পুবের জানালা: সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফর ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এর প্রভাব
  2016-10-19 11:09:24  cri



সম্প্রতি দু'দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশ যান চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এটি ছিল গত ৩০ বছরে কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের প্রথম বাংলাদেশ সফর। স্বাভাবিকভাবেই দু'দেশের প্রায় সকল মহলে এ সফর গুরুত্ব পায়। বিশেষ করে বাংলাদেশে যেসব চীনা কোম্পানি কাজ করছে, সেসব কোম্পানি ও কোম্পানির চীনা কর্মীদের কাছে এ সফর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

২০১০ সালে সি চিন পিং প্রথম বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তবে, তখন তিনি ছিলেন দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ওই সফরকালে দু'দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তির আওতায় চীন বাংলাদেশের ৬১ কোটি ২০ লাখ ইউয়ান ঋণ মওকুফ করে এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের ৪৭৬২টি পণ্যকে চীনের বাজারে বিনাশুল্কে প্রবেশের সুযোগ দেয়। এতে চীনে বাংলাদেশের রফতানি ৯০ শতাংশ বেড়ে যায়। তখন অনেক চীনা কোম্পানিও এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারিত করে। চায়না ন্যাশনাল টেকনিকেল ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশান (সিএনটিআইসি) সে সব কোম্পানির অন্যতম।

এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে। বিশ্বের সেরা ৫০০টি কোম্পানির একটি এটি। এ কোম্পানি সাধারণত বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করে। এ ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসাও আছে কোম্পানিটির। বিদেশে এ কোম্পানি বিদ্যুত প্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপন ইত্যাদি খাতে ব্যবসা করে থাকে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ৪৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ঘোড়াশাল ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে সিএনটিআইসি। ২০১২ সালে প্রকল্পটির জন্য দরপত্র দাখিল করেছিল কোম্পানিটি। ২০১৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সাথে এ ব্যাপারে চুক্তি হয় কোম্পানির। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত সিএনটিআইসি-র ম্যানেজার ছাং হুই পো বলেন "এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। ঢাকায় মাঝে মাঝে বিদ্যুত্ বিভ্রাট ঘটে, লোডশেডিং হয়। রাজধানীতে যখন বিদ্যুতের সংকট আছে, তখন গোটা দেশের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। এ পর্যন্ত আমাদের প্রকল্পের ৫৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করি এ প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে আমাদের কোম্পানি সুনাম অর্জনে সক্ষম হবে।"

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকটের অনেকটা সমাধান হবে। পাশাপাশি এ প্রকল্পে বহু কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ছাং হুই পো বলেন, "প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা চেষ্টা করেছি যথাসম্ভব স্থানীয় কর্মী নিয়োগ করতে। এ পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় আমরা এক হাজার স্থানীয় কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা সবাই এখানে কাজ করছেন। স্থানীয়দের সাথে কোম্পানির চীনা কর্মীদের যোগাযোগ আছে। এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়ও হচ্ছে। বাংলাদেশিরা কোম্পানির চীনা কর্মীদের মাধ্যমে আমাদের কোম্পানি, আমাদের দেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারছে।"

দক্ষিণ রেশমপথ এবং সামুদ্রিক রেশমপথের সংযোগস্থল হিসেবে বাংলাদেশ 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং 'এক অঞ্চল, এক পথ' ধারণা তুলে ধরার পর, বাংলাদেশ তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়। ফলে বাংলাদেশে চীনা কোম্পানিগুলোও এ থেকে উপকৃত হয়।

বস্ত্রবয়ন কোম্পানি চিনচিংয়ের দায়িত্বব্যক্তি হান চিং চাও ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদশে ব্যবসা করছেন। ১৩ বছর পর এখন এ কোম্পানির কর্মী ৭ জন থেকে বেড়ে কয়েক ডজনে দাঁড়িয়েছে। চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং বাংলাদেশ 'এক অঞ্চল, এক পথ, কৌশল'-এর গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ। গত ১০ বছরে, অবকাঠামো ও বস্ত্র খাতে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করেছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, এবং দেশটির শিল্পের উত্পাদন মূল্য হবে ৪০০০ কোটি ডলার। এটা চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য ভাল একটি সুযোগ।"

