0928
|
২২ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব গাড়িমুক্ত দিবস। আজকাল গোটা বিশ্বেরই গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে; বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণ, পার্কিং সমস্যা, যানজট ইত্যাদি। যেহেতু শহরে গাড়ির সংখ্যা বেশি, তাই সমস্যাগুলোও শহরেই বেশি। এমনি এক প্রেক্ষাপটে বিশ্বে গাড়িমুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে আজকাল। আধুনিক সমাজে গাড়ি যে একটি সমস্যা, গাড়িমুক্ত দিবস পালনের সিদ্ধান্তই তার প্রমাণ। শুধু ঘটা করে গাড়িমুক্ত দিবসই পালিত হচ্ছে, তা নয়; আজকাল সাইকেল ও নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ির ব্যবহারও বেড়েছে। বেইজিংয়ের মতো বড় শহরগুলোতে ট্যাক্সি ভাগাভাগির সংস্কৃতিও চালু হয়েছে।
১৩০ বছর আগে, প্রথম গাড়ি আবিষ্কৃত হয়েছিল। গাড়িশিল্পের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিও ঘটতে থাকে দ্রুত। দ্রুততম সময়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছানোর অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয় মোটরগাড়ি। মানুষ খুব তাড়াতাড়িই গাড়ির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
সংস্কার কার্যক্রম শুরু এবং দেশটির অর্থনীতি বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করলে, চীনের সাধারণ মানুষের জীবনেও দ্রুত গাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে। আগে চীনের রাস্তায় দেখা যেত সাইকেল আর সাইকেল। কিন্তু বর্তমানে সাইকেল আরোহীর সংখ্যা অনেক কমেছে, ব্যাপকভাবে বেড়েছে গাড়ির সংখ্যা। চীনা পুলিশ বিভাগের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনে বর্তমানে মোটরগাড়ির সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি ৪০ লাখ।
গাড়ি যেমন বাড়ছে, তেমনি বেইজিংয়ের মতো মহানগরগুলোতে গাড়িসৃষ্ট সমস্যাও দিন দিন বাড়ছে। একটি গাড়ি পার্ক করাতে ৮ থেকে ১০ বর্গমিটার জায়গা প্রয়োজন। বড় শহরে প্রতি বর্গমিটার জায়গার মূল্য দশ থেকে বারো হাজার ইউয়ানের বেশি। তার মানে, পার্কিং স্থানের দাম একটি বিলাসবহুল গাড়ির দামের সমান। বড় শহরগুলোতে ট্রাফিক জ্যামও গুরুতর একটি সমস্যা। সাংহাই ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ, সাংহাই শহরে গাড়ির সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখ ৪০ হাজার ৪০০টি। যদি প্রতিটি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ৮ বর্গমিটার জায়গা লাগে, তবে এসব গাড়ির জন্য মোট জায়গা লাগবে ২৩ বর্গকিলোমিটার। অথচ সাংহাইয়ের একটি গোটা অঞ্চলের আয়তনও এতো বেশি নয়! সুতরাং, একদিকে ক্রমবর্ধমান গাড়ির জন্য রাস্তার ওপর চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে পার্কিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে না।
তেলচালিত গাড়ি থেকে নিঃসৃত গ্যাসও বায়ুদূষণের একটি অন্যতম কারণ। এ কথা সত্য, আজকাল নতুন ধরনের জ্বালানিচালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু তেলচালিত গাড়ির তুলনায় এর সংখ্যা খুবই কম। তা ছাড়া, চীনের বড় শহরগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো রাস্তায় চলতেও পারে না। অধিকাংশ সময় সেগুলোকে বসে থাকতে হয়। এক পরিসংখ্যান অনুসারে, বড় শহরগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো দিনে গড়ে মাত্র আড়াই ঘন্টা রাস্তায় চলে। বাকি সময় সেগুলো পার্কিং স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রমবর্ধমান যানজট থেকে বাঁচতেই যে গাড়ির মালিকরা নিতান্ত বাধ্য না-হলে গাড়ি নিয়ে বের হন না, তা বলাই বাহুল্য।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা শুরু হয়। এর পর কেটে গেছে ১৮ বছর। ২০০৭ সাল থেকে চীনা শহরগুলোতেও গাড়িমূক্ত দিবস পালন শরু হয়। গাড়িমুক্ত দিবস পালনের উদ্দেশ্য গাড়িকে রাস্তা থেকে চিরতরে হটিয়ে দেওয়া নয়। এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। মানুষ তেলচালিত গাড়ির ব্যাপক ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সচেতন হবে, নতুন দূষণমুক্ত জ্বালানিচালিত গাড়ির সুফল সম্পর্কে জানবে, গাড়িশিল্পে নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্ক অবগত হবে—গাড়িমুক্ত দিবস পালনের মূল উদ্দেশ এটি।
