পুবের জানালা: ৬২০ কোটি ইউয়ান মূল্যের 'লা মিয়ান' অর্থনীতি
  2016-09-16 18:18:49  cri



৩৩ বছর বয়সী মা হেই মেই চীনের ছিং হাই প্রদেশের হাই তুং শহরের হুয়া লং হুই জাতি স্বায়ত্বশাসিত জেলার একটি গ্রামের বাসিন্দা। হুয়াং নদীর তীরে হুয়াং লুং জেলার কে ছুন উপজেলায় তার একটি 'লা মিয়ান'-এর রেস্তোরাঁ আছে। হুয়ান হে নদী বয়ে গেছে তার রেস্তোরাঁর সামনে দিয়ে।

মা হেই মেই জানালেন, তিনি জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন 'লা মিয়ান'-এর সঙ্গে। আসলে হুয়া লং জেলা চীনের 'লা মিয়ানের জেলা'। চীনে যত হুয়া লং 'লা মিয়ান' রেস্তোরাঁ আছে, তার সবগুলোর মালিক হুয়া লং জেলার মানুষ। মা হেই মেই বলেন, তার বাবার কথা সবসময় তার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন: 'সততা ও বিশ্বস্ততা ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।'

ভাল 'লা মিয়ান' তৈরি করতে ৪টি জিনিষ দরকার। প্রথমত, পরিষ্কার স্যুপ; দ্বিতীয়ত, সাদা রঙের মূলা; তৃতীয়ত, লাল রঙের লঙ্কা তেল; এবং সবুজ রঙের রসুন। এই চারটা উপাদান মিলে ভাল ও সুস্বাদু 'লা মিয়ান' তৈরি হয়।

মা হেই মেই বলেন, যখন তিনি 'লা মিয়ান' তৈরি শুরু করেন, তখন থেকেই তিনি জানেন যে, গরুর মাংসের স্যুপ লা মিয়ানের মূল উপাদান। যে স্যুপ লা মিয়ান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, তা আসলে গরুর হাড় দিয়ে ৪ ঘন্টা ধরে ফুটানো পানি।

বর্তমানে সারা চীনের ২৭০টি শহরে হুয়া লংয়ের বাসিন্দাদের দ্বারা পরিচালিত ১৪৪৩০টি লা মিয়ান রেস্তোরাঁ আছে। প্রতিবছর ১ লাখ হুয়া লং মানুষ জন্মভূমির বাইরে লা মিয়ানের ব্যবসা করে। প্রতিবছর এ ব্যবসায় ৬২০ কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ হয়। আর এ থেকে মুনাফা আসে ১৮০ কোটি ইউয়ান। 'ছোট এক বাটি খাবার' কীভাবে চীনে বড় একটি বাজার সৃষ্টি করেছে, তা এক প্রশ্ন বটে। আজকের পুবের জানালা অনুষ্ঠানে আমরা হুয়া লং জেলা ও এর লা মিয়ান অর্থনীতির গল্প বলব।

হুয়াং লাং জেলা একটি হুই জাতিঅধ্যুষিত অঞ্চল। পাহাড়ে অবস্থিত এ জেলায় বছরের ৯০ শতাংশ সময়ই থাকে খরা। গোটা জেলার লোকসংখ্যা দুই লাখ ৮৬ হাজার। এদের মধ্যে আবার আড়াই লাখই গ্রামের বাসিন্দা। একসময় এটি ছিল চীনের জাতীয় পর্যায়ের দরিদ্র জেলা।

গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে খরার প্রভাবে জেলায় খাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে। হুয়া লং জেলার মানুষকে তখন অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটাতে হতো। মা হেই মেই পরিবারের পঞ্চম সন্তান। কোনো উপায় নেই, বেঁচে থাকার জন্য তাকে বাইরে কাজ করতে হবে। তিনি সিয়ান মেনে গেলেন এবং ওখানে একটি লা মিয়ান রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করেন। জন্মভূমি ছেড়েছিলেন তিনি সঙ্গে নিয়ে মাত্র ৭ ইউয়ান।

তখনকার হুয়া লাং জেলায় মা হেই মেইর মতো তরুণ বেশি ছিল। তাদের অধিকাংশাই নিজের গ্রাম ছেড়ে বাইরে কাজের সন্ধানে যেতে বাধ্য হয়।

অপরিচিত একটি জায়গায় লা মিয়ানের ব্যবসা করা আসলে খুব কঠিন একটি কাজ। ৪০ বছর বয়সী মা ইউয়ং ১০ বছর আগে সেন চেন শহরে একটি লা মিয়ান রেস্তোরাঁ চালু করেছিলেন। সে অভিজ্ঞতা এখনও তিনি ভুলে যাননি।

গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের শেষ নাগাদ, খুব গরম গ্রীষ্মকালের একটি দিনে, একজন সাদা হ্যাট পড়া যুবক সাইকেল চালিয়ে সেন চেন শহরের ইয়ান থিয়ান অঞ্চলে আসা-যাওয়া করছিল। ঘাম নিরন্তরভাবে তার মুখ থেকে পড়ছে। তার চোখ রাস্তার দু'পাশের দোকানগুলোর দিকে। এ যুবক মা ইউয়ং। তার অভিজ্ঞতাও তেমন হাজার হাজার মানুষের মতো যারা বাধ্য হয়ে জন্মভূমি ছেড়েছেন।

