সুর ও বাণী: গীতিকার চুয়াং নু
  2017-01-18 13:48:07  cri


প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি আনন্দী বেইজিং থেকে আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজকের সুর ও বাণী আসরে তাইওয়ানের গীতিকার চুয়াং নুর পরিচয় তুলে ধরব এবং শোনাবো তার কয়েকটি গান।

চুয়াং নু

বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'আবার রান্নার ধোঁয়া দেখেছি'। গানটি গেয়েছেন তাইওয়ানের শিল্পী তেরেসা তেং। গানের কথা লিখেছেন গীতিকার চুয়াং নু। এ গানে বলা হয়েছে, 'রান্নার ধোঁয়া আবার উঠেছে। সন্ধ্যার আলো মাটিতে ছায়া ফেলেছে। রান্নার ধোঁয়া, তুমি কোথায় যাবে? সূর্যাস্ত যেন কবিতার মতো, সন্ধ্যালোকের ছবির মতো। এ প্রকৃতি যত সুন্দর হোক না কেন, আমার মনে শুধু তুমিই আছ।'

বন্ধুরা, চুয়াং নু-এর আসল নাম ছিল ওয়াং চিং ই। তিনি ১৯২২ সালে বেইজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং পেইপিং চায়না সংবাদ ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক পাস করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি তাইওয়ানে সংবাদদাতা ও সম্পাদক ছিলেন, পাশাপাশি মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তিনি পঞ্চাশ বছর ধরে তিন হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। তার পপ সংগীতগুলো খুব জনপ্রিয়। ২০১৬ সালের ১১ অক্টোবর ৯৫ বছর বসয়ে তিনি চোংছিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে 'সময়ের সাথে দৌড়ানো বৃদ্ধ' বলে অভিহিত করা হয়।

তেরেসা তেং ছিলেন বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তারকারী বিখ্যাত চীনা কণ্ঠশিল্পী। তিনি চীনা ভাষা, মিননান ভাষা, ইংরেজি, ক্যান্টনিজ, জাপানি ও ইন্দোনেশীয় ভাষায় তিন হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন। আর চীনা ভাষায় তার গাওয়া ৮০ শতাংশ গানের কথা লিখেছেন চুয়াং নু।

গত শতাব্দীর ৭০'র দশকের শেষ দিকে তেরেসা তেং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশনার সময় ইন্দোনেশিয়ার এক লোকসংগীতের সুর খুঁজে পান। তিনি সে গানের সুর তাইওয়ানে নিয়ে যান এবং গানের কথা লেখার জন্য অন্যজনের মাধ্যমে চুয়াং নুকে পাঠান। সে সময় চুয়াং নুর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তেরেসা তেংয়ের মিষ্টি মুখ ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর! তখনই মাত্র পাঁচ মিনিট সময় ব্যয় করে 'মিষ্টি' নামের একটি গান লিখেন তিনি। গানে তিনি বলেছেন, 'তোমার মিষ্টি হাসি। বসন্তের বাতাসে ফুটে ওঠা ফুলের মতো সুন্দর।' বন্ধুরা, চলুন চীনের মূল ভূভাগের তরুণ গায়ক লু হানের কণ্ঠে শুনি 'মিষ্টি' নামের গানটি।

তেরেসা তেং একসময় বলেছিলেন, 'চুয়াং নু না থাকলে তেরেসা তেংও থাকতেন না।' যদিও তেরেসা তেংয়ের ৮০ শতাংশ গানের কথা লিখেছেন চুয়াং নু। কিন্তু তিনি কেবল একটি গান প্রতিযোগিতায় তেরেসা তেংয়ের সঙ্গে একবার দেখা করেন। তিনি স্মরণ করে বলেছেন, 'সে সময়ের গায়ক গায়িকারা খুব ব্যস্ত থাকতেন, তারা প্রায়শই বিদেশে গিয়ে গান পরিবেশন করতেন। তেরেসা তেং খ্যাতি অর্জনের পর আর চুয়াং নুর সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে তিনি প্রতিবার তাইওয়ানে ফিরে যাওয়ার পর বিদেশ থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া নানা উপহার ডাকের মাধ্যমে চুয়াং নুকে পাঠাতেন। তেরেসা তেং প্রায় চুয়াং নুকে চিঠি লিখতেন। চুয়াং নু বৃদ্ধ হওয়ার পর তেরেসা তেংয়ের চিঠি পড়ে তিনি চোখের জল ফেলতেন।

