বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান
  2016-12-11 19:07:59  cri

১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তরুনদের পাশাপাশি নারীদের অবদান অনেক। আমাদের দেশীয় আলোচনায় বেশীরভাগ সময়ই এই মহান মুক্তিযোদ্ধা নারীদের নাম উঠে আসে না কিংবা তাদের কৃতিত্ব বা অবধানের কথা প্রকাশ করা হয়না। কিন্তু যে সব মহান ও দেশপ্রেমিক মহান নারীরা তাদের জীবন বিপন্ন করে দেশকে ভালোবেসে পুরুষের পাশাপাশি নিজের জীবনকে বিপন্ন করে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো তাদের অবদানের কথা বাংলাদেশের ইতিহাস কখনো ভুলে যাবে না।

স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরার মতো অনেক নারী সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, পাকিস্তানী হানাদারদের গুলি করে মেরেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোবরা ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক নারী। ভারতে শরনার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরনার্থীদের সেবা করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। এরা ছিলেন যুদ্ধের প্রেরণা। আবার দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, শান্তিকমিটি, রাজাকারবাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এদেশের গ্রামে, গঞ্জে ,শহরে, বন্দরে অসংখ্য নারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। যুগিয়েছেন খাদ্য, অস্ত্র বহন করেছেন, লুকিয়ে রেখেছেন, গোপন সংবাদ আনা নেয়া করেছেন। অথচ এই নারীরা তাদের অবদানের স্বীকৃতি ভালোভাবে পাননি আজও।

ঊর্মি : পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এদেশের প্রায় তিন লাখ নারী। তারা ধর্ষিত হয়েছেন, নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই শহীদ হয়েছেন, অনেকে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রনা সহ্য করেও প্রাণে বেঁচে গেছেন। এরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েও নৈতিকভাবে পরাজিত হননি। এরা আপোষ করেননি পাকিস্তানীদের সাথে। মরনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এরা তাদের স্বামী, পুত্র, ভাইকে ধরিয়ে দেয়নি শত্রুর হাতে। অথচ যুদ্ধের পর এই বীরনারীরা তাঁদের প্রাপ্য স্বীকৃতি ও মর্যাদা এখনো পাননি বরং তাদের করা হয়েছে সমাজচ্যূত। যেন ধর্ষিত আর নির্যাতিত হওয়াটা তাদেরই 'অপরাধ' ছিল।

মান্না : মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর এই নারীদের অনেক গুরুত্তপুর্ন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভূমিকা ছিলো দেশকে নতুন করে দাড় করানোর জন্য। নারীদের এই বিষয়টিও আজ আলোচনার বাইরে। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের এই দেশের অনেক নারী হারিয়েছিলেন তার নিজের পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্য যেমন বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলেকে। পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরোচিত হামলায় কোন পুরুষ জীবিত না থাকায় আমাদের দেশের অনেক গ্রাম পরিচিতি পেয়েছিলো 'বিধবার গ্রামে'। এই সময় দেশের অর্থনীতির অনেকাংশের হাল ধরেছিলো এই মহান এবং সাহসী নারীরাই। সংসারের পুরো দায়িত্ব ছিল তাদেরই কাঁধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছেন অনেক নারী। নূরজাহান মুর্শিদ, আতিয়া বাগমারের মতো উচ্চ শিক্ষিত নারীরা প্রবাসে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন, তহবিল সংগ্রহের কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের একটি পোষ্টারের কথা এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই বলা চলে। পোস্টারটিতে লেখা ছিল বাংলার মায়েরা সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন অস্ত্রহাতে, যারা সেবা করেছেন আহতদের, যারা বন্দীশিবিরে নির্যাতন সয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁরা সকলেই কি বীর মুক্তিযোদ্ধা নন?

