অনুপ্রেরণা পান। এক সপ্তাহ পর তিনি 'লাল পতাকার প্রশংসা' নামের যন্ত্রসংগীত তৈরি করেন। এ সুর ষষ্ঠ 'শাংহাইয়ের বসন্ত' উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাজানোর পর তা অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখন পর্যন্ত প্রায়শই চলচ্চিত্র, টেলিভিশন নাটক ও সংগীতানুষ্ঠানে এ সুর ব্যবহৃত হয়। বন্ধুরা, উপভোগ করুন 'লাল পতাকার প্রশংসা' নামের সুর।
বন্ধুরা, এতক্ষণ আপনারা চীনের সুরকার লিউ ছি মিংয়ের সৃষ্ট 'লাল পতাকার প্রশংসা' নামের সুর শুনলেন। এটি তার সবচেয়ে বিখ্যাত সংগীত কর্ম।
লিউ ছি মিং চীনের শ্রেষ্ঠ সিমফনি সুরকার এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র সংগীতের সুরকার। যন্ত্রসংগীত 'লাল পতাকার প্রশংসা' আর সিমফনি কবিতা 'নোর্মান বেথুন'সহ নানা মাস্টারপিস সিমফনি সৃষ্টি করে চীনের সংগীত ইতিহাসে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছেন তিনি।
বন্ধুরা, এবার শুনুন 'ওয়েই শা হ্রদ' নামের গান। এ গানটি টেলিভিশন নাটক 'রেলওয়ে গেরিলা'তে ব্যবহৃত হয়েছে। লিউ ছি মিং এ টিভি নাটকের সবগুলো সুর তৈরি করেছেন।
লিউ ছি মিং
লিউ ছি মিং ১৯৩০ সালের মে মাসে আনহুই প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দশ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে 'নতুন চতুর্থ বাহিনী'তে যোগ দেন। তার বাবা লিউ হুই শেং জাপানি আগ্রাসন বিরোধী যুদ্ধে লড়াই করে দেশের জন্য প্রাণ উত্সর্গ করেন। লিউ ছি মিং ১৯৪৫ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। যুদ্ধকালে তিনি সামরিক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক দলের সদস্য ছিলেন। গণপ্রজাতন্ত্র চীন প্রতিষ্ঠার পর তিনি বেইজিং ফিল্ম স্টুডিওতে যোগ দিয়ে চলচ্চিত্রের জন্য সুর তৈরির কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি শাংহাই সংগীত ইনস্টিটিউটের কম্পোজার ও পরিচালনা বিভাগ থেকে স্নাতক হওয়ার পর শাংহাই চলচ্চিত্র বাদকদলের প্রধান, শাংহাই চলচ্চিত্র জেনারেল কোম্পানির সংগীত বিভাগের পরিচালক, শাংহাই সংগীতজ্ঞ সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান ও চীনা চলচ্চিত্র সংগীত সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান হন। তিনি মোট ৬০টির বেশি চলচ্চিত্র ও দুইশ'রও বেশি টেলিভিশন নাটকের সুর করেছেন, দশ বারোটি বড় আকারের সিমফনির সুর করেছেন। ২০১১ সালে তিনি অষ্টম চীনের সংগীত স্বর্ণ ঘণ্টা অ্যাওয়ার্ডে 'আজীবন সম্মাননা পুরস্কার' পান।
বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন চলচ্চিত্র 'রেলওয়ে গেরিলা'র গান। গানের নাম 'আমার প্রিয় পিপা বাজাই'। ১৯৫৬ সালে লিউ ছি মিং এর সুর করেন। গানের কথা লিখেছেন লু মাং ও হো বিন। চলচ্চিত্রে জাপানের আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় শানতোং প্রদেশের চিনিংয়ের ওয়েই শা হ্রদ এলাকায় সক্রিয় রেলওয়ে গেরিলা দলের জীবন বর্ণিত হয়েছে। এ গানটিতে শানতোংয়ের লোকসংগীতের সুর রয়েছে। গানে স্থানীয় রীতিনীতি প্রকাশের পাশাপাশি কঠোর পরিবেশে গেরিলা দলের সদস্যদের অটুট বিপ্লবী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। চলচ্চিত্রটি প্রকাশের পর এ গানও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। পুরো গান বিপ্লবের স্বপ্নে ভরা।
