20170129gushi.mp3
|
চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি হচ্ছে চীনের চন্দ্র পঞ্জিকার প্রথম মাসের প্রথম দিন, অর্থাত্ বসন্ত উত্সবের প্রথম দিন। খ্রীষ্টানদের বড় দিনের মতো বা বাঙ্গালীদের বর্ষবরণ উত্সবের মতো এই বসন্ত উত্সব হচ্ছে চীনাদের জন্য সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘতম উত্সব। ঐতিহ্য আর রীতি অনুসারে বসন্ত উত্সব চীনের চন্দ্রবর্ষের শেষ মাসের ২৩ তারিখ থেকে নতুন বছরের প্রথম মাসের ১৫ তারিখ অর্থাত্ লন্ঠন উত্সব পর্যন্ত প্রায় তিন সপ্তাহ ব্যাপী স্থায়ী হয়।
ইতিহাস বলে, চীনাদের বসন্ত উত্সব চার হাজার বছরেরও বেশী পুরনো। তবে প্রথম দিকে এই উত্সবের নাম বসন্ত উত্সব ছিল না, এর নির্ধারিত তারিখও ছিল না। খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ সালের দিকে, তখনকার অধিবাসীরা সৌরজগতে বৃহষ্পতির একবার প্রদক্ষিণে যে সময় লাগতো তাকে এক সুই বলে অভিহিত করতেন, সে সময়ে এ উত্সবের নাম দেয়া হয় সুই। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে, তখনকার অধিবাসীরা এ উত্সবকে চীনা ভাষায় 'নিয়েন' বলতেন। 'নিয়েন' এর অর্থ সু-ফসল। যে বছর খাদ্য-শস্যের ভালো ফসল হতো সে বছরকে "ইউয়ো নিয়েন" বলা হতো। আর বসন্ত উত্সব উদযাপন করাকে চীনা ভাষায় 'কোও নিয়ান' বলা হয়। এই 'নিয়ান' নিয়ে চীনে অতি প্রচলিত একটি কিংবদন্তী রয়েছে।
প্রাচীনকালে 'নিয়ান' নামে ছিল এক দানব, দেখতে মস্ত বড়, ভয়ংকর হিংস্র আর মাথায় ছিল সুঁচালো দুটি শিং। গভীর সমুদ্রগর্ভে ছিল তার বাস। কেবল একবার, বছরের ঠিক শেষ দিনের শেষ রাতের অন্ধকারে ওপরে উঠে আসতো আর সামনে মানুষ বা প্রাণী যা পেত সব খেয়ে ফেলতো। ফলে ভয়ংকর এই দানব 'নিয়ানে'র ভয়ে প্রতি বছরের ঐ শেষ দিনটিতে গ্রামের সকল মানুষ যে যার মত করে যত তারাতারি সম্ভব পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে পালিয়ে থাকতো।
একবার বছরের শেষ দিনে ঐ গ্রামে অচেনা এক ভিক্ষুক আসে। কিন্তু গ্রামবাসীরা তখন দানবের ভয়ে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে চলে যাচ্ছিল আর ভিক্ষুকের দিকে ফিরে তাকানোরও সময় ছিল না তাদের। তবে গ্রামের পূর্বদিকের একজন বৃদ্ধা ভিক্ষুককে কিছু খাবার দিয়ে বলল- 'তুমি তাড়াতাড়ি পাহাড়ে চলে যাও, কাল সুর্য ওঠার আগে নিচে আসবে না'।
একথা শুনে ভিক্ষুক হাঁসতে হাঁসতে বললো, "আমাকে যদি আপনার বাড়িতে এক রাত থাকতে দেন, তাহলে ঐ দানব 'নিয়ান'কে আমি তাড়িয়ে দিতে পারি।" বৃদ্ধা ভিক্ষুকের কথা বিশ্বাস করাতো দূরে থাক উল্টো তখনই তাকে পালিয়ে যেতে বললো। উত্তরে সেই ভিক্ষুক একটু মৃদু হেসে আর কিছুই বললো না।
