পুবের জানালা: হাং চৌ'য়ে 'পায়ে হেঁটে ভ্রমণ' প্রকল্প
  2016-08-31 09:36:57  cri

 

 

 উ ইউয়ু ও সি হু হ্রদ সাংস্কৃতিক বিশেষ দূতরা



চীনের হাং চৌয়ের বিশেষ সাংস্কৃতিক দূত উ ইউয়ু। তিনি ও তার মেয়েবন্ধু ফান লিন হান 'পায়ে হেঁটে সি হু হ্রদ দর্শন' শীর্ষক একটি কর্মসূচির সঞ্চালক। যাদের নিয়ে তিনি সি হু হ্রদ দর্শন করেন, তারা সবাই হাং চৌয়ের ভবিষ্যত বিশেষ সাংস্কৃতিক দূত।

সি হু হ্রদ বিশ্ব সাংস্কৃতিক হেরিটেজ। এর তত্ত্বাবধানকেন্দ্রের অধীনে একটি যুব সেচ্ছাসেবক গ্রুপের সদস্য এসকল দূত। এ পর্যন্ত মোট ৫ বার গ্রুপে সদস্য নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এ ধরনের মোট সদস্য আছে শতাধিক। তাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং অফিস কর্মী। এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নেয়ার পর তারা সি হু হ্রদ সাংস্কৃতিক বিশেষ দূতে পরিণত হন এবং এক বছরব্যাপী কর্মসূচিতে অংশ নেন।

উ ইউয়ু ও তার মেয়েবন্ধু ফান লিন হান

উ ইউয়ু ও তার মেয়েবন্ধু ফান লিন হান নর্থওয়েষ্ট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রথম বর্ষ থেকেই দু'জন সি আন শহরের বিভিন্ন জাদুঘরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। উ ইউয়ু ২১ বছর বয়সী, চে চিয়াং প্রদেশের হাং চৌ শহরের মানুষ। অন্যদিকে ফান লিন হানের বয়স ২৪ বছর, হে পেই প্রদেশের পাও তিন শহরের মানুষ। চীনের দক্ষিণ ও উত্তর অঞ্চল থেকে আসা এ দু'জন মূলত অভিন্ন শখের কারণে একে অপরের প্রেমে পড়েন। ফান লিন হান বলেন"আমরা দু'জন ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছি এবং বিভিন্ন জাদুঘরে বেড়াতে পছন্দ করি। জাদুঘরে কাজ করার সময় আমাদের পরিচয়। পরে আমরা বুঝতে পারি যে, জীবন সম্পর্কে আমাদের দু'জনের ধারণা একই। আমরা দু'জনই কালচারাল হেরিটেজ পছন্দ করি। আমাদের আগ্রহের বিষয় প্রায় একই বলে আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ি।'

ছুটিতে দু'জন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক হেরিটেজ দেখতে ছুটে যান। গত তিন বছরে তারা চীনের নানা জায়গায় গিয়েছেন। তবে তাদের আগ্রহ সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন। তারা বিখ্যাত বা জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানে তেমন একটা যান না। খুব এটা জনপ্রিয় নয়, কিন্তু ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আছে, এমন সব জায়গায় বেড়াতে তারা পছন্দ করেন। সাধারণ মানুষ যখন ভ্রমণ করে তখন তারা পার্ক, দোকান ও দর্শনীয় স্থানগুলোতে বেশি ভিড় করে। কিন্তু এই দু'জন শহরের ছোট ছোট রাস্তা ও গ্রামীণ মাঠ পরিদর্শনে যেতে পছন্দ করেন। কারণ, এসব জায়গায় প্রাচীন স্মৃতিবিজড়িত জায়গা পাওয়া যায়।

