20160901yinyue.mp3
|
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি আনন্দী বেইজিং থেকে সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজ 'সুর ও বাণী' আসরে আপনাদের কাছে চীনের বিখ্যাত পিয়ানোবাদক ও সুরকার ইন চেং জোংয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরবো এবং তার বাজানো কিছু পিয়ান সুর শোনাবো।
পিয়ানোবাদক ইন চেং জোং
বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'হোয়াং হোকে (হলুদ নদী) রক্ষা করো' নামে পিয়ানো সুর। সুরকার সিয়ান সিং হাই এর সংগীতকর্ম 'হোয়াং হো কোরাস' এর ভিত্তিতে ইন চেং জোং 'হোয়াং হো' পিয়ানো সুর সৃষ্টি করেন। এরপর নিজেই এর প্রথম সংগীতানুষ্ঠানে সুরটি বাজিয়ে শোনান।
১৯৬৯ সালে বেইজিংয়ে মহা গণভবনে 'হোয়াং হো' পরিবেশনের সময় চীনের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ আন লাই উপস্থিত ছিলেন। সুর শোনার সময় প্রধানমন্ত্রী চৌ মুগ্ধ হয়ে হাত দিয়ে বিট দিতে থাকেন। সুর শেষে তিনি দাঁড়িয়ে জোর দিয়ে বলেন, 'সিং হাই আবার জীবিত হয়েছে।'
বর্তমানে 'হোয়াং হো' বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত চীনা 'গম্ভীর প্রকৃতির' সংগীত ডিস্কের অন্যতম। প্রতি বছর পঞ্চাশটিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে নানা সংগীতানুষ্ঠানে 'হোয়াং হো' পিয়ানো সুর বাজানো হয়। কেউ কেউ মনে করেন, ১০০ বছরের মধ্যে চীনে 'হোয়াং হো'কে অতিক্রম করার কোনো পিয়ানো সুর সৃষ্টি হবে না।
বন্ধুরা, এবার তাহলে আপনারা মনোযোগ দিয়ে শুনুন 'হোয়াং হোকে রক্ষা করো' পিয়ানো সুরটি।
ইন চেং জোং ১৯৪১ সালে চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের সিমেন শহরের গুলাংইয়ুতে জন্মগ্রহণ করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি শাংহাইয়ের সংগীত ইনস্টিটিউটের অধীনস্থ মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। মাত্র দু'মাস পর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষজ্ঞ শেরোভ তাকে বিশেষজ্ঞ গ্রুপে নির্বাচন করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ভিয়েনা সপ্তম বিশ্ব যুব প্রীতি উত্সবের পিয়ানো প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পান।
মহা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তিনি পিকিং অপেরা 'লাল বাতি' ও 'হোয়াং হো' এর পিয়ানো সুর বাজানোর জন্য দ্রুত চীনে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন এবং চীন সফররত বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত সংগীত পরিচালকের সঙ্গে সহযোগিতা করার সুযোগ পান। তিনি ২০টিরও বেশি ডিস্ক রেকর্ডিং করেন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে চীনের কেন্দ্রীয় অর্কেস্ট্রার সঙ্গে রেকর্ডিং করা তারা 'হোয়াং হো' ডিস্ক কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে।
বন্ধুরা, এবার শুনুন 'হোয়াং হো' ধারাবাহিক পিয়ানো সুরের শেষ অংশ 'তর্জন করো, হোয়াং হো'।
ইন চেং জোং
১৯৬২ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ছাইকোভস্কি আন্তর্জাতিক পিয়ানো প্রতিযোগিতায় তিনি রানার্স-আপ হন। পুরস্কার অর্জনের পর তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৬০টি পরিবেশনা করেন। তারপর তিনি সে দেশে তিন বছর লেখাপড়া করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে চীনে ফিরে এসে তিনি কেন্দ্রীয় অর্কেস্ট্রার একজন একক পিয়ানো বাদক হন। তিনি চীনের কিছু প্রাচীনকালের ধ্রুপদী সংগীত ও লোকসংগীতকে পিয়ানো সুরে রূপান্তর করেন এবং ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেন।
বন্ধুরা, এবার শুনুন ইন চেং জোংয়ের বাজানো 'বসন্তকালের নদীতে রাতের চাঁদ' ।
১৯৬৭ সালে মাও ছে তোংয়ের ভাষণ প্রকাশের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে মাও ছে তোংয়ের চিন্তাধারা প্রচারকারীদল চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসাধারণদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে।
