চীন-বাংলাদেশ 'ওয়েলফেয়ার টিকেট' প্রকল্প:দরিদ্র লোকদের আশার আলো
  2016-10-10 11:28:32  cri

 


আজকের অনুষ্ঠানে আমরা একটি বিশেষ প্রতিবেদন শোনাবো। তাতে বাংলাদেশের দরিদ্র লোক, বিশেষ করে আর্থিক কারণে বিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া বাচ্চাদের সাহায্য সম্পর্কিত চীন ও বাংলাদেশের 'ওয়েলফেয়ার টিকেট' প্রকল্প চালুর তথ্য তুলে ধরা হবে।

চলুন তাহলে শোনা যাক প্রতিবেদনটি।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রথমবারের মতো 'রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল' এবং 'একবিংশ শতাব্দীর সামুদ্রিক রেশমপথ' অর্থাত্ 'এক অঞ্চল, এক পথ' চিন্তাধারা উত্থাপন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ বছরের মধ্যে 'এক অঞ্চল, এক পথ' সংলগ্ন ৩০টিরও বেশি দেশের সাথে বহু সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চীন। এই পথ সংলগ্ন দেশগুলোর অন্যতম এবং 'বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর'-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা দিন দিন উন্নত হচ্ছে এবং চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বিভিন্ন খাতের সহযোগিতা ও আদান-প্রদানও দিন দিন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের দরিদ্র লোকদের জীবনযাপনের মান উন্নত করার উদ্দেশ্যে বেইজিং চোংছাই প্রিন্টিং লিমিটেড কোম্পানির এক প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় তারা স্থানীয় অঞ্চলের একটি দাতব্য সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নে দরিদ্র লোকদের সাহায্য প্রদান করার আশা প্রকাশ করেন।

প্রতিনিধিদলটির প্রধান চোংছাই প্রিন্টিং লিমিটেড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মি. হান বিন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,

'বাংলাদেশ যাওয়ার আগে আমরা ওয়েবসাইট থেকে তথ্য ও ছবি দেখে স্থানীয় অঞ্চলের অবস্থা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাই, তবে তা শুধু কল্পনার বিষয়। বাংলাদেশে পৌঁছার পর লোকজনের ভিড়ের দৃশ্য দেখে অনেক অবাক হই। হোটেলে যাওয়ার পথে ঢাকা শহরের গুরুতর ট্রাফিক জ্যামও অনুভব করি। তবে বাংলাদেশ সফর ও গবেষণার মাধ্যমে আমি মনে করি, দেশটি এখন একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং এ দেশে উন্নয়নের সুপ্ত-শক্তি বেশি। যদি বাংলাদেশের মানবসম্পদের সরবরাহ সমস্যা ভালো করে সমাধান করা যায় তাহলে তা স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে অনেক সহায়ক হবে। দেশটির অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজেও অনেক উন্নতি প্রয়োজন। স্থানীয় অঞ্চলের লোকদের প্রাণবন্ত আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বসুলভ চরিত্র আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে'।

বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ ও সংস্কারনীতি চালুর শুরুতে চীনেও দরিদ্র লোকের সংখ্যা ছিলো প্রচুর। দেশের দরিদ্র লোকদের সহায়তা দেওয়া, ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে ব্যবধান কমানো এবং দরিদ্র লোকদের সুষ্ঠু জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সাল থেকে 'ওয়েলফেয়ার টিকেট' প্রকল্প চালু করতে শুরু করে চীন সরকার। এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে চীন সরকার সাফল্যের সঙ্গে দরিদ্রদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করছে এবং এ কাজ অন্যান্য দেশের ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকল্পের উন্নয়নে অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে।

বেইজিং চোংছাই প্রিন্টিং লিমিটেড কোম্পানি চীনের অসামরিকবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন চীনের ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকাশনা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত। চীন সরকারের নেতৃত্বাধীন এক সংস্থা হিসেবে ওয়েলফেয়ার টিকেট ডিজাইন, ছাপানো ও প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করে কোম্পানিটি।

চীনের ওয়েলফেয়ার টিকেটের প্রকাশনার সংখ্যা ও বাংলাদেশে এমন প্রকল্প চালু করার তাত্পর্য নিয়ে মি. হান বিন বলেন,