হাং চৌয়ের মানুষ হিসেবে উ ইউয়ু গর্বিত। তিনি সি হু হ্রদের প্রতি একটা দায়িত্বও বোধ করেন। তার মতে সি হু হ্রদ হচ্ছে সংস্কৃতি ও প্রকৃতির মিলনমেলা। সি হু হ্রদ ভ্রমণের সময় সাংস্কৃতিক বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত্। হাং চৌ একটি পর্যটনশহর। ওয়ার্ল্ড কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর সি হু হ্রদ প্রতিবছর অসংখ্য দেশিবিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করে আসছে। তবে অধিকাংশ পর্যটক বিখ্যাত কয়েকটি স্থান ছাড়া অন্য কোথাও যান না। আসলে সি হু হ্রদের কাছাকাছি অঞ্চলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে, যেগুলো তেমন একটা পরিচিত নয়।

সাংহাই ও তাইওয়ানে উ ইউয়ু ও ফান লিন হানের 'এক জায়গা ভ্রমণ'-এর অভিজ্ঞতা আছে। 'এক জায়গা ভ্রমণ' মানে পায়ে হেঁটে ছোট একটি জায়গা খুব ভালোভাবে দেখা। হাং চৌ শহরেও রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক ও সাস্কৃতিক সম্পদ। তাই তারা হাং চৌতে 'এক জায়গা ভ্রমণ'-এর ধারণা প্রচার করছেন। উ ইউয়ু বলেন,

"হাং চৌ শহরের অনেক বাসিন্দা আছেন যারা প্রায়ই সি হু হ্রদে বেড়াতে যান। কিন্তু তারা সি হু হ্রদের অনেক খবরই রাখেন না, অনেক জায়গা দেখেননি। আমরা আশা করছি, পর্যটকরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করবেন এবং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সি হু হ্রদকে আবিস্কার করবেন। যারা প্রথমবার ভ্রমণে এসেছেন, তাদের আমরা দ্বিতীয়বার এখানে আসতে উৎসাহিত করি, যাতে তারা পরের বার ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একে দেখতে পারেন।"

সি হু হ্রদ বিশ্ব সাংস্কৃতিক হেরিটেজ ত্বত্তাবধানকেন্দ্রও উ ইয়ুর ধারণাকে সমর্থন করে এবং সি হু হ্রদ বিশেষ সাংস্কৃতিক দূত প্রকল্পে এ-ধারণা যোগ করা হয়েছে। প্রতিবছর সি হু হ্রদ বিশ্ব সাংস্কৃতিক হেরিটেজ ত্বত্তাবধানকেন্দ্র নিয়মিতভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করে। বিভিন্ন স্কুলে সি হু হ্রদ সাস্কৃতিক হেরিটেজ বিষয়ক লেকচার তেমনি একটি কর্মসূচি। সি হু হ্রদ বিশ্ব সাংস্কৃতিক হেরিটেজ ত্বত্তাবধানকেন্দ্রের কর্মী সিয়া পান বলেন,"আমরা সি হু হ্রদকে একটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক হেরিটেজ হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। অনেকে জানেন যে, সি হু হ্রদ একটি দর্শনীয় স্থান; কিন্তু তারা জানেন না এটা একটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক হেরিটেজ। দু'বছর আগে আমরা শুরু করি 'এক জায়গা ভ্রমণ' প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় আমরা আগ্রহী পর্যটকদের নিয়ে পায়ে হেঁটে সি হু হ্রদ ভ্রমণ করি। এসময় তাদের সামনে সি হু হ্রদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরি আমরা।"

এ পর্যন্ত সি হু হ্রদে 'এক জায়গা ভ্রমণ'-এর জন্য উ ইউয়ু দু'টি রুট খুঁজে নিয়েছেন। তিনি আরও দু'টি রুট খুঁজছেন। তারা প্রথমে সাংস্কৃতিক বিশেষ দূতদের নিয়ে নিজেরা এ রুটে হাঁটাহাঁটি করবেন। তার পর তারা এ রুটের ম্যাপ তৈরি করবেন। ম্যাপে রেস্তোরাঁ ও টয়লেটের অবস্থান নির্দেশ করা থাকবে। এ ম্যাপ হাতে নিয়ে যে-কোনো পর্যটক গাইড ছাড়াই 'এক জায়গা ভ্রমণ' করতে পারবেন।