রাত তখন গভীর আর ঘুট ঘুটে অন্ধকার, দানব 'নিয়ান' গ্রামে ঢুকে লক্ষ্য করলো- "কি ব্যাপার! সব কিছু তো ঠিক আগের মতো মনে হচ্ছে না! বৃদ্ধার ঘরের দরজায় লাল কাগজ টাঙানো আর ভিতরে মোমবাতির উজ্জ্বল আলো?" দানব 'নিয়ান' ভয়ে একটু কেঁপে উঠল যেন। ব্যাপারটা বোঝার জন্য চুপে চুপে যেই না দরজার কাছে গেল ওমনি ঘরের ভিতর থেকে 'ধ্রুম ধ্রাম পিং পাং' বিস্ফোরণের আওয়াজ আসতে থাকলো। আওয়াজের কারনে দানব 'নিয়ানের' মস্তিস্কে ভীষণ যন্ত্রণা তৈরী হয় আর ভয়ে কাঁপতে থাকে। কারণ 'নিয়ান' লাল রং, অগ্নিকুণ্ডলী আর বিস্ফোরণ সহ্য করতে পারে না, এগুলোকে ভয় পায় ভীষণ। এ সময় ঘরের দরজা খুলে গাঁয়ে লাল পোশাক পড়া একজন বৃদ্ধ হা-হা করে হেসে উঠলো দানবটির সামনে। এতে দানব 'নিয়ান' নিজেই মৃত্যুর ভয়ে পড়িমড়ি করে প্রাণ নিয়ে দৌড়ে পালায়, ফিরে যায় গভীর সমূদ্রগর্ভে ।
ঠিক এর পরেরদিন অর্থাত নতুন বছরের প্রথম দিন। গ্রামবাসীরা পাহাড় থেকে ফিরে এসে গ্রামের শান্ত পরিবেশ দেখে তো অবাক। বৃদ্ধা তখন গ্রামবাসীদেরকে ঐ বৃদ্ধ ভিক্ষুকের কাণ্ডকারখানা সব খুলে বললো। আর এ ঘটনা দ্রুতই আশেপাশের সকল গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। দানব তাড়ানোর উপায় জেনে গেলো সবাই। এরপর থেকে সকল চীনা জাতি এই দিনটিকে 'কোও নিয়ান' বা দানব তাড়ানোর উত্সব হিসেবে উদযাপন করে থাকে। এ সময়ে সকল প্রকার অশুভ আত্মা আর অশুভ শক্তি থেকে রেহাই পেতে রাত জেগে আতশবাজি ফোটায়, বাতি জ্বালায়, আর ঘরে ঘরে লাল রঙের শ্লোক টাঙ্গানো হয়। সমগ্র চীন দেশটাই যেন ঐতিহ্যবাহী এ উত্সবে মেতে উঠে।
বসন্ত উত্সব উদযাপনের জন্য চীনের শহর ও পল্লী অঞ্চলের অধিবাসীরা নানা ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজ করেন। চীনের পল্লী অঞ্চলে উত্সব প্রস্তুতির কাজ বছরের শেষ মাসের প্রথম দিক থেকেই শুরু হয়। কৃষকরা বাড়ীঘর ধোয়া-মোছা করেন, লেপতোষক ধুয়ে পরিষ্কার করেন। বাজার থেকে মিষ্টিজাতীয় খাদ্য, কেক, ফলমুল, মাছ-মাংস ইত্যাদি সু-স্বাদু খাবার কিনেন যাতে উত্সবের দিন অতিথিদের আপ্যায়ন করা যায়। অন্যদিকে শহরে প্রস্তুতিমূলক কাজও উত্সবের অনেকদিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায়। টেলিভিশন কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বিভিন্ন শিল্পী উত্সবকেন্দ্রিক নানা বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান তৈরীতে ব্যস্ত থাকে। পার্কে পার্কে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী মেলা। দোকানগুলো ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে দেশে-বিদেশের হরেক রকম পণ্য সরবরাহ করে।
চীন একটি বড় দেশ, কাজেই বিভিন্ন অঞ্চলে বসন্ত উত্সব উদযাপনের পদ্ধতিও ভিন্ন। তবে বসন্ত উত্সবের আগের দিন রাতে অর্থাত্ পুরনো বছরের শেষ দিন রাতে পরিবারের সবাই মিলে এক সঙ্গে বছরের শেষ খাওয়া সম্পন্ন করার প্রথা সমগ্র দেশে প্রায় একই রকম। তবে দক্ষিণ চীনে বছরের শেষ খাবারের টেবিলে দশ-বারো রকম খাদ্য থাকে। এগুলোর মধ্যে টোফু অর্থাত্ সয়াবীনের দই ও মাছ থাকতে হবে। কারণ এই দুটি খাবারের চীনা উচ্চারণের সঙ্গে চীনা শব্দের উচ্চারণে 'সমৃদ্ধি'র সাথে অনেক মিল আছে। এতে নতুন বছরে চীনাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়।
