চীনা গল্প: চীনের বারো রাশির গল্প
  2017-02-05 16:05:59  cri


বর্তমানে পৃথিবীতে চীনা অধিবাসীরা তাদের জন্মগ্রহণের পর চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে নিজের একটি রাশি পেয়ে থাকে। কিন্তু অনেক অনেক আগের কথা, প্রাচীনকালে পৃথিবীতে কোনো রাশি ছিল না। একবার স্বর্গের রাজা সিদ্ধান্ত নিলো যে, পৃথিবীতে রাশি নির্বাচন করা হবে। এজন্য পৃথিবীর সকল প্রাণীদের রাশি নির্বাচনী সভায় অংশ নেয়ার জন্য হুকুম দেয়া হলো।

অন্য সকল প্রাণীর মতো বিড়াল ও ইঁদুর একসাথে সভায় অংশগ্রহণের দাওয়াত পেয়েছে। কারণ তারা দুজনে সবসময়ে একসাথে থাকতো। অতীতে কিন্তু ইঁদুর ও বিড়ালের বেশ ভাব ছিল। বিড়াল বেশ অলস প্রকৃতির ছিল তবে গায়ে ছিল প্রবল শক্তি। অন্যদিকে ইঁদুর ছিল পরিশ্রমী ও চতুর, তবে তার গায়ের আকার অতি ক্ষুদ্র। ফলে তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করতো। ইঁদুর দায়িত্ব গোয়েন্দাগিরির কাজ করা নেয়, আর বিড়ালের কাজ হলো শিকার ও খাবার পরিবহন করা। রাশি নির্বাচনী সভার দাওয়াত পেয়ে তারা একসাথে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিড়াল ঘুমাতে বেশ পছন্দ করে। তাই সে বার বার করে বন্ধু ইঁদুরকে অনুরোধ করে যে, ঘুমিয়ে গেলে সময় মতো যেনো তাকে ডেকে তোলা হয়। ইঁদুর সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যায় এবং বললো, "ভাই, তুমি কোনো চিন্তা করো না, তুমি নিশ্চিন্ত মনে ভালো করে ঘুমাও। আমি অবশ্যই সময় মতো তোমাকে ডাকবো'। এ কথা শুনে বিড়ালতো মহা খুশি। সে পেট ভরে খেয়ে তারপর হেলেদুলে বিছানায় গিয়ে গভীর নিদ্রায় চলে যায়। এরপর ইঁদুর বিড়ালের ঘুম গভীর হলে সে, বিড়ালের দাড়ি টানলো, তার চিবুক স্পর্শ করলো, তাকে ডাকলো, কিন্তু কোন ভাবেই বিড়ালের কিছু হুশ হয় না এমনকি একটু নড়াচড়া করার লক্ষণ নেই তার মধ্যে। পরদিন ভোরবেলায় ইঁদুর বিছানা থেকে উঠে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে গুজিয়ে রওনা হবার জন্য প্রস্তুতি নেয়। অন্যদিকে বিড়ালতো নাক ডেকে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। ইঁদুর বন্ধু বিড়ালের দিকে এক নজর তাকিয়ে হালকা স্বরে ডাকলো, "বিড়াল ভাই, ও বিড়াল ভাই, ওঠো না ভাই ?" কিন্তু বিড়ালের ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গে না। ইঁদুর তাই দেখে মৃদু হেসে একা একা চলে যায় রাশি নির্বাচনের সভায়।

এদিকে রাশি নির্বাচনের খবর পেয়ে হ্রদে থাকা ড্রাগণ ভীষণ চিন্তা পড়ে যায়। সে ভাবলো, "আমার ফিটফাট আঁশ আছে, তাম্র মুদ্রার মতো বড় চোখ আছে, উচ্চ নাক আছে, লম্বা দাড়ি আছে। কেবল আমার যদি মাত্র দু জোড়া শিঙ থাকতো তাহলে কত ভালো হতো। তখন অবশ্যই আমাকে নির্বাচিত করতে রাজার কোনো ভাবনা ভাবতে হতো না। কিন্তু আমার মাথায় শিঙ নেই, চুল নেই, দেখতে একদম সুন্দর লাগে না।"

