১৮৭৯ সালে সিডনির দক্ষিণ দিকে হেকটার ভূমিতে রাজকীয় জাতীয় পার্ক নির্মিত হয়। এটি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জাতীয় পার্ক ও মার্কিন ইয়েলৌস্টন জাতীয় পার্কের পর বিশ্বের দ্বিতীয় জাতীয় পার্ক। আগেই বলেছি, অস্ট্রেলিয়ায় ৫২০টিরও বেশি জাতীয় পার্ক রয়েছে। জাতীয় পার্ক গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য পরিবেশ সুরক্ষা। বনসম্পদ, পশুসম্পদ, পশুর আবাসস্থল, জলাভূমি, মরুভূমি ও আধা মরুভূমি, ইত্যাদি এলাকা জাতীয় পার্কের অন্তর্ভুক্ত। ৫২০টি জাতীয় পার্কের মধ্যে ৪০শতাংশই আবার জাতীয় পর্যটন শিল্পের অংশ। এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা বেড়াতে আসেন। বাকিগুলো সম্পূর্ণ সুরক্ষিত এলাকা। সিডনি শহর থেকে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কু-রিং-গাই চেস ন্যাশনাল পার্ক অবস্থিত। এটি অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় জাতীয় পার্ক। পার্কে পাখির কন্ঠ ও নদীর শব্দ শোনা যায়। পার্কে প্রাকৃতিক দৃশ্য আছে; আছে ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি। এখানে ক্যাম্পিং, ঘোড়ায় চড়া, পদব্রজ ও মাউন্টেন বাইকিং করা যায়। এ ছাড়াও এখানে আছে স্থানীয় আদিবাসীদের স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ এবং কফিশপ। পার্কে ঢুকতে কোনো টিকিট কাটতে হয় না। পার্কের চারপাশে কোনো বেষ্টনীও নেই। পর্যটকরা গাড়িতে পার্কে প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু পরিচালক মাদাম মেরি সুইমার বললেন, এতো বড় কু-রিং-গাই চেস ন্যাশনাল পার্ক পরিচালনার দায়িত্ব আছেন মাত্র ২০ জন কর্মকর্তা। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "আমাদের কাজের পরিধি ব্যাপক। আমরা পাহাড়ে আগুন প্রতিরোধ করি, বিভিন্ন বিনোদন কার্যক্রম পরিচালনা করি, প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার সুরক্ষা ও বিরল প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ করি। আমরা স্থানীয় আদিবাসীদের বিভিন্ন স্থাপনার সংস্কার ও ইতিহাস সুরক্ষার দায়িত্বও পালন করি।"
পার্কের পরিচালনা কর্মকর্তাদের অনেক দক্ষ হতে হয়। তারা ট্রাক চালাতে পারেন, পশুর চিকিত্সা করতে পারেন, বোট চালাতে পারেন, এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বও পালন করতে পারেন। ডিকিন ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত্ পরিবেশবিদ ইউয়ান রিচি বললেন, অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পার্ক একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তাই খরচ বাঁচাতে পার্কের কর্মীদের অনেক কাজে দক্ষ হতে হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "অস্ট্রেলিয়া জাতীয় পার্কগুলো পরিচালনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ওপর। প্রতি রাজ্যের বিভিন্ন আইন রয়েছে। কোনো কোনো রাজ্য জাতীয় পার্ক পরিচালনার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে প্রদান করে।"
অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকার বিভিন্ন রাজ্যের ভূমি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে না বা সেই অধিকার তার নেই। সংবিধান অনুযায়ী, বিভিন্ন রাজ্য নিজ নিজ ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্কের পরিচালনা ও নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে। ফেডারেল সরকারের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা ব্যুরো রয়েছে। এ সংস্থা বিশ্বের স্বীকৃত ঐতিহ্যবাহী স্থান, আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি ইত্যাদি সরাসরি পরিচালনা করে বা রাজ্যের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করে।
অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন রাজ্যের সরকার নিজ নিজ ভূমিতে জাতীয় পার্ক নির্মাণ ও পরিচালনা করে। স্থানীয় সরকার জাতীয় পার্কের সুরক্ষা ও নির্মাণে ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ দেয়। এ অর্থে সড়ক, ক্যাম্প, পর্যটনকেন্দ্র ইত্যাদি নির্মিত হয়। কিন্তু পার্কের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে। স্থানীয় সরকার গোটা ব্যবস্থা তত্ত্বাবধান করে।
সাম্প্রতিক কালে, কোনো কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট পার্কে পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এর ফলে বিরল উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশ সুরক্ষা দফতর তত্পর। এ সম্পর্কে ইউয়ান রিচি বলেন, "আমরা জাতীয় পার্কের সুরক্ষায় ফেডারেল সরকারের সাথে রাজ্য সরকারের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ওপর মনোযোগ দেই। যেমন, কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের জাতীয় পার্কে লুপ্তপ্রায় প্রজাতি সুরক্ষার ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। তাই ফেডারেল সরকারের উচিত স্থানীয় সরকারকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া।"
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পার্কগুলো স্থানীয় আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অবশেষগুলো সুরক্ষায় গুরুত্ব দেয়। প্রতিটি পার্কে স্থানীয় আদিবাদীদের সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা আছে। পার্কের কর্মীদের অধিকাংশই স্থানীয় আদিবাসী। অস্ট্রেলিয়া সরকার মনে করে, স্থানীয় আদিবাসীরা এ ভূমির প্রকৃত মালিকা। তাদের জীবনমান উন্নত করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার।