সুর ও বাণী: হংকংয়ের বিখ্যাত গীতিকার হুয়াং চান
  2016-12-21 18:57:39  cri


প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি আনন্দী বেইজিং থেকে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আজকের 'সুর ও বাণী' আসরে। আজকে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো হংকংয়ের বিখ্যাত গীতিকার হুয়াং চাংয়ের সঙ্গে, শোনাবো তার কয়েকটি অসাধারণ সুন্দর গান।

বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'এ বিশ্বে তুমি সবসময় ভালো আছো' নামক গানটি। এটি ১৯৮৩ সালে হংকংয়ে প্রচারিত একটি জনপ্রিয় টিভি নাটকের থিম সং। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পরিচালক চৌ সিং ছি'র নতুন চলচ্চিত্র 'মত্স্যকুমারী'-তে আবার এ গানটি ব্যবহৃত হয়।

'এ বিশ্বে তুমি সবসময় ভালো আছো' গানটির কথা লিখেছেন হুয়াং চান, সুর করেছেন গু চিয়া হুই। এ দু'জন ছিলেন গত শতাব্দীতে হংকংয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার। দীর্ঘকাল তারা একসঙ্গে কাজ করে সুনাম অর্জন করেন।

চীনের মূল ভূখণ্ডের দর্শক-শ্রোতারা প্রথমবার হুয়াং চানের নাম জানেন ১৯৮৪ সালে। ওই বছর চীনের কেন্দ্রীয় টিলিভিশন কেন্দ্রের বসন্ত উত্সবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হংকংয়ের গায়ক চাং মিং মিন 'আমার চীনা মন' নামক একটি গান গেয়েছিলেন। তখনই প্রথম চীনের সাধারণ দর্শক-শ্রোতারা টেলিভিশনে মূল ভূভাগের বাইরের চীনা শিল্পীর পরিবেশনা উপভোগ করেন। তার গান গাওয়ার ঢঙ, পরিবেশনার ভঙ্গি, ও পোশাক ছিল মূল ভূভাগের চীনাদের কাছে একেবারেই নতুন। এ গান শুনে চীনারা বুঝতে পারেন যে, বিদেশে বসবাসরত চীনাদের মনেও দেশের জন্য ভালোবাসার কোনো কমতি নেই; তারাও স্বদেশে ফিরতে আগ্রহী।

'আমার চীনা মন' গানটির কথা লিখেছেন যথারীতি হুয়াং চান এবং এতে সুর করেছেন ওয়াং ফু লিং। গানটির কথাগুলো মোটামুটি এমন: 'স্বদেশের নদনদী ও পাহাড় কেবল আমার স্বপ্নেই বিরাজ করে। আমি বহু বছর হলো স্বদেশের মাটিতে পা রাখিনি। কিন্তু তাতে কী? আমার চীনা মন তো কোনো অবস্থাতেই পরিবর্তনযোগ্য নয়! পশ্চিমা পোশাক গায়ে চড়ালেও, আমার মন পড়ে থাকে চীনে। পূর্বপুরুষরা অনেক আগেই আমার সবকিছুর ওপর চীনা মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন। ছাং চিয়াং, মহাপ্রাচীর, হুয়াং পাহাড় আর হুয়াং হো---প্রতিটিই আমার কাছে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ। যখন যেখানেই থাকি, আমার রক্তে বয়ে চলে চীনা শব্দ। বিদেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছি আমি, কিন্তু আমার চীনা মন কখনও বদলাবার নয়।"

হুয়াং চাং-এর ইংরেজি নাম জেমস জে. এস. ওয়াং। তিনি ১৯৪১ সালের ১৬ মার্চ কুয়াংচৌ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ওয়াং হংকংয়ের নামকরা গীতিকার, লেখক, উপস্থাপক ও অভিনেতা। তিনি ক্যান্টোনিজ ভাষার সংগীত উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন। গত শতাব্দীর সত্তুরের দশকের শেষ দিকে একাধিক জনপ্রিয় টেলিভিশন নাটকের থিম সংয়ের মাধ্যমে তার নাম হংকংয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নব্বুইয়ের দশকে তিনি চলচ্চিত্রের জন্য অনেক গান লেখেন। এ গানগুলো হংকংয়ের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং চীনাদের কাছেও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। গত শতাব্দীর সত্তুর ও আশির দশকে তিনি অসংখ্য পুরস্কার পান। চল্লিশ বছর ধরে তিনি তার প্রজন্মের হংকংবাসীর সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করেন।

১৯৯০ সালে 'ত্রয়োদশ হংকং সেরা দশ চীনা গান' প্রতিযোগিতায় হুয়াং চাং 'স্বর্ণ সুচ পুরস্কার' বা দ্য গোল্ডেন নিডল্‌ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে 'লিয়াং চু' নামক চলচ্চিত্রের জন্য গান রচনা করে তিনি চতুর্দশ হংকং চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি তার দীর্ঘকালের সহশিল্পী গু চিয়া হুইয়ের সাথে যৌথভাবে হংকং, কুয়াংচৌ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় টানা ২৯টি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন চলচ্চিত্র 'লিয়াং চু'-এর সুর। হুয়াং চান এবং হু ওয়েই লি এ চলচ্চিত্রের সুরগুলো সৃষ্টি করেছেন।