বন্ধুরা, এবার তেরেসা তেংয়ের গাওয়া 'দক্ষিণ চীন সাগরের মেয়ে' নামের গানটি শুনুন। এ গানটি ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়। মালয়েশিয়ার পেনাং শহরের দৃশ্য আর স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে এ গান।

ছোটবেলায় চুয়াং নু বেইজিংয়ের তেং শি খোতে তার বাড়িতে থাকতেন। তিনি ইয়ু ইং মাধ্যমিক স্কুলে পড়তেন। চুয়াং নু বলেন, 'ছোটবেলায় আমার পরিবার খুব গরীব ছিল। আমার বাসায় চারটি সন্তান ছিল। জাপানি হানাদার বাহিনী চীনে আগ্রাসন শুরু করলে আমার বাবা জাপানি আগ্রাসনবিরোধী বাহিনীতে যোগ দেন। সে সময় প্রাথমিক স্কুলে আমি একটি গান শিখি, সে গানটি এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। গানের নাম 'জন্মভূমি মিস করি'। চুয়ান নু চীনের এক টেলিভিশন কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে এ কথা বলার পর 'জন্মভূমি মিস করি' নামের গানটি গান। 'জন্মভূমি মিস করি; কতইনা সুন্দর তুমি! সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয় আকাশ। ভেসে আসে বাতাসের ধ্বনি। ও স্বদেশিরা, শোনো আমার কথা।'

বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন চাং মিং মিনের গাওয়া 'মাঠের সেতুবন্ধনে হাঁটি' নামের গান। চুয়াং নু এ গানে লিখেছেন, 'আমি মাঠের সেতুবন্ধনে হাঁটি। মাঠে শরত্কালের দৃশ্য। গাছের পাতায় সোনালী রং। বাতাসও শরত্কালের গান গায়। আমি পল্লী অঞ্চলে হাঁটি। ফসলের ক্ষেত থেকে ধানের সুগন্ধ নেই। কৃষকরা ফসল কাটছে। তাদের মুখ হাসিমাখা।'

গত শতাব্দীর ৮০'র দশকের শেষ দিকে চুয়াং নু প্রথম তাইওয়ান থেকে মূলভূভাগে আত্মীয়স্বজনের খোঁজে আসেন, তবে কারও খোঁজ পাননি। খুব হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর তিনি তার বন্ধুর সাহায্যে বেইজিংয় পুলিশের মাধ্যমে চেষ্টা করতে থাকেন। অবশেষে তার ছোট বোনের খোঁজ পান তিনি। তারপর তিনি বিমানযোগে বেইজিং এসে ছোট বোনের সঙ্গে দেখা করেন। যাওয়ার আগে তিনি ছোট বোনকে চিঠি লিখে যান, 'আমাদের সাক্ষাত্ আনন্দের ব্যাপার। সাক্ষাতের সময় কেটে যায় দ্রুত। বিমান থেকে নামার পর স্বদেশের মাটিতে পা দিয়ে চোখের জল আর ধরে রাখা যায় না! তিনি বলেন, 'জন্মস্থানে ফিরতে কত যে ভালো লাগে!' এরপর থেকে প্রতি বছর তিনি বেইজিংয়ে আসতেন।

