চীনের কুইচৌ প্রদেশের ইয়াওশান: তরুণ প্রজন্ম যেখানে জাতীয় সংস্কৃতি সুরক্ষায় নিয়োজিত
  2016-09-17 19:42:25  cri
চীনের ইয়াও জাতির ইতিহাস দুই হাজার বছরের। কুইচৌ প্রদেশের রিবো জেলার ইয়াওশান থানা এই ইয়াও জাতিঅধ্যুষিত অঞ্চল। আগে অঞ্চলটি অনেক দরিদ্র ছিল। কিন্তু চীনের কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার দারিদ্র্য বিমোচনকে গুরুত্ব দেওয়ায়, ইয়াওশানের ভাগ্য বদলেছে। থানাটি বর্তমানে ইয়াও জাতির সংস্কৃতি সুরক্ষা ও প্রচারের চেষ্টা করছে। আজকের অনুষ্ঠানের শুরুতে আমি আপনাদেরকে এ সম্পর্কে কিছু কথা বলবো।

ইয়াওশান প্রাচীন গ্রাম ইয়াওশান থানায় অবস্থিত। এটি হল একটি ঐতিহ্যিক প্রাকৃতিক গ্রাম। এখানে আমরা সার্বিকভাবে ইয়াও জাতির সংস্কৃতি অনুভব করতে পারি। এর মধ্যে এখানে ইয়াও জাতির একটি শাখা 'বাইখুইয়াও'-কে জাতিসংঘের ইউনেস্কো মানবজাতির সভ্যতার 'জীবিত জীবাশ্ম' হিসেবে নির্ধারণ করেছে। বাইখুইয়াও'র লোক রীতি-নীতি বৈশিষ্ট্যময় ও সমৃদ্ধ এবং স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যময়। এর মধ্যে বাইখুইয়াও'র পোষাক ও রৌপ্য ঢাক চীনের জাতীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের নামতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

২৮ বছর বয়সী ইয়াও জাতির মেয়ে লু জিনমেই হলেন ইয়াওশান থানায় এক কিন্ডারগাটেনের শিক্ষক। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে তিনি দর্শনীয় স্থানে পথনির্দেশকের পার্টটাইম কাজ করেন। ইয়াও জাতির বৈশিষ্ট্যময় পোষাক পড়েন তিনি; পর্যটকদের শোনান প্রাচীন বৃষকাষ্ঠের গল্প। প্রাচীন কালে বাইখুইয়াওয়ের মানুষ বিমূর্ত প্রতীক দিয়ে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতো। লু জিনমেই বলেন, এ পর্যন্ত তিনি ও ইয়াও জাতির অন্যান্য মেয়ে প্রাচীন সূচিকর্মকে ধারণ করে আছেন। তিনি জানালেন, ইয়াও মেয়েরা নিজেদের বিয়ের পোশাক নিজেরা তৈরি করেন। তিনি বলেন, 'আপনারা আমাদের গ্রামে এলে দেখবেন, প্রতিটি মেয়ে সূচিকর্ম করেন। আমরা একসঙ্গে সূচিকর্ম করি। আমরা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে পড়াকালীনই নিজ নিজ বিয়ের পোষাক তৈরী শুরু করি। একটি খুবই সুন্দর পোষাক তৈরি করতে পারলে ইয়াও মেয়েরা অনেক খুশি হয়। আমাদের মন খারাপ হলেও আমরা সূচিকর্ম করি। সূচিকর্ম আমাদের মন শান্ত করে।'

বাইখুইয়াও মানুষ হৃদয়বান, পরিশ্রমী আর সাহসী। পাহাড়ি অঞ্চলে পরিবহনব্যবস্থা অনুন্নত, তাই একসময় ইয়াওশান থানার অর্থনীতির উন্নয়নের গতি ছিল ধীর। কিন্তু এ অবস্থায়ও ইয়াও মানুষ প্রকৃতিকে সম্মান করে চলেছে, জীবন সম্পর্কে তাদের ঐতিহ্যগত ধারণা ত্যাগ করেনি। এখনও ইয়াওশান গ্রামে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন আছে। আসলে এত ভালভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাচীন বৈশিষ্ট্যময় স্থাপত্যকর্ম সুরক্ষা চীনের খুব কম গ্রামেই করা হয়েছে। অর্থনীতি উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় কীভাবে আধুনিক নির্মাণকাজ ও ঐতিহ্যিক স্থাপত্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা যায়, এটা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এ সম্পর্কে চীনের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সুরক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ থিয়ান ছিং বলেন, 'আমি মনে করি, এ সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামের মানুষ। মানুষই ঐতিহ্যকে ধারণ করে। গ্রামবাসী যদি ঐতিহ্যকে মূল্য দেয়, তবে সেই ঐতিহ্য টিকে থাকে।'