ড্রাগণ যখন মনে মনে এ সব কথা ভাবছে এমন সময়ে হ্রদের কিনারে দেখতে পেল ভারি সুন্দর শিঙ আর রঙিন ঝুঁটির এক মোরগ পানি পান করছে। মোরগের মাথায় এক জোড়া সুন্দর শিঙ দেখে ড্রাগণের চোখ আর নড়ে না। মোরগটি পানি পান করে চলে যাচ্ছিল। এমন সময়ে ড্রাগণ ডাকলো, "মোরগ দাদা, একটু দাড়াও না।"

মোরগ এ কথা শুনে উত্তর দিলো, "ড্রাগণ ভাই, কী ব্যাপার?"

"মোরগ দাদা, আমার ছোট্ট একটি অনুরোধ আছে। তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারো?" মোরগ মাথা নাড়িয়ে ড্রাগণকে তার কথা শেষ করার ইঙ্গিত দেয়। ড্রাগণ বললো, "আমি রাশি নির্বাচন সভায় যাবো তো, রাজা বাহাদুর আমায় ডেকেছেন। কিন্তু এখন আমাকে তো দেখতে কুতসিত লাগছে, কারণ আমার মাথায় কোনো সুন্দর শিঙ নেই এমন কি নেই কোনো চুল। আমার মনে হয়, মানে আমার দৃষ্টিতে তোমার এ জোড়া শিঙ ভীষণ রকম সুন্দর। তুমি, কি তোমার শিঙজোড়া আমাকে কিছু সময়ের জন্য ধার দিতে পারো?"

মোরগ এ কথা শোনার পর মাথা দোলাতে দোলাতে বললো, "না, না, তা কি করে সম্ভব? আমিও তো রাশি নির্বাচন সভায় যাবো আমার সিঙ তোমাকে দিলে আমার কী হবে?"

ড্রাগণ এবার বেশ কাচুমাচু করে বিনয় স্বরে বললো, "মোরগ দাদা, দেখো তোমার মাথায় তো রক্তের মতো লাল রঙের ফুলঝুঁটি আছে, সমস্ত শরীরে আছে রঙিন পালক আর তাছাড়া তোমার তো রয়েছে অসাধারণ চরিত্র, যা দেখে সকলে সহজে মুগ্ধ হয়ে যায়। আমার মনে হয়, তোমার মাথার এ জোড়া শিঙ তোমার অপরূপ সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে, এদুটোর কোনো প্রয়োজন নেই, বরং মাথায় থাকলে অতিরিক্ত লাগে। তুমি নিশ্চিন্ত মনে এদুটো শিঙ আমাকে ধার দিতে পারো।"

মোরগ ড্রাগণের প্রশংসা শুনে তো খুশীতে আত্মহারা হয়ে যায়। ঠিক এই সময় পাথরের নিচ থেকে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসে ছোট্ট চেলাপোকা। পোকাটি ড্রাগনের সব কথা শুনেছে, তাই ড্রাগণকে সাহায্য করার জন্য মোরগকে বললো, "মোরগ দাদা, আপনিতো দেখতে বেশ নাদুশনুদুশ, যথেষ্ঠ সুন্দর আর রঙিন, বেশ ভালো অবস্থা আপনার। আসলে আপনার এ জোড়া শিঙের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি বরং ড্রাগণ ভাইকে শিঙ জোড়া ধার দিতে পারো, কাজের পর সে তোমাকে আবার ফেরত দিয়ে দেবে। আমি তার জন্য দায়বদ্ধ থাকবো।" মোরগ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও চেলাপোকার কথায় বিশ্বাস রেখে শিঙ ধার দিতে সম্মত হয়।

এদিকে নির্বাচনের দিন পৃথিবীর সব প্রাণীরা বেশ সেজেগুজে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে স্বর্গের প্রাসাদে হাজির হয়। স্বর্গের রাজা তা দেখে ভীষণ খুশি হলো। প্রাণীরা যার যার নিজের প্রচার, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আর দলগত বিতর্ক করার পর স্বর্গের রাজা গরু, ঘোড়া, ছাগল, কুকুর, শূকর, খরগোশ, বাঘ, ড্রাগণ, সাপ, বানর, মোরগ ও ইঁদুর এ বারোটি প্রাণীকে রাশি হিসেবে নির্বাচিত করে।