এ সময় ইন চেং জোং কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে একটি সাহসী কাজ করেন। তিনি থিয়েন-আন-মেন মহাচত্বরে পিয়ানো দিয়ে জনপ্রিয় সুরগুলো বাজাতে শুরু করেন, তারপর দর্শকরা যে সুর শুনতে চান, সে সুরের নাম বলার পর তিনি তা বাজিয়ে শোনান। তখন কেউ কেউ পিকিং অপেরা শুনতে চান। কিন্তু এর আগে তিনি কখনো পিয়ানো দিয়ে পিকিং অপেরার কোনো সুর বাজান নি। সে দিন রাতে বাসায় ফিরে তিনি তা চর্চা করেন। পরের দিন তিনি একজন পিকিং অপেরার অভিনেতার সঙ্গে আবার থিয়েন-আন-মেন মহাচত্বরে যান। সেই অভিনেতা পিকিং অপেরা অভিনয় করার পাশাপাশি তিনি পিয়ানো দিয়ে সুর বাজান। এবার তারা দর্শকদের তুমুল প্রতিক্রিয়া পান। থিয়েন-আন-মেন মহাচত্বরে টানা তিন দিন পরিবেশনের পর তারা আবার চিয়ান কুও মেন সহ বেইজিংয়ের অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে এমন পরিবেশনা করেন। তার এ পরিবেশনা সব জায়গার দর্শকদের সমাদর এবং প্রশংসা পায়।
এ থেকে ইন চেং জোং পিয়ানো দিয়ে পিকিং অপেরা 'লাল বাতি' এর সুর বাজানোর অনুপ্রেরণা পান। তিনি এ জন্য চীনের পিকিং অপেরা থিয়েটারে গিয়ে পিকিং অপেরা ও পিয়ানো এ দু'টি প্রাচ্য ও পশ্চিমা ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী কর্ম নিয়ে গবেষণা করেন। ১৯৬৭ সালে বেইজিং জাতীয় সংস্কৃতি ভবনে ইন চেং জোং ও পিকিং অপেরার অভিনেত্রী লিউ ছাং ইয়ু সহযোগিতা করে 'লাল বাতি' পরিবেশন করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। চীনের শীর্ষনেতারা তার অনেক প্রশংসা করেন।
বন্ধুরা, এখন শুনুন ইন চেং জোংয়ের বাজানো পিকিং অপেরার সুর 'গৌরব সবসময় সামনে থাকে'।
গত শতাব্দীর ৭০'র দশকে তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে 'সব দিক থেকে প্রস্তুত' 'বসন্তকালের নদীতে রাতের চাঁদ', 'মসৃণ হ্রদে শরত্কালের চাঁদ', 'শত পাখির ফিনিক্সের কাছে পূজা করা' সহ অনেক প্রাচীন সুরকে পিয়ানো সুরে রূপান্তর করেন। এটা ইন চেং জোংয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান। তবে সে সময় পিপা বা গুচাং সুর পিয়ানো সুরে পরিবর্তনের সংস্কার অনেকে গ্রহণ করতে পারেন নি। দশ বছর পর অর্থাত্ ১৯৮৩ সালে পিয়ানো সুর 'সব দিক থেকে প্রস্তুত' পরিবেশনের সুযোগ পায়।
ইন চেং জোং ফিলাডেলফিয়া অর্কেস্ট্রা, ভিয়েনা অর্কেস্ট্রা ও মস্কো অর্কেস্ট্রাসহ বিভিন্ন দেশের অর্কেস্ট্রার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। পশ্চিমা তথ্যমাধ্যমে তার পিয়ানো পরিবেশনাকে 'নিখুঁত কাঠামো, সমৃদ্ধ রঙ, পরিষ্কার শব্দ ও গভীর অর্থ'-এভাবে উচ্চ মূল্যায়ন করে। তিনি চীনের কেন্দ্রীয় অর্কেস্ট্রার প্রধানের দায়িত্ব পালন করার পর পিয়ানো সম্পর্কিত পাঁচটি চলচ্চিত্রে অংশ নেন। তিনি সবসময় চীনের সংগীতকর্ম সারা বিশ্বে তুলে করার প্রচেষ্টা চালান। ১৯৯৬ সালে তিনি নিউইয়র্কের কার্নেগি হলে 'সব দিক থেকে প্রস্তুত' ও 'বসন্তকালের নদীতে রাতের চাঁদ' পরিবেশন করেন। দর্শকদের তুমুল প্রতিক্রিয়া পান। দর্শকরা তার পিয়ানো পরিবেশনার উচ্চ মূল্যায়ন করেন এবং 'সব দিক থেকে প্রস্তুত'-কে চীনের প্রথম সংগীতের মহাকাব্য বলে অভিহিত করেন। তারা মনে করেন, ইন চেং জোং হলেন 'প্রাচ্যের সংগীত পশ্চিমে নিয়ে আসা চীনের সুবিদিত সংগীতজ্ঞ ও সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ পিয়ানোবাদক।
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, এতক্ষণ আপনারা চীনের বিখ্যাত পিয়ানোবাদক ও সুরকার ইন চেং জোংয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং তার বাজানো কিছু পিয়ানো সুর শুনলেন। আশা করি, অনুষ্ঠানটি আপনাদের ভালো লেগেছে। এ অনুষ্ঠান শোনার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন আপনারা। আবার কথা হবে। (ইয়ু/টুটুল)