তিনি বলেন, একটি রেস্তোরাঁ খুলতে চাইলে প্রথমে উপযুক্ত একটি দোকান খুঁজে পাওয়া দরকার। টাকা বাঁচানোর জন্য মা ইউয়ং প্রতিদিন ৫ ইউয়ান করে একটি সাইকেল ভাড়া করেন এবং সারাদিন তেমন একটি দোকানের সন্ধান করতে থাকেন। গরম আবহাওয়ায় কয়েকদিন টানা সাইকেল চালিয়ে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। তিনি বলেন, এখন সাইকেল দেখলে তার ভয় লাগে।

বড় বড় শহরে হুয়া লংয়ের মানুষ পারিবারিক রেস্তোরাঁ চালায়। তারা একই গ্রামের বাসিন্দা বা আতীয়স্বজন এবং বড় শহরে তারা পরিবারের মতো। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা পরিশ্রম করে। এদের কেউ কেউ লম্বায় ছোট। ইটের ওপর দাঁড়িয়ে তাদেরকে লা মিয়ান তৈরি করতে হয়। কেউ কেউ রেস্তোরাঁ ঘুমায়, কারণ তাদের বাড়িভাড়ার টাকা নেই। মা ইউয়ং বলেন, শুরুতে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে বাইরে যাওয়া সিদ্ধান্ত ছিল কষ্টকর।

চিয়া হেই উ সান তুং ইয়ান থাই শহরে লা মিয়ান ব্যবসা করেন। ২০০৮ সালে তিনি যখন ইয়ান থাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনে লা মিয়ান বিক্রয় করেন, তখন একদিন তিনি তার মায়ের গুরুতর অসুখের খবর পেলেন। খবর শুনেই তিনি মায়ের কাছে ছুটে যেতে পারলেন না। ওই দিন রাতে তিনি সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখেছেন এবং মনে মনে মায়ের সাক্ষাত কামনা করেছেন। তিনি বলেন, এখনও তিনি ভুলতে পারেন না ওই রাতের মনের কষ্ট।

হুয়া লং মানুষের চেষ্টা ও পরিশ্রমে তাদের লা মিয়ান ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এর জন্য তাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে সিয়া মেনে মা মেই হেইর লা মিয়ান ব্যবসা প্রসার লাভ করে। ২০১৫ সালে তিনি অন্য চারজন পার্টনারকে নিয়ে 'হাই নি এর' ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন এবং সি নিং ও সিয়ান মেনে ১৯টি লা মিয়ান রেস্তোরাঁ খোলেন। বর্তমানে প্রতিদিন তার রেস্তোরাঁগুলোর আয় ৬ লাখ ২০ হাজার ইউয়ান।

হুয়া লং মানুষ দৈন্যদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং লা মিয়ান সংস্কৃতি চীনে প্রচার লাভ করেছে। হুয়া লং মানুষ এখন চীনের বিভিন্ন শহরে আছে। তারা বিশ্বাস করেন, প্রতিটি মানুষের মর্যাদার সাথে বসবাস করার অধিকার আছে। গত বছরের অগাস্ট মাসে থিয়ান চিন বিন হাই অঞ্চলের বিস্ফোরণের পর মা ছেং ই ও তার বড় ভাইয়ের উদ্যোগে হুয়া লং লা মিয়ান রেস্তোরাঁর মালিকরা বিনামূল্যে ৮০০০ প্যাকেট লা মিয়ান সরবরাহ করে। সান ইয় শহরে হুয়া লং লা মিয়ান রেস্তোরাঁর মালিক জনৈক ক্রেতার ফেলে যাওয়া ৬০ হাজার ইউয়ান ফিরিয়ে দেন। মা হেই মেই প্রতিদিন বিনামূল্যে প্রতিবন্ধিদের লা মিয়ান খাওয়ান। হুয়া লংয়ের মানুষ অন্যদেরকে সাহায্য করতে পছন্দ করে।

হুয়া লং জেলার উপ-প্রধান মা ছিয়ান লি বলেন, এক পাত্র লা মিয়ান হুয়া লং মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করেছে এবং লা মিয়ানের কল্যাণে তারা দৈন্যদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে।

হুয়া লংয়ের মানুষ এখন অনেক অর্থের মালিক হয়েছে, তবে অর্থ তাদের কাছে মুখ্য নয়। লা মিয়ান রেস্তোরাঁর মালিকরা বুঝতে পারেন শিক্ষা কত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় যারা শীর্ষ স্থানগুলো দখল করে, তারা সবাই লা মিয়ান রেস্তোরাঁর মালিকের সন্তান।

হুয়া লাং মানুষ বাইরে সাফল্য অর্জন করে এবং নিজের জন্মভূমিতে বিনিয়োগ করতে চায়। ২০১৪ সালে মা ইউয়ং হু লং জেলায় ২ কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ করে একটি কৃষি ও পশুপালন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। ভবিষ্যতে হুয়া লং জেলায় পোল্ট্রি শিল্প উন্নযন করতে চান তিনি।

গত মে মাসে চিয়া হাই উর লা মিয়ান রেস্তোরাঁ মালয়েশিয়ায় চালু হয়েছে। তার মতো অনেক হুয়া লং মানুষ মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ ও তুরস্কে বেশ কয়েকটি লা মিয়ান রেস্তোরাঁ খুলেছেন। চিয়া হাই উ বলেন, জন্মভূমি থেকে দূরে খাকলেও মনে জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা আগের মতোই আছে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040