কিন্তু ১২টি প্রাণী নির্ধারণের পর স্বর্গের রাজা আবার নতুন সমস্যায় পড়লো। তা হলো এগুলোর ক্রম বা পর্যায়ক্রম কি হবে তা নিয়ে সমস্যায় পড়লো। স্বর্গের রাজা সবার প্রস্তাব শুনলেন কিন্তু প্রতিটি প্রাণী প্রথম স্থানে থাকতে চায়, ফলে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা গেল না। স্বর্গের রাজা বাধ্য হয়ে বললেন, আকারের ছোট বড় দেখে ক্রম নির্ধারণ করা হবে। গরু সবচেয়ে বড়, সেই জন্য গরু প্রথম থাকবে'। রাজার এ সিদ্ধান্তে বাঘ সহ প্রায় সব প্রাণী রাজি হয়েছে। কিন্তু কেবল ইঁদুর রাজি হয়নি।

সে বলল, "স্বর্গের রাজা, আপনি ভুল করেছেন। আকার অনুসারে আমি সবচেয়ে বড়, গরু নয়।"

ইঁদুরের কথা শুনে সবাইতো হেসে লুটপুটি খাবার দশা তৈরি হলো। খরগোশ ইঁদুরের সামনে এসে বললো, "ইঁদুর ভাই, মিথ্যা কথা বলার বড় সাহস আছে তো তোমার। গরু তো দূরের কথা, তুমি আমার চেয়েও ছোট। এমন কী গরু ভাইয়ের এক পায়ের খুর তোমার চেয়েও বড়।" সরল গরু শুধু হাসলো, কিছু বললো না।

কিন্তু ইঁদুর অন্যদের হাস্য-কটাক্ষ উপেক্ষা করে তার যুক্তি তুলে ধরে দৃঢ়তার সাথে বললো, "স্বর্গের রাজা, তুমি জানো না? মানুষ আমাকে দেখে সবসময় বলে, 'ওরে বাবা! এতো বড় ইঁদুর!' বরং কখনো কাউকে বলতে শুনবেন না যে, 'এতো বড় গরু'।"

স্বর্গের রাজা ইঁদুরের যুক্তি শুনে একটু বিস্মত ও হতবুদ্ধি হয়ে যায়। সে অন্য প্রাণীকে জিজ্ঞেস করলো, "এটা কি সত্যি? তাহলে আমি কেন কখনো শুনিনি?" অন্যরা মনে করে, ইঁদুর বড়াই করছে। কিন্তু ইঁদুর আস্থার সঙ্গে বলল, "আমি চালবাজ না। আপনারা আমার সঙ্গে আসুন, আমি আপনাদের প্রমাণ করে দিবো।"

স্বর্গের রাজাও মনে করে, সত্যের শক্তি কথার চেয়ে বেশি। এরপর রাজা নির্বাচিত সব প্রাণীদের নিজের চওড়া জামার হাতার মধ্যে রেখে পৃথিবীতে চলে যায়, ইঁদুরের কথার সত্যতা পরীক্ষা করার জন্য। সেখানে তারা একটি গ্রামে পৌঁছার পর স্বর্গের রাজা আর অন্য প্রাণী রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকে। এমন সময়ে এক বড় মহিষ মন্থর গতিতে গ্রামের পথ দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। পথচারীরা তা দেখে বলল, "এটা কার বাড়ির মহিষ, কেন পথে পথে হাঁটছে? এতো বড় মহিষ জমি চাষের জন্য বেশ ভাল হবে।"

ঠিক এ সময় ইঁদুরটি মহিষের পিঠে লাফ দিয়ে ওঠে পড়ে। লোকজন ইঁদুরটিকে দেখে অবাক হয়ে বললো, "বাহ্, এতো বড় ইঁদুর।" এ কথা শুনে ইঁদুর তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে মহিষের পিঠে কয়েকবার ডিগবাজি দেয়, কারণ তার কথা প্রমাণিত হলো। স্বর্গের রাজা আর অন্য প্রাণীরা আর কিছু বলতে পারলো না।