ইয়াওশান এ ধরণের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এখানে আধুনিক পর্যটনশিল্প ও প্রাচীন সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে। এতে একদিকে যেমন গ্রামের মানুষের ভাগ্য বদলেছে, তেমনি প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিও অবিকৃত আছে।

তরুণ হে জিয়ানহুয়া ইয়াওশান থানায় রূপার বাসন বিক্রি করেন। দোকান খোলার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমি ইয়াও জাতির বৈশিস্ট্যময় রূপার বাসন তৈরি ও বিক্রী করি। আমি কয়েক বছর বাইরে লেখাপড়া করার পর জন্মস্থানে ফিরে আসি এবং নিজের দোকান খুলি। আমার মনে হয়, পর্যটকরা ইয়াও জাতির ঐতিহ্যিক জিনিস পছন্দ করবেন।'

তিনি বলেন, এখন তাঁর বছরে আয় প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার ইউয়ান। দোকান খোলার আগে তার আয় ছিল অনেক কম। হে চিয়ানহুয়ার মত আরো অনেক তরুণ-তরুণী লেখাপড়া শেষে জন্মস্থানে ফিরে নিজ নিজ ব্যবসা খুলে বসেছেন।

চৌ গুয়াংসিয়াং হলেন রিবো জেলার 'ইয়াওজিইউন' নামের পর্যটন কোম্পানির ম্যানেজার। তিনি বলেন, জাতীয় সংস্কৃতি ও বৈশিস্ট্যময় পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে এখানে ইয়াও জাতির নাগরিকদের জীপনমান অনেক উন্নত হয়েছে। তিনি বলেন, 'ইয়াওশান থানার প্রায় ৬০ জন নাগরিক আমার কোম্পানিতে কাজ করে। ২০১৩ সালে তাঁদের একেক জনের প্রতিমাসের বেতন ছিল প্রায় এক হাজার ইউয়ান। কিন্তু এখন তাঁদের একেক জনের প্রতিমাসের বেতন বেড়ে ২৩০০ ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাইরে থেকে এখন কাজের সন্ধানে লোকজন গ্রামে ফিরছেন। বিশেষ করে, তরুণ-তরুণীদের অনেকই ফিরে এসেছেন।'

চৌ গুয়াংসিয়ান বলেন, পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে ঐতিহ্যিক শিল্পও উন্নত হচ্ছে। এর মধ্যমে স্থানীয় তরুণ-তরুণীরাও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও শিল্প সম্পর্কে ভালোভাবে জানার সুযোগ পাচ্ছে।

রিবো'র দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক উ বাংদিং বলেন, এখানকার সংখ্যালঘু জাতির সংস্কৃতি সুরক্ষার কাজটি ভালোভাবে হচ্ছে। তিনি বলেন, 'রিবো'র সংস্কৃতির কখনও সংকটে পড়বে না। বিশেষ করে পর্যটনের সাথে সংযুক্ত হওয়ায়, এখানকার সংস্কৃতি সুরক্ষার কাজটা সহজতর হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও আধুনিক পর্যটন পরস্পরকে সহযোগিতা করছে।'

চৌ গুয়াংসিয়াং বলেন, ইয়াওশানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিকসম্পদ। এ ধরণের বৈশিষ্ট্যময় জাতীয় সংস্কৃতিতে টিকিয়ে রাখতে আগামী প্রজন্মকে এ ব্যাপারে শিক্ষিত করে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'রিবো'র ইয়াও জাতির লোকসংখ্যা কম। ইয়াও জাতির নিজের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমাদের উচিত শিশুদেরকে ইয়াও জাতির সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়া। ছোট বেলা থেকেই নিজের জাতির সংস্কৃতি বোঝা উচিত।'

তরুণী লু জিনমেই'র জন্য নিজের জাতির সংস্কৃতি প্রচারের কাজ বহু বছরের স্বপ্ন। সেজন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর নিজের জন্মস্থানে ফিরে এসে শিশুদের শিক্ষায় নিজেকে উত্সর্গ করেন। তিনি বলেন, 'আমি ইয়াও জাতির গল্প ও শিল্প আমাদের আগামী প্রজন্মের শিশুদেরকে জানাতে চাই।'

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040