বড় শহরে, দূরপাল্লার যাত্রার জন্য গাড়ি দরকার। তবে ৫ কিলোমিটার বা তারচে' কম দূরত্বে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির আসলেই দরকার নেই। সাংহাইয়ের যাত্রীরা প্রতিদিন ৫ কোটি বার রাস্তায় যাতায়াত করেন। তাদের যাত্রাপথের দূরত্ব গড়ে ৬.৯ কিলোমিটার। আর তাদের অর্ধেকের যাত্রাপথই ৫ কিলোমিটারের চেয়ে কম।
ভাড়া সাইকেলের মোবাইল অ্যাপ 'মোবাইল সাইকেল'-এর সিইও ওয়াং সিয়াও ফেং জানালেন, প্রতিদিন সাংহাইয়ের রাস্তায় দশ-বারো লাখ গাড়ি চলাচল করে। অথচ এসব গাড়ির ৪০ শতাংশই ৫ কিলোমটারের চেয়ে কম দূরত্ব অতিক্রম করে। আর বেইজিংয়ে প্রতিদিন ৫ কিলোমিটার বা তার চেয়ে কম দূরত্বে চলাচলকারী গাড়ির সংখ্যা ৫২.৯ শতাংশ।
তাহলে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য আমরা কী বিকল্প গ্রহণ করতে পারি? হ্যা, সাইকেল একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। বেইজিংয়ের নাগরিক উ হাই ইয়ান বলেন, বড় শহরে স্বল্প দূরত্বে চলাচলের জন্য বাসের চেয়ে সাইকেল বেশি কার্যকর। বাসা থেকে অফিস যেতে যেখানে ব্যক্তিগত গাড়ি বা পাবলিক বাসে লাগে ১৫-২০ মিনিট, সেখানে সাইকেলে যেতে লাগবে মাত্র ৫ মিনিট।
চীনে বর্তমানে ভাড়ায় সাইকেল পাওয়া যায়। আসলে চীনা হাং চো শহরে অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এ রকমের সেবা। ২০০৮ সালের মে মাসে হাং চৌ চীনের প্রথম শহর হিসেবে চালু করে পাবলিক সাইকেল সেবা। গত ৮ বছরে শহরটিতে সাইকেলস্ট্যান্ডের সংখ্যা ৬১ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৭৪টিতে এবং সাইকেলের সংখ্যা ২৮০০ থেকে বেড়েছে ৮৪ হাজারে। গত ৮ বছরে হাং চৌতে সাড়ে ৬৭ কোটি মানুষ ভাড়ায় সাইকেল ব্যবহার করেছেন।
সাইকেল ছাড়া, নতুন ধরনের জ্বালানিচালিত গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সুযোগও আছে। সাংহাইয়ে, নতুন ধরনের জ্বালানিচালিত গাড়ির কোম্পানির ইভি কার্ড-এর স্থান ১১০০টির বেশি এবং চলতি বছরে সেখানে নতুন ধরনের জ্বালানিচালিত গাড়ির সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তা ছাড়া, এ কোম্পানি এখন বিদ্যুতচালিত বাস ভাড়া নিয়ে গবেষণা করছে এবং কিছু পরীক্ষাও চালাচ্ছে।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে চীনে ৫৭ শতাংশ গাড়ির মালিক একা গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাতায়াত করেন। আর প্রতিদিন অন্তত ৪ কোটিরও বেশি গাড়ির মালিক ভাগাভাগি করে অন্যদের সঙ্গে আফিসে যেতে ইচ্ছুক।
বড় শহরে আজকাল গাড়ি ছাড়া বাইরে যাওয়া একটু অসুবিধাজনক, এটা সত্যি কথা। কোনো কোনো স্থানে গাড়ি সহজে চলাচল করতে পারে, কিন্তু সাইকেল বা ধীরগতির অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না।
বেইজিং, সাংহাই ও সেন চেংসহ অনেক বড় চীনা নগরে আগে সাইকেলের জন্য বিশেষ রাস্তা নেই। এ বিষয়ে আমাদের কিছু কাজ করা উচিত্। বেইজিংয়ের স্থানীয় সরকার সম্প্রতি 'সাইকেল হাইওয়ে' নামক একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনা অনুসারে, চলতি বছরে বেইজিংয়ে নির্মিত হবে ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশেষ সাইকেল রোড। ২০২০ সালে এ রোডের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৩০০০ কিলোমিটারে। অন্যদিকে, পয়লা অক্টোবর থেকে হাং চৌ শহরে চালু হবে পাবলিক সাইকেলবিষয়ক নতুন নিয়মবিধি।
২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১০০টির বেশি শহর 'ভাগাভাগি পরিকল্পনা'-য় যোগ দেয়। পরিবহন, প্রযুক্তিসহ যে কোন জিনিস এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যায়। ধরুন, আপনি নিজের গাড়িটি চালিয়ে প্রতিদিন একা একা অফিসে যান। আপনার প্রতিবেশিও আপনার অফিসের কাছাকাছি অফিস করেন। কিন্তু তার নিজের গাড়ি নেই। এখন আপনি তাকে অর্থের বিনিময়ে প্রতিদিন লিফ্ট দিতে পারেন।
'ভাগাভাগি' নতুন কোনো ধারণা নয়। বলা চলে পুরাতন ধারণার নতুন রূপে প্রকাশ। ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক কিছুই আমরা ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে শিখবো। এতে সময় ও অর্থ দু'ই বাঁচবে। আর গাড়ির ক্ষেত্রে ভাগাভাগির প্রবণতা যতো বাড়বে, ততই পরিবেশের জন্য কল্যাণকর হবে। (শিশির/আলিম)