এরপর স্বর্গের প্রাসাদে ফিরে গিয়ে রাজা ঘোষণা করলো, "১২টি রাশির মধ্যে ইঁদুর প্রথম, গরু হচ্ছে দ্বিতীয়।"

ইঁদুরতো এ ফল শুনে মহাখুশি, গানের সুরে নাচতে নাচতে বাড়িতে ফিরে গেল। এদিকে বিড়ালের ঘুম মাত্র ভেঙেছে। সে ইঁদুরের গানের সুর শুনে প্রশ্ন করলো, "ইঁদুর ভাই, অনুষ্ঠানে যাবার সময় কি হয়েছে? আমি কি এক্ষুনি উঠবো?।"

ইঁদুর বললো, "হুম! তা উঠতে পারো তবে, রাশি নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। তুমিতো মরার মতো ঘুমিয়ে ছিলে। সত্যি অতি অলস তুমি। স্বর্গের রাজা ১২টি প্রাণী নির্বাচন করেছেন। আমি প্রথম। আমি হচ্ছি ১২টি রাশির সর্দার।"

বিড়াল বিস্মিত দৃষ্টিতে ইঁদুরের দিকে থেকে বললো, "শেষ হয়েছে? তুমি কেন আমাকে ডাকো নি?"

ইঁদুর হালকা স্বরে বললো, "বেশি কাজ ছিল, মনে নেই।"

বিড়াল এ কথা শুনে রাগে হুশ বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে চিত্কার করে বললো, "এ পুচকে ইঁদুর, তুই আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিস। কিন্তু তোর কথা তুই রাখিস নি। তুই ইচ্ছা করে আমাকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিস। আমি তোকে ছাড়বো না।"

ইঁদুর কিন্তু বিড়ালের কথা পাত্তাই দিল না। বরং সে বলল, "হ্যাঁ, আমি তখন রাজি হয়েছি, কারণ আমরা এক সাথে থাকি, আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আছে। কিন্তু তোমাকে ডেকে তুলতেই হবে, এমন দায়িত্ব আমার নেই। আমি সেটা কেন করবো?"

বিড়াল একথায় ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে যায়, হঠাত্ সে ইঁদুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র কণ্ঠে বললো, "তাহলে তুই হবি আজকের দিনের আমার প্রথম খাবার।" বিড়ালের শক্তি অনেক, ইঁদুর পালাতে পারে না, এমনকি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও ছিল না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে বিড়ালের থাবার নিচে পড়ে প্রাণ হারায়। সেই থেকে ইঁদুর আর বিড়ালের মধ্যে বংশপরম্পরায় শত্রুতার সম্পর্ক এখনো চলছে।

এদিকে মোরগেরও মন খারাপ। যদিও তাকে ১২টি রাশির একটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে ড্রাগণ তার আগে স্থান পেয়েছে। নির্বাচনের পর একদিন সে ড্রাগণের কাছে গিয়ে নিজের শিঙ ফেরত আনতে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগলো। মোরগটি মনে মনে ভাবছে, ড্রাগণ আমার শিঙ পড়ে নির্বাচিত হয়েছে। ফলে দেখা মাত্র ড্রাগন তাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। তাই যথাশিগগির সম্ভব তার শিঙটি ফেরত আনতে যাওয়া উচিত।

যেই কথা সেই কাজ, মোরগ ড্রাগণকে খুঁজতে হ্রদের তীরে চলে যায়। দূর থেকে সে দেখতে পেল, হ্রদের পানিতে ড্রাগণ খেলছে এবং এক জোড়া শিঙ ড্রাগণের মাথার ওপর আছে। মোরগ তাড়াতাড়ি এগিয়ে মাথা তুলে বললো, "ড্রাগণ ভাই, আপনাকে অভিনন্দন। আপনি ১২টি রাশিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এবং অনেকের আগে স্থান পেয়েছেন। আপনার ইচ্ছা তো পূরণ হলো এবার আমার শিঙ জোড়া আমাকে ফেরত দিন।"