ফান লিন হান ও উ ইউয়ু বলেন"আমরা আশা করি, বাইরে থেকে আসা পর্যটক ও হাং চৌ'র বাসিন্দারা বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলো ছাড়া এখানকার অন্যান্য স্থানেও পায়ে হেঁটে ঘুরবেন। এখানে বিখ্যাত স্থানগুলো ছাড়াও আছে অনেক দেখার বিষয়, জানার বিষয়। এসব স্থানের পেছনে আছে সুন্দর সুন্দর গল্পও।"

ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেকেই 'এক জায়গা ভ্রমণ' ধারণা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তাদের অনেকে এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া আগ্রহও দেখিয়েছেন। ছেং ছিং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং ইতিহাসের ব্যাপারে তার গভীর আগ্রহ রয়েছে। তিনি সি হু হ্রদ সাংস্কৃতিক বিশেষ দূত হিসেবে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। বিশেষ ট্রেনিংয়ের পর তিনি এখন একজন দূত হয়েছেন। তিনি বলেন"হাং চৌ'র সাংস্কৃতিক পরিবেশ খুব সমৃদ্ধ। তবে এখানে যারা আসেন তারা প্রাকৃতিক দৃশ্য তো চোখ দিয়ে উপভোগ করেন, কিন্তু এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে খুব কমই জানতে পারেন। আমরা তাদের সামনে সি হু হ্রদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে চাই।"

'

এক জায়গা ভ্রমণ' প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উ ইউয়ু ও ফান লিন হানকে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। কিন্তু তারা তাদের কাজে আনন্দও খুঁজে পান। এ প্রকল্প অনুসারে, প্রতিটি নতুন রুটে তাদেরকে অন্তত তিনবার হাঁটাহাঁটি করতে হয়। এসময় তারা শুধু রুটের ম্যাপই তৈরি করেন না, বরং রুটের বিভিন্ন স্থান সম্পর্কে প্রচলিত গল্প ও ইতিহাসও সংগ্রহ করেন। দীর্ঘ সময় বাইরে হাঁটাহাঁটি করে তারাও ক্লান্ত হন। ফান হান লিন বলেন,'উ সান রুটের নকশা আঁকার সময় আমরা দু'বার এ রুটে হাঁটাহাঁটি করেছি। প্রথমবার অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। দ্বিতীয়বার আমার পায়ের ২০টির বেশি জায়গায় মশা কামড়ায়। এসময় তীব্র রোদে আমরা ছাতাও ব্যবহার করতে পারছিলাম না। কারণ এভাবে পাহাড়ে হাঁটা অসুবিধাজনক। আমরা দু'জন ইতিহাসের শিক্ষার্থী। আমরা জানি, একটি ভবন তার ইতিহাস ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেললে সে মরে যায়; মানুষ আর তার সম্পর্কে কিছু জানতে পারে না। তাই আমাদের কাজ সত্যিই অর্থবহ।'

হাং চৌতে অনুষ্ঠিত হবে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। এ উপলক্ষ্যে অনেক পর্যটক এখানে আসবেন। তাদের মধ্যে 'এক জায়গায় ভ্রমণ' ধারণা জনপ্রিয় করতে চান উ ইউয়ু। তিনি আশা করেন, নিজেদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং ভ্রমণের নতুন ধরনের ধারণা প্রচারের কাজ আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। তিনি বলেন, "হাং চৌ'র সংস্কৃতি ও ইতিহাস আগে নিজেরা জানা এবং পরে অন্যদের সামনে তুলে ধরা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। আমাদের কাজের ফলে বিশ্বে হাং চৌ আরও পরিচিতি লাভ করবে এবং এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানবে বলে আমি বিশ্বাস করি।" (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040