পুবের জানালা: চীনের 'গোল্ডেন সপ্তাহ'
  2016-10-12 10:32:33  cri



১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা রাষ্ট্রীয় পরিষদের এক সিদ্ধান্ত চীনে 'গোল্ডেন উইক' বা 'স্বর্ণসপ্তাহ' সৃষ্টি করে। 'স্বর্ণসপ্তাহ' আসলে সাত দিনের সরকারি ছুটি। তখন থেকে বছরে তিন বার চীনারা টানা সাত দিন করে সরকারি ছুটি ভোগ করার সুযোগ পায়। বসন্ত উৎসব, জাতীয় দিবস, ও শ্রমিক দিবস—এই তিনটি উপলক্ষ্যে তিনটি 'স্বর্ণসপ্তাহ' পেতে শুরু করেন তারা। অবশ্য, ২০০৮ সালে শ্রমিক দিবসের সাত দিন ছুটি বাতিল করে তিন দিন করা হয়। অর্থাত 'স্বর্ণসপ্তাহ' কমে দু'টিতে দাঁড়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে: চীনারা 'স্বর্ণসপ্তাহ' কীভাবে কাটায়? আজকের 'পুবের জানালা'য় আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।

চীনারা প্রথম 'স্বর্ণসপ্তাহ' পায় ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে। তখন জাতীয় দিবসে তারা টানা সাত দিন ছুটি কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তো, সেই সাত দিনে ২ কোটি ৮০ লাখ চীনা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন। সে সময় পর্যটন খাতে আয় হয় ১৪১০ কোটি ইউয়ান।

তখনকার হিসেবে ২ কোটি ৮০ লাখ পর্যটক ও ১৪১০ কোটি ইউয়ান পর্যটন আয় অনেক বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা 'স্বর্ণসপ্তাহ' শুরুর ১২ ঘন্টার মধ্যেই ছাড়িয়ে যায়। চলতি বছরের জাতীয় দিবস 'স্বর্ণসপ্তাহে' চীনে অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাজার গমগম করেছে ৫৮ কোটি ৯০ লাখ পর্যটকে। এ সময় পর্যটন খাতে আয় হয়েছে ৪৭,৮১৮ কোটি ইউয়ান। তার মানে, ১৮ বছর আগের তুলনায় এবার জাতীয় দিবসের 'স্বর্ণসপ্তাহে' পর্যটক ও পর্যটন-আয় বেড়েছে বহুগুণ।

গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে জন্মগ্রহণকারী ইং জি'র এখনও মনে আছে ১৮ বছর আগের প্রথম 'গোল্ডেন সপ্তাহ' কাটানোর স্মৃতি। গোটা পরিবার নিয়ে তিনি থাই শান (থাই পাহাড়) বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেবারই প্রথম তিনি সপরিবারে কোথাও বেড়াতে বের হন। তখন পরিস্থিতি পর্যটনের জন্য খুব ভালো ছিল না। তিনি জানালেন, তখন হোটেলে কক্ষ পাওয়া কঠিন ছিল। অনেক অপেক্ষার পর একটা রুম পাওয়া গিয়েছিল। থাই শানে যাওয়ার আগে তিনি কয়েকটি মুর্গি রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জানান, থাই শানের শীর্ষে একটি নুডলসের দাম ২০ ইউয়ান ছিল। তাই তিনি তার শিশু-সন্তানের জন্য মাত্র এক প্যাকেট নুডলস কিনেছিলেন। প্রখম 'গোল্ডেন সপ্তাহ'-এ ভ্রমণ একাধারে ছিল কঠিন ও মধুর। তখন থেকে ছুটিতে ভ্রমণ ইং জি'র জীবনের অংশে পরিণত হয়। থাই শান দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। এ পর্যন্ত দেশের বাইরেও বহু জায়গায় ভ্রমণ করেছেন ইং জি।

সাং হাই শহরের নাগরিক থাও জেং রুই মাত্র অবসর নিয়েছেন। ১৮ বছর আগের সাথে বর্তমানের তুলনা করে তিনি বলেন, প্রথম গোল্ডেন সপ্তাহে আমি ফোনে একটি হোটেলকক্ষ রিজার্ভ করি। ১৮ বছর পরে এসেও আমি ফোনের মাধ্যমেই হোটেলকক্ষ রিজার্ভ করি। তবে, এখন আমি অ্যানালগ ফোনের পরিবর্তে ব্যবহার করি স্মার্টফোন এবং স্মার্টফোন অ্যাপ। হোটেলে ফোন করা থেকে স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে রিজার্ভেশন—১৮ বছরে ভ্রমণকাজ কঠিন থেকে সহজ ও সুবিধাজনক একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