ড্রাগণ আনন্দের সাথে পানি খেলছিল। মোরগের কথা শোনামাত্র আকস্মিকভাবে তার মুখ কালো হয়ে যায়। ড্রাগণ মনে মনে ভাবছে, 'কি করি এখন, এড়িয়ে যাওয়া যাবে না আবার উত্তর না দিলেও চলবে না'। সে বলল, "মোরগ দাদা, দেখো, তুমিতো শিঙ ছাড়াই ১২টি রাশির সারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছো। তোমার স্থানও খুব পিছনে নয়। তুমি যদি এই শিঙ জোড়া এখন ফেরত নিয়ে যাও তাহলে স্বর্গের রাজা হয়তো তাঁর আদেশও ফেরত নিয়ে যাবে। মানে সে রকম সম্ভাবনা আছে কিনা তাই। আর এখনতো আমি নিজেই আর শিঙ ছাড়া থাকতে পারি না, মাথাটা কেমন যেন ভন ভন করে ঘুরতে থাকে।"

মোরগ বুঝে যায় যে, ড্রাগণ তাকে শিঙ ফেরত দিতে চাচ্ছে না। ফলে সে এখন মজার মজার সব কথা দিয়ে শিঙ ফেরত না দেবার ফন্দি আঁটছে। এবার মোরগও রেগে গেল, সে বলল, "ড্রাগণ ভাই, কথায় আছে 'যে সময় মত ধার পরিশোধ করে, সেই উত্তম, তার পক্ষে পুনরায় ধার পেতে বা সাহায্য পেতে কোন সমস্যা হয় না।' কিন্তু তুমি ধার করা জিনিষ নিজের দখলে রেখে দিবে আবার নিজের বলে চালিয়ে দেবার ফন্দি করছো, এটা কিন্তু ভীষণ অন্যায়।"

এ কথা শুনে ড্রাগণের মুখ লাল হয়ে গেল, হঠাত্ যেন কিছুই বলতে পারলো না। সে তাড়াহুড়ো করে বললো, "মোরগ দাদা, আমি, আমি হঠাত্ আমার একটু অসুখ অসুখ লাগছে। আমি এখন চলে যাই। পরে কথা হবে।" এ কথা বলে সে দ্রুতই হ্রদের পানিতে ডুব দিয়ে হারিয়ে যায় দূরে বহু দূরে।

মোরগ আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, বুঝে পাচ্ছেনা যে, তার আর কি করা উচিত বা কিভাবেই শিঙ উদ্ধার করা যায়। তারপর সে পানির দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে চিত্কার করে বললো, "ড্রাগণ ভাই, তুমি এভাবে করতে পারো না। আমার শিঙ আমাকে ফেরত দাও।" কিন্তু হ্রদের পানি একটুও নড়লো না। ড্রাগন কোথায়? তার ছায়া তো পাওয়া যায় না। মোরগ বার বার চিত্কার করে ডাকলো, কিন্তু ড্রাগণ পানির নিচে লুকিয়ে থাকে, মোরগের কথার কোনো উত্তর দেয় না সে।

মোরগ বার বার চিত্কার করে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে হ্রদের তীরের একটি পাথরের ওপর বসে পরে। এ সময়ে হঠাত্ চেলাপোকার কথা মনে পড়লো মোরগের। চেলাপোকা হচ্ছে এ ঘটনার জামিনদার। ড্রাগনকে রাজি করানোর দায়িত্ব তারও রয়েছে। এরপর মোরগ চেলাপোকাকে খুঁজতে শুরু করলো। অনেক চেষ্টা করে অবশেষে কতগুলো পাথরের মধ্যে তাকে পাওয়া গেল। মোরগটি পুরো ঘটনা চেলাপোকাকে বর্ণনা করে এবং ন্যায়বিচার করার অনুরোধ জানায়।