বন্ধুরা, এবার শুনুন ফেই ইয়ু ছিংয়ের গাওয়া 'আমার দেশ' গানটি। গানের কথা এমন, 'আমি দু'টি পাখা মেলে যাব অপরিচিত শহরে। আমি মাঠের সুঘ্রাণ পেয়েছি। আমি মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করি। আমি বন ও পাহাড় অতিক্রম করি। আমি তুষার পর্বত দেখেছি। আমি মাটির শব্দ শুনেছি।'

চুয়াং নু বলেন, মানুষের জীবন স্বপ্নের মতো। জাপানি আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেও স্বদেশ উদ্ধারের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি, তাই নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে তাইওয়ান প্রণালীর দু'পারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকেছেন। তিনি তাইওয়ানে গান লেখার পথ ধরেন, কারণ তিনি তার মনের আবেগ প্রকাশ করতে চান।

বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'আবার সে আকর্ষণীয় মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে' নামের গান। গেয়েছেন ছি ছিন। গানের কথা লিখেছেন চুয়াং নু।

চুয়াং নু আর ছিয়াও ইয়ু

চীনা সংগীত মহলে চুয়াং নু, ছিয়াও ইয়ু ও হুয়াং চান হলেন তিন শ্রেষ্ঠ গীতিকার। তারা যথাক্রমে তাইওয়ান, মূলভূভাগ এবং হংকংয়ের বাসিন্দা। তারা পরস্পরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন।

চুয়াং নু বলেন, 'আমার বাড়ির চারদিকে তেমন কিছু নেই। আমার দু'হাতে বেশি টাকাও নেই। তবে আমি একটি ভালো গানের কথা লিখতে পেরে সবচেয়ে আনন্দিত হই।'

বন্ধুরা, এখন শুনছেন 'ছোট্ট নগরের গল্প' নামের গান। গানের কথায় চুয়াং নু বলেছেন, 'যদি তুমি ছোট্ট এ নগরে আসো, তুমি অনেক কিছু পাবে। ছোট্ট এ নগরী দেখতে ছবির মতো, শব্দ গানের মতো। মানুষের জীবনের সততা, গুণাবলী আর সৌন্দর্য সব আছে এখানে। বন্ধুকে নিয়ে আসবে এখানে।'

চুয়াং নু বলেন, এখন পপ সংগীত পরিবর্তনের গতি বেশ দ্রুত হয়েছে। তার বয়স বেড়েছে, পরিবর্তনের এ গতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারেন না। তবে তিনি সবসময় দুইশ' শব্দের গানের কথা লেখার চেষ্টা করেন।

বন্ধুরা, এবার শুনুন 'ছোট গ্রামের প্রেম' নামের গান। গেয়েছেন চু সিয়াও লিন। গানের কথা এমন, 'নীল আকাশের নিচে ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসে। আমার জন্মস্থান, আমি তোমাকে খুব মিস করি। আমি প্রায়ই তোমার কথা মনে করি। তুমি কি আগের মতো আছো? আমি তোমার কোলে ফিরে যেতে চাই। সেই সুন্দর গ্রাম, সুন্দর দৃশ্য, যা আমার স্বপ্নে দেখা।'

বন্ধুরা, ২০০৬ সালের ২ এপ্রিল চুয়াং নু ষষ্ঠ পেপসি সঙ্গীত চার্টের 'আজীবন সম্মাননা পুরস্কার' পান। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তিনি চলে গেলেও তার রচিত গানগুলো চিরদিন চীনাদের মনে থাকবে। চীনের মূলভূভাগ, হংকং ও তাইওয়ানের শিল্পীরা এখনো নানা অনুষ্ঠানে চুয়াং নুর লেখা গান গান।

প্রিয় শ্রোতা, এতক্ষণ আপনারা শুনলেন তাইওয়ানের বিখ্যাত গীতিকার চুয়াং নু সম্পর্কে কিছু তথ্য এবং তার রচিত কয়েকটি গান। আজকের সুর ও বাণী আসর এ পর্যন্তই, ভালো থাকুন সবাই। আবার কথা হবে।

(ইয়ু/তৌহিদ)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040