'বর্তমানে চীনের অবস্থা থেকে বলা যায়, প্রতি বছর এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে চীন সরকার প্রায় ১০ হাজার কোটি ইউয়ান কল্যাণমূলক অর্থ পেয়ে থাকে, তা দৃঢ়ভাবে চীনের কল্যাণ ও দাতব্য কাজে সমর্থন যুগিয়েছে। এ অর্থ চীনের দরিদ্র ও প্রতিবন্ধীদের জীবনযাপনে ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে চীনের ওয়েলফেয়ার টিকেট সাধারণ জনগণের জীবনযাপনের একটি বিনোদনের পদ্ধতিতেও পরিণত হয়েছে। ওয়েলফেয়ার টিকেট ক্রয়ে দরিদ্র লোকদের সাহায্য দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও কিছুটা বিনোদন অনুভব করা যায়। বাংলাদেশের অবস্থা ৩০ বছর আগের চীনের মতো। দেশটিতে লোকসংখ্যা প্রচুর, দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেশি এবং সরকারের অর্থ বাজেটের অভাব। তাই চীন সরকারের ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত'।

ওয়েলফেয়ার টিকেট সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের কল্যাণের সাথে জড়িত, তাই বিশ্বের যে কোনো দেশ এ প্রকল্প চালু ও প্রকাশনায় কঠোর নীতিমালা ও তত্ত্বাবধান-ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করেছে। গভীর ও দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে চোংছাই প্রিন্টিং লিমিটেড কোম্পানির এবার বাংলাদেশ সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল স্থানীয় বাজার পরিদর্শন ও গবেষণা করা এবং তাদের পেশা বিবেচনা অনুসারে দেশটির প্রকল্পের কার্যকর নির্বাহী প্রকল্প প্রণয়ন করা। এ সম্পর্কে মি. হান বলেন,

'এবার আমরা স্থানীয় অঞ্চলের একটি দাতব্য সংস্থার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফর করি এবং এখানকার ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকাশনা সম্পর্কে বাজার গবেষণা ও পরিদর্শন করি। এ দাতব্য সংস্থার মূল লক্ষ্য হল দরিদ্র লোকদের সহায়তা করা। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সাফল্যের সঙ্গে ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকল্প চালু করতে দেখে তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। এবার আমাদের সফরের মূল বিষয় স্থানীয় অঞ্চলের ওয়েলফেয়ার টিকেট বাজার পরিদর্শন করা এবং তাদের জন্য আরো নিরাপদ ও আস্থাবান প্রস্তাব প্রদান করা'।

মি. হানের উল্লেখ করা বাংলাদেশের দাতব্য সংস্থাটির নাম পেট্রোনজরুল বাংলা ডিভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিবিডিএফ)। এ সংস্থার উদ্দেশ্য হল বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা, নারী, শিশু ও দরিদ্র লোকদের অধিকার রক্ষা করা। ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকল্প বাংলাদেশের দরিদ্র ও প্রতিবন্ধী লোকদের জীবনযাপনের উন্নয়নে কাজে আসবে বলে আশা করে তারা। এ সম্পর্কে পিবিডিএফ-এর চেয়ারম্যান মি. নজরুল ইসলাম মোল্লা বলেন,

ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকল্পের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বর্তমানে চোংছাই প্রিন্টিং লিমিটেড কোম্পানির প্রধান ব্যবসার অন্যতম। বিশেষ করে চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' চিন্তাধারা সংলগ্ন দেশের সাথে সহযোগিতার ব্যাপক সম্প্রসারণের কারণে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে'। পিবিডিএফের সহযোগিতা নিয়ে মি. হান বলেন,

'বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং 'এক অঞ্চল, এক পথ' চিন্তাধারার গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। চীনের উন্নয়নের সফল অভিজ্ঞতা নিয়ে তাদের সহায়তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকল্পের উদাহরণ নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের এমন চাহিদা থাকলে আমরা আমাদের পেশাগত দক্ষতার মধ্য দিয়ে তাদের কল্যাণমূলক অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়তা দিতে আগ্রহী। সহযোগিতার বিস্তারিত বিষয় বলতে গেলে আমরা মূলত তিন ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকি। নিরাপদ ও আস্থাবান ওয়েলফেয়ার টিকেট তৈরি ও ছাপানো। বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রদান করা এবং অভিজ্ঞ ও পেশাগত পরামর্শ সেবা দেওয়া'।