কিন্তু চেলাপোকা সব কথা শুনার পর বুঝতে পারলো যে, এটা খুব জটিল একটি ব্যাপার। তবে সে জামিন দিয়েছে, কিছু না বললে তো চলবে না। তাই সে মনে মনে ভাবলো, "ড্রাগণ ভাইকেতো আর রাজি করাতে পারবো না। কারণ জোরাজোরি করলে হয়তো আমাকে মেরেই বসতে পারে। তবে মোরগকে আমি কেবল মোরগকে সান্ত্বনা দিতে পারি, সেই চেষ্টাই করা উচিত।" সিদ্ধান্ত নেয়ার পর চেলাপোকা আস্তে আস্তে বললো, "এ কাজটা সত্যি ড্রাগণ ভাই একদম ঠিক করে নি। তবে হয় তো সে কেবল মজার জন্য। দু তিন দিন পর নিশ্চয়ই তোমাকে ফেরত দিবে। তুমি চিন্তা করো না। একটু অপেক্ষা করো।" মোরগ রাজি হলো না। সে বলল, "সে যদি এখন আমাকে ফেরত না দিলে আরও সময় লেগে যাবে, আর তখন ফেরত দেয়ার সম্ভাবনা আরোও কমে যাবে।"

চেলাপোকা দেখলো বোঝানোর অন্য কোনো উপায় নেই। তাই সে বলল, "তাহলে আমারও উপায় নেই। সে ফেরত না দিলে, আমিতো আর জোর করতে পারি না। আমি তার মুখোমুখি হতে চাইলে সে যদি পানির মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তাহলে আমি কী করতে পারি। আমি তো আর হ্রদের নিচে যেতে পারি না।" মোরগ এবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো, সে বলল, "তখন তো তুমি নিজেই ড্রাগণের জন্য জামিনদার হয়েছিলে। জামিনদার যখন হয়েছো তখন তোমাকে ন্যায়পরায়ন হতেই হবে। আমি ন্যায়বিচার চাই।"

চেলাপোকা বলল, "মোরগ দাদা, তখন যদি তুমি ড্রাগনকে ধার দিতে রাজি না হতে, আমি কীভাবে তোমাকে রাজি করাতে পারতাম? আমি মনে করি, তোমরাই, একজন ধার নিতে চেয়েছো, আরেকজন ধার দিতে চেয়েছো। ফলে আমি এসে সহজেই জামিনদার হলাম। আর তাই তোমরা নিশ্চিন্তে কাজটি করতে পেরেছো। আমি কীভাবে জানবো যে, এ কাজটা এমন হবে? যদি প্রথম থেকে জানতাম তাহলে আমি অবশ্যই এর মধ্যে ঢুকতাম না।" মোরগ বুঝতে পেরেছে, চেলাপোকা এখন আর এ বিষয়ের মধ্যে থাকতে চাচ্ছে না এমনকি তাকে সাহায্যও করতে চাচ্ছে না। সে চুপে চুপে বললো, "তাহলে এখন আমি কী করতে পারি?" চেলাপোকা বললো, "তুমিই ড্রাগণের কাছে যাও, তোমার শিঙ ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করো। যদি পাও তো ভালো, না পেলে তোমার ভাগ্য খারাপ আর কি। এর জন্য তো কাউকে দায়ী করতে পারো না। কেন তুমি ড্রাগণের কথা বিশ্বাস করেছিলে।"

এ কথা শুনে মোরগের ভীষণ রাগ হলো। চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। সে তখন বললো, "কী? কী বললে তুমি? অবশেষে এর জন্য আমাকেই দায়ী করা হচ্ছে?" চেলাপোকা মাথা ঝাকিয়ে বললো, "হ্যাঁ, তোমারই দোষ, যদি তুমি রাজি না হতে, তাহলে সে তো আর ছিনতাই করতে পারতো না। তাই না?"

মোরগ এতটাই রেগে গেলো যে, আর কিছু না বলে সোজা তাকে মুখে পুরে খেয়ে ফেললো। তখন থেকে চেলাপোকা হলো মোরগের খাদ্য, যখন যেখানে এই পোকা দেখতে অমনি তা ধরে ধরে খেয়ে ফেলে। আর নিজেকে বাঁচানোর জন্য চেলাপোকা কেবল পাথরের নিচে অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু মোরগ নিজের শিঙের কথা ভুলতে পারে না। তাই প্রতিদিন ভোরবেলা সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকতে থাকে, কু কু কু রু রু কু ....কু ..কু এর অর্থ "ড্রাগণ ভাই, আমার শিঙ জোড়া আমাকে ফেরত দাও।"

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040