ঊর্মি : বাংলার মুক্তিযুদ্ধ ছিল এদেশের জনগণের যুদ্ধ যে জনগণের পঞ্চাশ শতাংশই নারী। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছে। কিন্তু ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি তাদের গবেষণায় বলছে, এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৬০ হাজার। এমনকি ৯ মাসে যে ৩০ লাখ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছে, তার ২০ শতাংশই নারী। নির্যাতনের ধরন ছিল বর্বরোচিত : একাত্তরে যে সাড়ে চার লাখ নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়, তার ধরন ছিল অমানুষিক। ঘাতকরা কেবল নির্যাতন বা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, ৭০ শতাংশ ধর্ষিতার সামনে হত্যা বা নির্যাতন করা হয়েছে তাদের স্বামী বা নিকট আত্দীয়কে।

নির্যাতিত নারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নারীকে স্পট ধর্ষণ ও স্পট গণধর্ষণ, ১৮ শতাংশ নারীকে কারাগারে ও ক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়েছে। ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীদের ৫৬ দশমিক ৫০ শতাংশ মুসলমান, ৪১ দশমিক ৪৪ শতাংশ হিন্দু এবং ২ দশমিক ০৬ শতাংশ ছিলেন অন্যান্য ধর্মের। দেশের ৪২ জেলার ৮৫ থানায় নির্বাচিত ২৬৭ জনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এই গবেষণা চালানো হয়।

গবেষণায় আরো বলা হয়, নির্যাতিত নারীদের মধ্যে বিবাহিত ছিলেন ৬৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং অবিবাহিত ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। ভারতে আশ্রয় নেওয়া নির্যাতিতা ও ধর্ষিতা হিন্দু নারীদের মধ্যে কুমারী বা অবিবাহিতা ছিলেন ৪৪ শতাংশ। এদের অধিকাংশই আর দেশে ফেরেননি।

গবেষণায় দেখা যায়, নির্যাতন-পরবর্তী সময়ে নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল প্রকট। এসব নারী আক্রান্ত হয়েছে নানা যৌন রোগে। দীর্ঘদিন আক্রান্ত ছিলেন মানসিক রোগেও। ৮০ শতাংশ নারী বিষাদগ্রস্ততা এবং ৮০ শতাংশ অস্থিরতা, নৈরাশ্য ও মাথাব্যথায় ভুগেছেন দীর্ঘকাল। একইভাবে ৯০ শতাংশ নারী ভুগেছেন গ্লানিতে। আর ৭ শতাংশ নারীকে স্থায়ী ক্ষত নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে সারাজীবন। বেঁচে আছেন এখনো অনেকে।

নির্যাতন-পরবর্তী সময়ে নারীদের সইতে হয়েছে নানা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। নির্যাতিত হওয়ায় স্বামী আর ঘরে তোলেনি ৭ শতাংশ নারীকে। ৯০ শতাংশ নারীকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে স্বজন বা পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারা। গ্রামাঞ্চলে নির্যাতিত নারীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সবকিছু জানিয়ে বিয়ে দিতে হয়েছে। আর শরণার্থী হয়ে যাঁরা দেশত্যাগ করেছিলেন কিংবা যাঁরা শহরাঞ্চলে বাস করতেন তাঁদের বিয়ের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ৯০ হাজার নারীর গর্ভপাত ঘটানো হয়। জন্ম নেয় অসংখ্য যুদ্ধশিশু। তিনি আরো বলেন, তখন গর্ভপাতের জন্য উন্নত যন্ত্রপাতি ছিল না। যে যেভাবে পেরেছেন গর্ভপাত ঘটিয়েছেন। যেসব শিশু জন্ম নেয় তাদের অনেককে বিদেশে দত্তক দেওয়া হয়। অনেক শিশুকে ফেলে দেওয়া হয় ভাগাড়ে।

আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, তখন নারীমাত্রই বোঝাই বীরাঙ্গনাদের কথা। বলি, লাখো লাখো নারীর লাঞ্ছনার বিনিময়ে পেয়েছি স্বাধীন দেশ। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে যোগদান না করেও প্রতিমুহূর্তে আমাদের নারীরা নীরবে রেখে গেছেন অবদান। তারা ঘরে থেকে ভাই-স্বামী-ছেলেদের যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছেন। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তারা রেখেছেন সাহসী ভূমিকা। কিন্তু তাদের নীরব এই অবদানের কথা, ঘটনা কখনো কারও তেমন জানা হয়নি। টুকরো টুকরো সাহসী জীবনের গল্পগুলো একত্রে আসেনি। নারীর ত্যাগের মর্যাদা ইতিহাস দেয়নি।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040