একজন প্রবীণ ও তুষার
  2017-03-01 09:32:30  cri



সান সি প্রদেশের রাজধানী থাই ইউয়ান শহরেও তুষার পড়েছে। তুষারপাতের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটে দুটি ছবি নিয়ে ব্যাপক হৈচৈ হয়। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি বাসস্ট্যান্ডে বেশ কয়েকটি লাঠি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। একটি লাঠির উপর একটি চিরকুট। দ্বিতীয় ছবিতে চিরকুটের ক্লোজআপ। চিরকুটে লেখা আছে: তুষারপাতের ফলে রাস্তাঘাট কোথাও কোথাও পিচ্ছিল হয়ে আছে। প্রবীণদের জন্য সে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি বিপজ্জনক। আপনি চাইলে একটা ছড়ি সাহায্যের জন্য নিতে পারেন। কোনো পয়সা দিতে হবে না।

এই দুটি ছবির পেছনে রয়েছে মর্মস্পর্শী একটি গল্প। একজন ৭৫ বছর বয়সী প্রবীণ গত ২০ বছরে এ ধরনের ১০ হাজারের বেশি ছড়ি বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। এ প্রবীণের গল্প দ্রুত ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পরে এবং তিনি নেট ব্যবহারকারীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার থাই ইউয়ানে তুষার পড়ে। বসন্তের তুষারপাত চীনাদের বাড়ির বাইরে নিয়ে যায়। অনেকে ছবি তোলেন এবং উইচ্যাটে তা শেয়ার করেন। এ সব ছবির দু'টি ছিল আমাদের আলোচ্য ছবিগুলো। চিরকুটে এ প্রবীণ তার নাম লেখেননি।

কিন্তু সাংবাদিকরা ঠিকই এই প্রবীণকে খুঁজে বের করেন। তার নাম বিয়ান ইন লিয়াং। ইন্টারনেটে তার ছড়ি বিতরণের গল্প ভাইরাল হয়েছে শুনে তিনি অবাক হলেন, বললেন: এটা তেমন কোনো বড় ব্যাপার নয়।

বিয়ান ইন লিয়াং জানান, সময় পেলেই তিনি নিজের হাতে ছড়ি তৈরি করেন। বৃষ্টি বা তুষারপাতের পর তিনি হাতে তৈরি সেসব ছড়ি বাসস্টেশান ও আন্ডারপাসে রাখেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। একেকটি ছড়ি তৈরি করতে তার এক থেকে দু'দিন সময় লাগে। তিনি ইতোমধ্যে ১০ সহস্রাধিক ছড়ি তৈরি করেছেন।

১৯৯৮ সালের ঘটনা। বিয়ান ইন লিয়াং একজন প্রবীণের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। প্রবীণ লোকটি বিয়ান ইন লিয়াংকে তার জন্য একটি ছড়ি তৈরি করতে অনুরোধ করেন। বিয়ান ছড়ি তৈরি করে দেন। ছড়ি পেয়ে ওই প্রবীণ খুব খুশি হন এবং বিয়ান ইন লিয়াংয়ের দক্ষতার প্রশংসা করেন। তখন হঠাত করেই বিয়ান ইন লিয়াংয়ের মনে হলো তিনি তার এ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অন্যদের সাহায্য করতে পারেন। সেই থেকেই তিনি নিজের হাতে ছড়ি তৈরি করে তা প্রবীণদের বিনামূল্যে দেওয়া শুরু করেন।

ছড়ি বানাতের কাঠের প্রয়োজন। তাই যখনই তিনি বাইরে যান, মনে মনে খুঁজতে থাকেন চলনসই গাছের ঢাল বা কাঠের টুকরা। একসময় তার প্রতিবেশীরাও তাকে এ কাজে সাহায্য করা শুরু করেন। অল্প কয়েকদিন পরই দেখা গেল প্রতিবেশীদের কাছ থেকে উপযুক্ত কাঠের চালান আসতে শুরু করলো। এতে তার কাজ সহজতর হলো। তিনি প্রতিবেশীদের কষ্ট দিতে চান না। তাই তার কাজের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাড়ির সামনের খোলা প্রাঙ্গণ।

একবার ৮০ বছর বয়সী এক প্রবীণ বিয়ান ইন লিয়াংয়ের কাজ দেখতে আসেন। বিয়ান ইন লিয়াং ভাবলেন, হয়তো ওই প্রবীণ তার কাছে একটি ছড়ি চাইতে এসেছেন। তিনি তাকে একটি ছড়ি নিতে অনুরোধ করলেন। এতে উল্টো ওই প্রবীণ ক্ষেপে গেলেন। তিনি বললেন, তিনি ছড়ি ছাড়াই হাঁটতে পারেন, তিনি পঙ্গু নন। বিয়ান ইন লিয়াং লজ্জিত হলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কাউকে নিজে থেকে তিনি ছড়ি দেবেন না। বরং সুবিধাজনক স্থানে সেগুলো রেখে দেবেন, যার প্রয়োজন সে সেখান থেকে তুলেন নেবে।

অনেকে ছড়ি নেওয়ার পর বিয়ান ইন লিয়াংকে কিছু টাকা বা উপহার দিতে চেয়েছেন। কিন্তু বিয়ান ইন লিয়াং তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

কেউ কেউ তাকে বলেন, যদি আপনি ছড়ি বিক্রয় করেন তাহলে কিছু টাকা আয় করতে পারেন। বিয়ান ইন লিয়াং বলেন, তিনি ও তার স্ত্রী অবসর-ভাতা পান, ওতেই তাদের চলে যায়। অর্থ বড় নয়, বড় হচ্ছে মানুষের উপকার করার মানসিকতা।

২২ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে তুষারপাত ছিল না; আকাশে সূর্য উঠেছে। কিন্তু কোনো রাস্তায় জমেছে বরফ। বিয়ান ইন লিয়াং আবার ছড়ি বিতরণ করতে বাইরে গেলেন। বাসস্টেশানে তাকে ঘিরে ধরে অনেক মানুষ; তারা তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী।

৭৬ বছর বয়সী কুও হুয়া মিং সাংবাদিকদের জানান, কয়েক বছর আগে তার স্ত্রীর পা-এ সার্জারি করা হয়। তিনি বিয়ান ইন লিয়াংয়ের তৈরি ছড়ি ব্যবহার করেছেন। বিয়ান ইন লিয়াংকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে ৪টি কবিতা লিখেছেন।

১০ মিনিটের পথ হেঁটে বিয়ান ইন লিয়াং আসেন বাসস্টেশনে এবং ওখানে ছড়িগুলো রাখেন। যাত্রীদের কেউ কেউ তাকে চিনে ফেলে এবং তার প্রশংসা করে। ছড়ি রাখার পর বিয়ান ইন লিয়াং চলে যান না; দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন। যখন কোনো প্রবীণ তার ছড়ি হাতে নেন, তখন বিয়ান ইন লিয়াংয়ের মুখে হাসি ফোটে। মনের আনন্দে তিনি বাড়ির পথ ধরেন।

নেট ব্যবহারকারীরা বিয়ান ইন লিয়াংকে নিয়ে অনেক ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তাদের ভাষ্য, বিশ্বে বিয়ান ইন লিয়াংয়ের মতো আরও বেশি ভাল মানুষ দরকার। তার মতো মানুষ থাকলে আমাদের পৃথিবী আরও সুন্দর হবে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040