সিয়ে ছেং, চীনের বৃহত্তম ভ্রমণ রিজার্ভেশন ওয়েবসাইট। এ পযর্ন্ত সিয়ে ছেং অ্যাপ্লিকেশন ২৩০ কোটি বার ডাউনলোড করা হয়েছে। চীনের ৭০ শতাংশ রিজার্ভেশন স্মার্টফোনের মাধ্যমে করা হয়। ১৮ বছর আগে সিয়ে ছেং ফোনে হোটেল রিজার্ভেশন বা দোকানে রিজার্ভেশন সেবা দিত। এখন লোকেরা স্মার্টফোনের মাধ্যমে ভ্রমণসংক্রান্ত সব কাজই করতে পারে।

পরিবহনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। জাতীয় দিবসের ছুটিতে ফু চিয়ান প্রদেশের ফু চৌ শহরের ব্যবসায়ী লিউ হং তার পরিবার নিয়ে জন্মস্থান লং ইয়ান জেলায় ফেরেন। তিনি বলেন, দশ বারো বছর আগে যখন তিনি বিয়ে করে জন্মস্থান ছেড়ে বাইরে যান, তখন ৪টি পাহাড় অতিক্রম করার পর সড়কপথের সন্ধান মিলতো। ১৮ বছর আগে প্রতিদিন ৩টি ট্রেন লং ইয়ান জেলায় আসতো। আর এখন অন্তত ৬০টি হাইস্পিড ট্রেন আসে লং ইয়ানে।

লং ইয়ান রেলস্টেশনের পরিচালক জানান, হাইস্পিড ট্রেন চালু হওয়ার পর বাইরে থেকে এখানে বেড়াতে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ১৮ বছর আগে চীনা মানুষ হাইস্পিড ট্রেন সম্পর্কে কিছুই জানতো না। এখন চীনে হাইস্পিড রেলপথের দৈর্ঘ্য ২০ হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। গত পয়লা অক্টোবর এক দিনে চীনে এক কোটি ৪৪ লাখ চীনা মানুষ হাইস্পিড ট্রেন ব্যবহার করেছেন।

চীনে সড়কপথও উন্নত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে চীনে সড়কপথের দৈর্ঘ্য মাত্র ১০ হাজার কিলোমিটার ছিল। বর্তমানে তা বেড়ে ৯৬ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। সড়কপথের দৈর্ঘ্যের বিচারে বিশ্বে চীনের অবস্থান এক নম্বরে।

সড়কপথের দৈর্ঘ্য ও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ায়, নিজে গাড়ি চালিয়ে ভ্রমণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১৫ সালে চীনের অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের ৫৮.৫ শতাংশই নিজে গাড়ি চালিয়ে ভ্রমণ করেছেন। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা বেড়ে ৭০ শতাংশে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

১৯৯৯ সালে বেইজিং বিমানবন্দরের দুই নম্বর টার্মিনাল চালু হয়। তখন প্রতিদিন বিমানবন্দরে মাত্র ৪০০টি ফ্লাইট উঠানামা করতো। তখন পর্যটনমৌসুমেও যাত্রীর সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ হাজার হতো। তখনও বিমানে ভ্রমণ তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। এখন ৩ নম্বর টার্মিনাল চালুর পরও বিমানবন্দরের ওপর চাপ অনেক বেশি। প্রতিদিন ফ্লাইটের সংখ্যা ১৭০০টির বেশি এবং যাত্রীসংখ্যা দুই লক্ষাধিক। তাই বেইজিংয়ে নতুন একটি বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

গত বছরের শেষ নাগাদ পর্যন্ত, চীনে পাঁচতারা হোটেলের সংখ্যা ১৫ হাজার, ট্রাভেল এজেন্সি ২৭ হাজারটি এবং নানা ধরনের দর্শনীয় স্থান ছিল ২০ হাজারের বেশি। পরিবহন ও অবকাঠামোর উন্নয়নের ফলে মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারছে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে, চীনে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২২৩ কোটি ৬ লাখ। আর এ ৬ মাসে পর্যটন খাতে আয় হয়েছে ১.৮৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান। তা ছাড়া, উক্ত ছয় মাসে ৫ কোটি ৯০ লাখ চীনা বিদেশে ভ্রমণ করেছেন। এ সংখ্যা ইতালির মোট জনসংখ্যার সমান।

'গোল্ডেন সপ্তাহ' চীনের অর্থনীতি বিশেষ করে পর্যটনশিল্পের জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে। পর্যটন সম্পর্কে মানুষের ধারণাও দিন দিন বদলাচ্ছে। চলতি বছরের জাতীয় দিবসের ছুটিতে বিদেশে চীনা পর্যটকদের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৮ হাজার ইউয়ান এবং অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৮০০ ইউয়ান। চীনাদের আর্থিক সঙ্গতি বেড়েছে এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভ্রমণের চাহিদা। এখন চীনারা 'গোল্ডেন সপ্তাহ'-এর বাইরেও ভ্রমণ করতে চায়।(শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040