১০ বছর বয়স থেকে লিউ ছি মিং জাপানি আগ্রাসনবিরোধী সেনাবাহিনীর নাট্য দলে নয় বছর ছিলেন। তখনকার জীবনযাত্রা খুব কঠিন ছিল। তবে সেখানেই শিল্পকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে গান গাওয়া, অপেরায় অভিনয় করা, লড়াই করা, তথ্য প্রচার করাসহ নানা কাজ শিখেছেন তিনি। বয়স বাড়ার পর তিনি মনে করেন, সে সময় ছিল তার জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সময়। তার বাবা লড়াই করে প্রাণ হারানোর পর তার জীবনে চূড়ান্ত প্রভাব পড়ে। তিনি উপলব্ধি করেন যে, ব্যক্তিগত জীবন, বেদনা, গৌরব আর সম্মাননা সব কিছু দেশ ও জনগণের সঙ্গে জড়িত। তিনি আন্তরিকতা, বুদ্ধি ও পরিশ্রম দিয়ে দেশ, জনগণ ও গণবাহিনীকে তার প্রতিদান দেওয়ার ইচ্ছে করেন।
১৯৬৫ সালে 'ডক্টর নোর্মান বেথুন' নামে চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রে কানাডার ডক্টর নোর্মান বেথুন সুদূর থেকে চীনে এসে চীনা জনগণের জাপান-বিরোধী যুদ্ধে অপূরণীয় অবদান রাখেন। ১৯৭৮ সালে ইতালির মেসিনা চলচ্চিত্র উত্সবে এটি ভূয়সী প্রশংসা পায়। লিউ ছি মিং এ চলচ্চিত্রে সুর করেছেন। বন্ধুরা, এখন শুনুন এ চলচ্চিত্রের সুরের অংশ বিশেষ।
লিউ ছি মিং
লিউ ছি মিং বলেন, 'আমি আমার সংগীত কর্মের ওপর কোন উজ্জ্বল আলো দেখতে চাই না। আমি চাই, সুরগুলো যুগের নাড়ির সঙ্গে মিশে শ্রোতাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাক। এটা আমার আকাঙ্ক্ষা ও অন্বেষণ। শ্রোতাদের স্বীকৃতি ও প্রশংসা হলো আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া এবং সর্বোচ্চ পুরস্কার। জনগণের জন্য সুর করা আমার কাছে কোনো স্লোগান নয় বরং এটা আমার আজীবনের পবিত্র কর্তব্য।"
বন্ধুরা, এবার শুনুন ১৯৬১ সালের চলচ্চিত্র 'লাল সূর্য' এর গান। গানের নাম 'কে স্বদেশের প্রশংসা করে না'। গেয়েছেন সি সিউ লান।
সুরারোপ এক পেশাগত ও কৌশলগত শিল্প। সুরের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে লিউ ছি মিং সিমফনি সৃষ্টির চিন্তা করেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১৯৫৯ সালে তিনি বাদক দলের প্রধান হলেও শাংহাই সংগীত ইনস্টিটিউট ভর্তি হন। সেখানে তিনি পাঁচ বছর ধরে সুর করা শেখেন এবং দু'বছর পরিচালনা শেখেন। শিক্ষা জীবন স্মরণ করে তিনি বলেন, 'এখন ফিরে দেখলে আমার মনে হয় এই সাত বছর সময় ছিল অনেক মূল্যবান। এ সাত বছরের শিক্ষা ছাড়া আমার আজকের সংগীত কর্মগুলো থাকতো না।' ১৯৮০ সালের পর লিউ ছি মিং পর পর ২৪টি বড় পুরস্কার জয় করেন। চলচ্চিত্রে 'পুরোনো নগরের গল্প' সুরের জন্য তিনি তৃতীয় চীনের চলচ্চিত্র 'স্বর্ণ মোরগ অ্যাওয়র্ডের' শ্রেষ্ঠ সংগীত পুরস্কার পেয়েছেন।
টিভি নাটক 'ছিউ পাইয়ের মৃত্যু'তে সুরের জন্য তিনি অষ্টম টেলিভিশন 'উড়ন্ত দেবী অ্যাওয়র্ডের শ্রেষ্ঠ সংগীত পুরস্কার' পেয়েছেন।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের শেষে শুনুন 'লু পাহাড়ের প্রেম' নামে চলচ্চিত্রের গান 'আহ্, জন্মস্থান'।
বন্ধুরা, আজ আপনারা পরিচিত হলেন চীনের বিখ্যাত সুরকার লিউ ছি মিংয়ের সঙ্গে। তার বেশ কয়েকটি সুর ও গান শুনেছেন আপনারা। আশা করি, তার সৃষ্ট সুরগুলো আপনাদের ভালো লেগেছে।
'সুর ও বাণী' আসর আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকুন সবাই। আবার কথা হবে।
(ইয়ু/তৌহিদ)