'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশল থেকে বাংলাদেশে চীনা কোম্পানিগুলো কীভাবে উপকৃত হয় বা হচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএনটিআইসি-র বাংলাদেশে নিযুক্ত ম্যানেজার ছাং হুই পো বলেন, "'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশল চালু হবার পর, বহু দেশই একে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে। এদিকে, বিদেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর চীনা কোম্পানিগুলো গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে এবং এক্ষেত্রে চীনা সরকারও কোম্পানিগুলোকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এ কৌশল বাস্তবায়নে চীনা সরকারের দৃঢ়তা দেখে বহু দেশ আস্থাশীল হয়েছে এবং এ কৌশলের সাথে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত হয়েছে।"

বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি এবং অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে স্বল্পোন্নত। দেশগঠন ও উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছাও দু'দেশের সহযোগিতার জন্য ভাল সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক চীনা রাষ্ট্রদূত ছাং সিয়ান ই এ প্রসঙ্গে বলেন, "ঢাকায় আমি বাংলাদেশের রাজনীতিজ্ঞ ও পন্ডিতদের সঙ্গে রেশমপথ নিয়ে আলাপ করেছি। তারা সবাই একটি নতুন রেশমপথ নির্মাণের ব্যাপারে একমত। দেশের সমৃদ্ধি ও জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই বাংলাদেশ সরকার চীনের সাথে সহযোগিতা করতে চায়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভাল। এখানে আছে ভালো বন্দর এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। বাংলাদেশের লোকসংখ্যা যেমন একদিকে একটি বড় ভোক্তাবাজার সৃষ্টি করেছে, তেমনি অন্যদিকে সৃষ্টি করেছে শ্রমবাজার। ভবিষ্যতে, দু'দেশ সড়কপথ, রেলপথ এবং বন্দর নির্মাণসহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।"

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত 'অপ্পো' একটি স্মার্ট ফোন ও মোবাইল ইন্টারনেট কোম্পানি। ২০১৪ সালের জুন মাসে এ কোম্পানি বাংলাদেশে এর ব্যবসা শুরু করে। তখন বাংলাদেশে স্মার্টফোন বাজার ছিল প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। দেশ-বিদেশের নানা কোম্পানি আগেই বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত অপ্পোর দায়িত্বশীল ব্যাক্তি চাও চুন মেই বলেন, "স্মার্টফোন আমাদের মূল ব্যবসা। স্যামসাং ও হুয়া ওয়েসহ নানা ব্র্যান্ড আমাদের আগেই বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রবল। তবে আমরা ভেবেছি, বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি এবং ভোগ্যপণ্যের বাজারের সুপ্তশক্তি বিশাল। তা ছাড়া, চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো বলে অনেক চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক।"

চাও চুন মেই বলেন, বাংলাদেশের মানুষ চীনা পণ্যের ওপর আস্থাশীল; চীনা কোম্পানিগুলোও এখানে স্বীকৃত। তিনি বলেন, "চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে নানা ক্ষেত্রে ব্যবসা করছে এবং সুনাম অর্জন করেছে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি দেখলাম যে, তারা চীনা ব্র্যান্ড ও চীনা কোম্পানির ওপর আস্থাশীল। এটা আমাদের ব্যবসার জন্য ভাল একটি দিক।"

দু'বছর পর, এখন অপ্পোর বিক্রয়কেন্দ্র ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং খুলনাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে। এসব বিক্রয়কেন্দ্রে কর্মীর সংখ্যা ১৩০০ জন, যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। চাও চুন মেই জানান, ভবিষ্যতে তারা আরও বেশি স্থানীয় কর্মী নিয়োগ করবেন এবং অচিরেই স্থানীয় কর্মীর সংখ্যা দু'হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

গত দু'বছরে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ চাও ছুন মেইর মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ খুবই ভালো। তারা অন্যকে সাহায্য করতে পছন্দ করে। সমস্যায় পড়লে তারা অজান-অচেনা লোকের সাহায্যেও এগিয়ে আসে।

মোদ্দাকথা, বাংলাদেশের সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ইতোমধ্যই পৌঁছেছে এক নতুন উচ্চতায়। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের পর সে উচ্চতা আরও বাড়বে এবং দু'দেশের মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হবে বলে আশা করা যায়। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040