চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় ঘনিষ্ঠতর: সাবেক রাষ্ট্রদূত চাং সিয়ান ই
  2016-10-13 16:18:24  cri
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর ক্যাম্বোডিয়া ও বাংলাদেশ সফর করবেন এবং ভারতের গোয়া'তে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের অষ্টম শীর্ষসম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। গত ৩০ বছরে কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের এটি হবে প্রথম বাংলাদেশ সফর। প্রশ্ন হচ্ছে: চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন? প্রেসিডেন্ট সি'র বাংলাদেশ সফরের তাত্পর্য কী? এসব প্রশ্নের উত্তর উঠে এসেছে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক চীনা রাষ্ট্রদূত চাং সিয়ান ই'র কথায়। তিনি সম্প্রতি সিআরআইয়ের সংবাদদাতেকে একটি বিশেষ সাক্ষাত্কার দেন।

২০১০ সালে চীন ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৩৫তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে তখনকার ভারপ্রাপ্ত চীনা ভাইস প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তখন রাষ্ট্রদূত চাং সিয়ান ই বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। সে-সময় দু'দেশের যৌথ বিবৃতিতে সার্বিক সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। তাঁর কার্যমেয়াদে দু'দেশের মন্ত্রী পর্যায়ে ৪০ বারেরও বেশি সফর বিনিময় হয় বলে জানান রাষ্ট্রদূত চাং।

 

সম্পর্ক উন্নয়নের সুফল পেয়েছে দু'দেশই। ২০০৯ সালে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১২ সালে তা ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ পরিমাণ ১৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের বেশকিছু পণ্যকে শুল্কমুক্ত ঘোষণা করার পর, চীনে বাংলাদেশের রফতানি আগের চেয়ে ৯০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশে চীনা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজি বিনিয়োগও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

দু'দেশের মধ্যে বিমান চলাচল সহজতর হওয়ায় একদিকে বাংলাদেশে চীনা ব্যবসায়ীর সংখ্যা যেমন অনেক বেড়ে গেছে, তেমনি চীনে বেড়েছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। ইউয়ুননান প্রদেশের খুনমিং শহরে তো একটি বাঙালি গ্রাম আছে, যেখানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বসবাস। দু'দেশের মধ্যে সংস্কৃতি ও শিক্ষা খাতেও বিনিময় বেড়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের ২০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী চীনের সরকারি বৃত্তি পেয়ে থাকেন। আর কনফুসিয়াস ক্লাসরুম ও কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে চীনা ভাষা শেখার গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে তার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত চাং বলেন, চীনাদের প্রতি বাংলাদেশিদের আন্তরিকতা তার মনে সবচেয়ে বেশি ছাপ ফেলেছে। তিনি বলেন,

"কূটনীতিক হিসেবে আমি ইউরোপ ও আফ্রিকায় কাজ করেছি। যদি তুলনা করি, তবে বলতেই হবে যে, বাঙালিরা অতিথিপরায়ণতার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে। বিশেষ করে চীনাদের সাথে তাদের যোগাযোগের সময় বাঙালিদের আন্তরিকতা চোখে পড়ার মতো।"

রাষ্ট্রদূত চাং আরও বলেন, দু'দেশের মধ্যে অভিন্ন সীমান্ত নেই। তারপরও দু'দেশ পরস্পরের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বসূলভ। দু'দেশের জনগণের মধ্যে আদান-প্রদান বাড়লে, চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী আরও শক্তিশালী হবে বলে বিশ্বাস করেন মিস্টার চাং।

'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশলের আওতায় বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার সুপ্তশক্তি প্রবল। ইতিহাসে বঙ্গ এলাকা প্রাচীন দক্ষিণ রেশমপথ ও সামুদ্রিক রেশমপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল ছিল। রেশমপথের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হবার উজ্জ্বল সাক্ষী বাংলাদেশ। আর এ কারণেই চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশল বাংলাদেশের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। রাষ্ট্রদূত বলেন,

"ভোগৌলিক দিক থেকে দেখলে, বাংলাদেশের অবস্থান অতি গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির বন্দর ভালো এবং এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস আছে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। তার মানে এখানে একটা বড় বাজার আছে। আর বেশি জনশক্তি মানে, শ্রমের খরচও কম। অনেক দেশের কাছেই বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য একটি ভালো জায়গা।"

বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হবে। রেলপথ ও বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ খাতে চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার ব্যাপক সম্ভাবনাও রয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, কৃষি, শিক্ষা ও গণস্বাস্থ্যেও রয়েছে পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ। পাশাপাশি চীন ও বাংলাদেশ 'বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর' নির্মাণকাজেও পরস্পরের সহযোগী। এই প্রেক্ষাপটে চীনা প্রেসিডেন্ট সি'র বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত চাং বলেন, এবারের সফর দু'দেশের আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

সি চিন পিংয়ের এবারের সফর হবে গত ৩০ বছরে কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের প্রথম বাংলাদেশ সফর। এটা দু'দেশের জন্যই তাত্পর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। রাষ্ট্রদূত বলেন,

"কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, একটি দেশে অন্য দেশের শীর্ষনেতার সফর এমনিতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ ধরনের সফরে দু'দেশের নেতৃবৃন্দ অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিনিময় করেন। এ ধরনের সভা থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার হয় এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবার সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে।"

২০১০ সালে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সি চিন পিং বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। আবার বেইজিংয়ে এবং বিশ্বের অন্যান্য ফোরামে প্রেসিডেন্ট সি'র সঙ্গে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের একাধিকবার দেখা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তার পুরনো বন্ধু। উনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকাকালে চীন সফর করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও প্রেসিডেন্ট সি'র দেখা-সাক্ষাত হয়েছে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট সি এবার বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রদূত চাং বলেন,

"চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে এবং দু'দেশের সম্পর্ক বর্তমানে মধুরতম সময়পর্ব অতিক্রম করছে। এবারের সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যত উন্নয়নপথ নির্ধারণ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।" (সুবর্ণা/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040