উত্তর চীনে বছরের শেষ খাবারের টেবিলে চিয়াও চি নামের খাবারটি অবশ্যই থাকতে হবে। সেদিন সন্ধ্যায় পরিবারের সবাই এক সঙ্গে মিলে চিয়াও চি তৈরী করেন। চিয়াও চি চীনাদের একটি জনপ্রিয় খাবার। এই খাবার চীন সংস্কৃতির একটি অংশও বলা যায়। পরিবারের সবাই মিলে চিয়াও চি খাওয়াকে সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। চিয়াও চি হলো ময়দার তৈরী গোল আকারের এক কুলী পিঠা যার মধ্যে মাংস ও শাকসব্জি দেয়া হয়। এটি গরম পানির মধ্যে সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। চিয়াও চি তৈরীর পদ্ধতি আর খাওয়ার অভ্যাস বিষয়ে বিচিত্র রীতি ও বিশ্বাস যুক্ত রয়েছে।
চিয়াও চি তৈরীর ধরনেও অনেক প্রথা রয়েছে। বেশীর ভাগ অঞ্চলের অধিবাসীরা ক্ষীণ চাঁদের আকারের চাও চি তৈরী করেন, কোনো কোনো অঞ্চলের অধিবাসীরা সমৃদ্ধ জীবনের আশায় ইউয়েন পাও আকারে আবার সু-ফলনের আশায় গমের শীষের আকারের চিয়াও চি তৈরী করেন। চিয়াও চি তৈরীর পর ফুটন্ত পানিতে প্রায় দশ বারো মিনিট সিদ্ধ করার পর চিয়াও চি খাওয়া যায়।
বসন্ত উত্সবের দিনে চিয়াও চি খাওয়ার সময় অনেক চীনা অধিবাসী, বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রথম বাটির চিয়াও চি প্রয়াত পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে উত্সর্গ করেন। দ্বিতীয় বাটির চিয়াও চি রন্ধন দেবতার প্রতি উত্সর্গ করেন।
এরপর তৃতীয় বাটির চিয়াও চি পরিবার পরিজন মিলে খেতে শুরু করেন। তবে খাওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, জোড় সংখ্যার চিয়াও চি খেলে ভাল হয়। খাওয়া শেষে বাটিতেও জোড় সংখ্যার কয়েকটি চিয়াওচি রেখে দিতে হয়, এটার অর্থ হলো সবসময় প্লেটে যদি কিছু বারতি থাকে, জীবনে কখনো খাবারের অভাব হবে না ।
পরিবার পরিজনদের মধ্যে যারা পড়াশুনা বা চাকরীর জন্য অন্য স্থানে থাকেন তাঁদেরকে অবশ্যই প্রতি বছরের চন্দ্রবর্ষের শেষদিন বাড়ী ফিরে যেতে হয়। বছরের শেষ খাবার হিসেবে সবাই আনন্দময় পরিবেশে এক সঙ্গে চিয়াও চি তৈরী করবে এবং চিয়াও চি'র সাথে অন্যান্য মজার খাবার খাবে।
বন্ধুরা, এতক্ষণ আমি চীনের বসন্ত উত্সবের সম্পর্কে নানান গল্প কথা বলেছি। এটা হুবহু গল্প না হলেও এর মধ্য দিয়ে আপনারা চীনাদের ঐতিহ্যের ওপর কিছু ধারণা পেয়েছেন নিশ্চয়ই।
আজ চীনের ছুসি অর্থাত্ চীনের বসন্ত উত্সবের আগের দিন, আমি বেইজিং থেকে আপনাদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, আপনাদের সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধ জীবনের কামনা করি।