জানা গেছে, সম্প্রতি বেইজিং চোংছাই প্রিন্টিং লিমিটেড কোম্পানির ডিজাইনে পিবিডিএফের প্রকাশনায় 'স্ক্র্যাচিং' (নখ দিয়ে ঘষে তুলে ফেলা) ওয়েলফেয়ার টিকেট বাংলাদেশের বাজারে প্রকাশিত হয়েছে। এ টিকেটের তিন ধরনের মূল্য নির্ধারণ করা রয়েছে। যেমন- ২০টাকা, ৫০টাকা ও ১০০টাকা। পুরস্কারের মূল্য টিকেটের মূল্য অনুসারে ১ লাখ টাকা, ৫ লাখ টাকা ও ২০ লাখ টাকা।

এই স্ক্র্যাচিং টিকেট মানে টিকেটের ওপর আচ্ছাদিত নম্বর বা ছবিতে বিশেষ প্রলেপ থাকে, ক্রেতারা টিকেট ক্রয়ের এক সেকেন্ড পর নোটিশ অনুসারে বুঝতে পারেন তারা পুরস্কার পেয়েছেন কিনা, যা খুবই সহজভাবে বোঝা যায়। প্রিন্টিং ও প্রকাশনার খরচ ছাড়া এই ওয়েলফেয়ার টিকেটের অধিকাংশ আয় বাংলাদেশ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে, যাতে স্থানীয় অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ ও দরিদ্র লোকদের সহায়তা করা যায়।

এবার বাংলাদেশের বাজার পরিদর্শনের পর ভবিষ্যতে দু'দেশের ওয়েলফেয়ার টিকেটবিষয়ক সহযোগিতার প্রতি আশাবাদী মি. হান। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,

'বাংলাদেশের কল্যাণমূলক কাজের প্রতি আমি আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। শহরের লোকসংখ্যা অনেক বেশি ও ভিড়, যা কল্যাণমূলক কাজের জন্য ভালো পরিবেশ গড়ে তুলেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে কম্বোডিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও একই ধরনের কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছি, এ পর্যন্ত সফলভাবে তা চালু হয়েছে। বিশ্লেষণ ও বিবেচনায় বাংলাদেশ কম্বোডিয়ার চেয়ে আরো বেশি প্রাধান্যে রয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমরা নিজের কোম্পানির প্রতি আশাবাদী। গত ২৩ বছরের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আমাদের ওয়েলফেয়ার টিকেটের গুণগতমান ও বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বিশ্লেষণের দক্ষতা বিশ্বের শীর্ষ মানে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করি। আমাদের সহায়তায় বাংলাদেশের বাজার সুষ্ঠুভাবে চলতে পারবে বলে বিশ্বাস করি'।

চীন সরকারের উদ্যোগে বর্তমানে চোংছাই প্রিন্টিং লিমিটেড কোম্পানি 'এক অঞ্চল, এক পথ' চিন্তাধারা সংলগ্ন অনেক দেশের সাথে যোগাযোগ করছে। বর্তমানে কম্বোডিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় সহযোগিতা চালু করেছে। অদূর ভবিষ্যতে চীনের ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকল্পের সফল অভিজ্ঞতা বিশ্বের আরো বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হবে এবং আরো বেশি উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র লোকদের জন্য আশার আলো বয়ে আনবে।

সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, এতক্ষণ আপনারা বেইজিং চোংছাই প্রিন্টিং লিমিটেড কোম্পানির বাংলাদেশ সফর ও দেশটিতে ওয়েলফেয়ার টিকেট প্রকল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন শুনলেন। আজকের অনুষ্ঠান শেষ করার আগে আপনাদের জন্য একটি সুন্দর গান প্রচার করবো। গানের নাম......

বন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আমাদের অনুষ্ঠানও তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে এলো। এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে আমাদের চিঠি লিখতে ভুলবেন না। আমাদের যোগাযোগ ঠিকানা ben@cri.com.cn এবং ফেসবুক ben@cri.com.cn।

রেডিও'র মাধ্যমে আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে মিস করলে আমাদের ওয়েবসাইটে শুনতে পারবেন। আমাদের ওয়েবসাইটের ঠিকানা www.bengali.cri.cn।

তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। থাকুন সুন্দর ও আনন্দে। আগামী সপ্তাহে একই দিন একই সময় আবারো কথা হবে। চাইচিয়ান। (সুবর্ণা/টুটুল)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040