সত্যিকার অর্থেই হুয়াং চাংয়ের চীনা মন আছে। তার সব গানেই চীনাদের জীবন, চীনের প্রেম, চীনের রীতিনীতি ফুটে উঠেছে। তার গানের কথায় চীনের প্রাচীন কবিতার প্রভাব রয়েছে এবং তার সৃষ্ট সুরগুলোর ওপর রয়েছে চীনের লোকসংগীতের প্রভাব। তার শিল্পকর্মকে চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির একটি শাখা বলা যায়। অনেকে মনে করেন, হুয়াং চানের মন চীনের প্রাচীনকালের লোকজনের মনের মতো। তিনি নয় বছর বয়সে হংকংয়ে চলে যান এবং ক্যান্টোনিজ ও ইংরেজি ভাষার পরিবেশে ও ব্যবসা-সংস্কৃতির মধ্যে নিজের গোটা জীবন অতিবাহিত করে। তা সত্ত্বেও, তার শিল্পকর্মে চীনের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাব রয়েছে, যা সত্যিই অভাবনীয়।

বন্ধুরা, এবার শুনুন হুয়াং চানের আরেকটি সুন্দর গান। গানটি হচ্ছে চলচ্চিত্র 'অসিযোদ্ধা'-এর থিম সং। হুয়াং চান, লো দা ইয়ো এবং শু খ্য এ গানটি গেয়েছেন। গানটিতে তাদের কন্ঠ তেমন সুন্দর নয়। তাদের কণ্ঠ গ্রামের বৃদ্ধদের মতো। কিন্তু কুংফু-ভিত্তিক এ চলচ্চিত্রে এটি ছিল মানানসই।

গত শতাব্দীর সত্তুর ও আশির দশক হলো হুয়াং চান এবং গু চিয়া হুইয়ের জন্য স্বর্ণযুগ। সেসময় তারা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন। তখন হংকংয়ের টেলিভিশন নাটকের বাজারও ছিল রমরমা। মানুষের মধ্যে টেলিভিশন নাটক দেখার আগ্রহ ছিল ব্যাপক। টিভি নাটকের গানের ডিস্ক তখন হটকেকের মতো বিক্রি হতো। ১৯৭৪ সালের টেলিভিশন নাটক 'সিংহ পাহাড়ের নিচে' তত্কালীন নিম্নআয়ের হংকংবাসীর কষ্টের জীবন বর্ণিত হয়। নাটকটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। এ জনপ্রিয় নাটকের জন্যও হুয়াং চান গান লেখেন। বলা বাহুল্য, সে গানও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

বন্ধুরা, তাহলে শুনুন হুয়াং চানের লেখা 'সিংহ পাহাড়ের নীচে' গানটি।

হুয়াং চান গান লেখার পাশাপাশি হংকংয়ের পত্রিকায় সাক্ষাত্কারভিত্তিক কলাম লিখতেন। গত শতাব্দীর নব্বুইয়ের দশকে তিনি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছেন। তার লেখা ৩০টিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'হুয়াং ফেই হোং' নামক সিক্যুয়েল চলচ্চিত্রের থিম সংটি লিখেছিলেন হুয়াং চান। তিনি 'সেনাপতির আদেশ' নামক একটি প্রাচীন সুর থেকে এ গানটি রূপান্তর করেন। গানটি শোনার পর হুয়াং চানের চরিত্র সম্পর্কেও শ্রোতারা স্পষ্ট ধারণা লাভ করে।

গত শতাব্দীর ষাট থেকে নব্বুইয়ের দশক পর্যন্ত হংকংয়ের সংস্কৃতিতে হুয়াং চান ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন এ বাণিজ্যিক সংস্কৃতিরই সৃষ্টি।

১৯৮৭ সালে চাং কুও রো এবং ওয়াং জু সিয়ানের অভিনীত চলচ্চিত্র 'সামার রোমান্স' মুক্তি পায়। হুয়াং চান এ চলচ্চিত্রের থিম সংয়ের কথা লিখেছেন এবং সুর করেছেন। ২০১১ সালে লিউ ই ফেই এবং কু থিয়ান লো একই নামের চলচ্চিত্রে আবার অভিনয় করেন। এ নতুন চলচ্চিত্রেও হুয়াং চানের গান ব্যবহার করা হয়।

গানের কথাগুলো এমন: "মানুষের জীবনের সুন্দর স্বপ্নগুলো পথের মতোই সুদীর্ঘ। কোন দিকে গেলে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে, আমি জানি না। আঁকাবাঁকা পথে সূর্যালোক দেখা যায় না। স্বপ্নে চোখে জল পড়ে।"

হুয়াং চান, জিন ইয়োং, নি খুয়াং এবং ছাই লান হচ্ছেন হংকংয়ের সবচেয়ে খ্যাতিমান চার মাস্টার শিল্পী। ১৯৯০ সালে হুয়াং চান চলচ্চিত্র 'সবুজ সাপ'-এর সংগীত সৃষ্টি করেন। এ চলচ্চিত্রে দেখানো হয় দু'টি সাপকে। এরা মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এসে মানুষের সঙ্গে প্রেম করে এবং সন্নাসীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। চলচ্চিত্রে যেদিন সবুজ সাপ পৃথিবীতে প্রথম পা রাখে, সেদিন একটি অনুষ্ঠানে ভারতীয় নৃত্যশিল্পীরা নাচ করছিলেন। নাচের সময় একটি গান বাজছিল, যেটিতে ভারতীয় সংস্কৃতির গভীর প্রভাব আছে। এ গানটি লিখেছেন হুয়াং চান। শুনুন গানটি।

প্রিয় বন্ধুরা, আজকের 'সুর ও বাণী' আসরে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছি হংকংয়ের বিখ্যাত গীতিকার হুয়াং চান এবং শুনিয়েছি তার কয়েকটি গান। আশা করি, তার গানগুলো আপনাদের পছন্দ হয়েছে। তাহলে আমি বিদায় নিই। ভালো থাকুন সবাই। আবার কথা হবে।

(ইয়ু/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040