বাড়িতে ফিরার পথ

  2017-02-15 09:52:11  cri



গত ১১ ফেব্রুয়ারি ছিল চীনা চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসের পঞ্চদশ দিবস। দিনটিতে পালিত হয়েছে চীনের ঐতিহ্যবাহী লণ্ঠন উত্সব। এদিন পরিবারের সদস্যদের পুনর্মিলনের দিন। এই দিনে বিগত ৫৪ বছর ভারতে কাটানোর পর চীনা সৈনিক ওয়াং ছি জন্মস্থানে ফিরে আসার সুযোগ পান।

দিল্লি থেকে বেইজিং হয়ে সিয়ান ইয়াং পৌঁছাতে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। তবে আকাশপথে এ দূরত্ব অতিক্রম করতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু ওয়াং ছি'র বিষয়টা ভিন্ন। তিনি গত ৫৪ বছর এ পথে যাতায়াত করার সুযোগ পাননি। তিনি বলেন, "আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। এ আনন্দ ও সুখ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।"

১১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় ভোর ৩টা ১০ মিনিটে ওয়াং ছি ও তার ছেলেসহ পরিবারের ৫ সদস্য দিল্লি থেকে বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হন। বেইজিংয়ে পৌঁছানোর পর স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিটে বিমানযোগে সান সি প্রদেশের সিয়ান ইয়াং শহরের উদ্দেশে রওয়ান হয় পরিবারটি। ফ্লাইট দেরি হওয়ার কারণে তারা সন্ধ্যা ৬টায় সিয়ান ইয়াং বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। অর্ধ শতাব্দী পর ওয়াং ছি ফিরে আসেন চীনে, তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে।

বেইজিং বিমানবন্দরে পৌঁছে ওয়াং ছি ভিডিও ফোনের মাধ্যমে তার বড় ভাইকে বলেন, "ভাইয়া, আমি খুব শিগগিরি সিয়ান ইয়াং পৌঁছাব।" জবাবে তার বড় ভাই বলেন, "আমি বিমানবন্দরে তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবো।" সাদা চুলের দু'জন প্রবীণের মুখে ফুটে ওঠে শিশুর হাসি।

বাড়িতে ওয়াং ছি'র পরিবার তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার ভাই ওয়াং চি ইউয়ানের শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। তাই তার ছেলে তাকে আবেগতাড়িত না-হবার পরামর্শ দিয়ে চলেছেন।

ওয়াং চি ইউয়ান ৮৪ বছর বয়সী। তার ছোট ভাই হারিয়ে যাওয়ার পর তিনি ও তাদের মা তাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা চালিয়েছেন। তখন তার রাতে ঘুম হতো না। প্রায় ২৩ বছর পর একদিন তিনি ভারত থেকে তার ছোট ভাইয়ের একটি চিঠি পান। খামে কোনো ফিরতি ঠিকানা লেখা হয়নি এবং ভেতরে কোনো কাগজও ছিল না। খামের পেছনে লেখা ছিল কয়েকটি কথা। এ লেখা দেখে ওয়াং চি ইউয়ান আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। এটা তার ছোট ভাইয়ের হাতের লেখা। তার পর দু'জনের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়। কেন তার ছোট ভাই ভারতে গেলেন?

১৯৬৩ সালে ২৪ বছর বয়সী ওয়াং ছি ছিলেন একজন সীমান্ত সৈনিক। একবার তিনি দু'দেশের সীমান্তের একটি বনে হারিয়ে যান এবং ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতের বাহিনী তাকে গোয়েন্দা মনে করে গ্রেফ্তার করে। এরপর তাকে কারাগারে ৭ বছর কাটাতে হয়। কারগার থেকে বের হওয়ার পর তাকে মধ্যপ্রদেশের দূরবর্তী একটি গ্রামে পাঠানো হয়। ওখান থেকে তার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কঠিনতর হয়ে পরে। অনেক পরে যোগাযোগ-ব্যবস্থা ভালো হলে ওয়াং ছি চীনে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য চেষ্টা চালান। আরও পরে, ২০১৩ সালে ওয়াং ছি চীনা সরকারের কাছ থেকে পাসপোর্ট পান।

বেইজিং থেকে সিয়ান ইয়াং যাওয়ার পথে ওয়াং ছি বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। বাইরের পৃথিবীটা তার কাছে অচেনা মনে হয়। অর্ধ শতাব্দীতে তার জন্মভূমির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি সাংবাদিককে জানান, চীন অনেক বদলে গেছে।

সিয়ান ইয়াংয়ে তখন ওয়াং ছির পরিবারের দশ-বারো জন সদস্য অপেক্ষা করছিলেন। ওয়াং ছির ভাতিজা ওয়াং ইং চুন তার কাকাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে যান। তিনিই পরিবারের একমাত্র সদস্য যার সঙ্গে আগে ওয়াং ছির দেখা হয়েছে। ২০০৯ সালে ওয়াং ইং চুন পর্যটক হিসেবে ভারতে যান এবং ওখানে তিনি তার কাকা ওয়াং ছির সঙ্গে প্রথমবারের মতো দেখা করেন। তিনি জানালেন, আগে দেখা না-হলেও, প্রথম দর্শনেই তারা পরস্পরকে চিনতে পেরেছিলেন; একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন।

ওয়াং ছি ও তার ভারতীয় পরিবার সন্ধ্যায় সিয়ান ইয়াং বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে তার দুই পরিবারের মধ্যে দেখা হয়; সবার চোখ অশ্রুসজল। ওয়াং ছি'র ছেলে চীনা ভাষা বলতে পারে না। তবে যখন তার চাচাতো বোন তাকে 'তিতি (চীনা ভাষায় 'ছোট ভাই') বলে ডাকলেন, তখন তিনি ঠিকই সাড়া দিলেন।

পূর্ণিমার রাত। চীনের ঐতিহ্যিক পুনর্মিলনের রাত। এ রাতে ওয়াং ছি ও তার পরিবার অবশেষে একসাথে বসে ডিনার খেলেন। ৫৪ বছর চলে গেছে। কিন্তু অবশেষে তো মিলন হলো!

ওয়াং ছি'র চীনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য চীনা দূতাবাস ও ভারত সরকার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। চীনা রাষ্ট্রদূত লুও চিয়াও হুই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বজায় রাখেন। ওয়াং ছি অবশেষে ভারত থেকে চীনে আসার অনুমতি পান।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার বিভাগের উপ-প্রধান লু স্যু বলেন, "ওয়াং ছির মতো হয়তো আরও চীনা মানুষ আছে ভারতে এবং এখন চীন ও ভারত এ ব্যাপারে আরও খোঁজখবর নেবে। ওয়াং ছি'র মতো যাদের চীনে ফিরে আসার ইচ্ছা, তাদের ফিরে আসার ব্যবস্থা করবে সরকার।" (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040