ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানেন না অনেক চীনা প্রবীণ
  2016-08-24 11:07:46  cri



চীনের চেং চৌ রেল স্টেশন। দ্রুতগতির ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীরা খানিকটা পথ হেঁটে যাচ্ছেন সাবওয়ের ট্রেন ধরতে। সাবওয়ের টিকিটের জন্য এখানে মেশিন আছে দশ-বারোটা। প্রতিটির সামনে লম্বা লাইন। লাইনে প্রবীণের সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে একই জায়গায় উইচ্যাট সাবওয়ে ভেন্ডিং মেশিনও আছে। ওখানে ভিড় তুরুণ-তরুণীদের। ওরা স্মার্টফোন দিয়ে QR কোড স্ক্যান করছেন এবং দ্রুত পেয়ে যাচ্ছেন টিকিট। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রবীণদের অনেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। কীভাবে তরুণ-তরুণীরা দ্রুত টিকিট পাচ্ছে? তাদের অনেকের মনে এই প্রশ্ন।

চেং চৌ থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে বেইজিংয়েও দেখা যাবে একই ধরনের চিত্র। জাতীয় ঋণপত্র কেনার জন্য ভোর থেকে প্রবীণরা ব্যাংকের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও শেষ পর্যন্ত ঋণপত্র কিনতে পারেননি। কেন? কারণ, অনলাইনে অধিকাংশ ঋণপত্র বিক্রি হয়ে গেছে।

গোটা বিশ্বের মতো চীনেও দ্রুত ইন্টারনেট উন্নত হচ্ছে এবং মানুষ জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। অনলাইন কেনাকাটা, অনলাইন অর্থ, ফোন ট্যাক্সি ইত্যাদি অনেক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটের কল্যাণে। তবে অধিকাংশ প্রবীণের কাছে 'ইন্টারনেট প্লাস' একটি অপরিচিত ধারণা। কোনো কোনো প্রবীণ উইচ্যাট ব্যবহার করেন। তবে সেটা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। এর বাইরে উইচ্যাটের আর কোনো ব্যবহার তাদের জানা নাই। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ওয়াইফাই ইত্যাদি শব্দগুলো তাদের কাছে অপরিচিত!

আপনি ইন্টারনেটে কেনাকাটা করেন? এমন একটি সহজ প্রশ্ন অধিকাংশ প্রবীণর জন্য মোটেই সহজ নয়। পর্যটন, চলচ্চিত্র দেখা, কেটারিং ও বাসস্থানসহ আমাদের জীবনের সবকিছুই এখন ইন্টানেটের সাথে যুক্ত। একটি স্মার্টফোন নিয়ে আমরা প্রায় সবকিছু করতে পারি। রেলটিকিট কিনতে পারি স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে। তারপর আইডি কার্ড নিয়ে স্টেশান থেকে সহজে টিকিট সংগ্রহ করা যায়। তবে অধিকাংশ প্রবীণ এ উপায় সম্পর্কে জানেন না বা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারেন না। ফলে তাদের স্টেশানে গিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনতে হয়। তাদের জন্য গোটা প্রক্রিয়াটাই সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য।

তবে কি উন্নত প্রযুক্তি আমাদের প্রবীণদের সমস্যাই শুধু বাড়াচ্ছে? সম্প্রতি চীন ইন্টারনেট তথ্যকেন্দ্র (সি এন এন আই সি)প্রকাশিত ৩৮তম চীনা ইন্টারনেট উন্নয়ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত চীনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৭১ কোটি এবং মোবাইলফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ৬৫ কোটি। আজকাল লোকজন মোবাইলফোনের মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে, খবর পড়ে, আর্থিক লেনদেন করে, ট্যাক্সি ভাড়া করে, খাবার অর্ডার করে, ভ্রমণ করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

চীনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৬৪.৭ শতাংশ মোবাইফোনে লেনদেন করেন। অন্যভাবে বললে, ৪২ কোটি ৪০ লাখ চীনা ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এখন ওয়ালেট এবং ক্রেডিট কার্ডের পরিবর্তে লেনদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। তবে চীনা মোবাইফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাশই যুবক-যুবতী। চীনা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭৪.৭ শতাংশের বয়স ১০ থেকে ৩৯ বছর।

ইন্টারনেট যুগে প্রবীণরা যেন বহিরাগত। এদিকে চীনে বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা। ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ চীনে ৬০ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী লোকের সংখ্যা ছিল ২১ কোটি ২০ লাখ। মোট জনসংখ্যায় প্রবীণদের অনুপাত ১৫.৫ শতাংশ।

বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অধ্যাপক সিয়া সুয়ে লুয়ান বলেন, " ইন্টারনেট সার্ফিং প্রবীণদের জন্যও ভালো। তবে, ইন্টারনেটে যেসব পণ্য পাওয়া যায়, সেগুলো প্রায়ই প্রবীণদের চাহিদা মেটাতে পারে না।"

মিস্টার লি'রর বয়স ৬৫। তার ছেলের সাহায্যে তিনি উইচ্যাট অ্যাকাউন্টে নিবন্ধিত হন। সাধারণত তিনি উইচ্যাটে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভয়েস চ্যাট করে। তার বন্ধুদের মতে তিনি একজন 'ইন্টারনেট ব্যবহারকারী'। সম্প্রতি তিনি নাতীর দেখাশোনা করতে হে নান থেকে বেইজিংয়ে আসেন। বেইজিংয়ে লি আবিষ্কার করেন যে, এখানে সবকিছু ইন্টারনেটনির্ভর। দোকানে ফল ও শাকসবজি কেনার সময় উইচ্যাটে বা চি ফু পাও ব্যবহার করলে ২০ শতাংশ ডিসকাউন্ট পাওয়া যায। সুপারমার্কেটে চাল কেনার সময় ফোন অ্যাপ্লিকেশনে লেনদেনে ৫০ শতাংশ কম দাম দিতে হয়। মিস্টার লি বলেন, "অন্যরা যেখানে সস্তায় পণ্য কিনতে পারে, আমাকে সেখানে বেশি দাম দিতে হয়।"

কন্যাকে দেখতে চে চিয়াং থেকে বেইজিংয়ে এসেছেন মিসেস ওয়াং। আগে রাস্তায় হাতের ইশারায় ট্যাক্সি থামতো। কিন্তু এবার তিনি খেয়াল করলেন, ট্যাক্সি খালি থাকলেও অধিকাংশ সময় হাতের ইশারায় থামে না। তিনি জানতে পারলেন যে, এসব ট্যাক্সি আগেই ফোনে বুকিং হয়ে গেছে। তাই তার হাতের ইশারায় থামেনি!

তিনি আরও খেয়াল করলেন, রেস্টুরেন্টে নুডলস খেয়ে মোবাইলে দাম দিলে কম পড়ে; আবার নাতীর জন্য পোশাক কিনে ইনটারনেটে দাম দিলে ৫০ ইউয়ান কম লাগে। বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি বিল পরিশোধেও ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তার মতো অধিকাংশ প্রবীণ সেসব সুবিধা দেখতে পারেন, কিন্তু উপভোগ করতে পারেন না!

গত বছর, উ হান বিশ্ববিদ্যালয় চীনা প্রবীণদের ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতার ওপর একটি জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, ৩৩.৩ শতাংশ প্রবীণ ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রায়ই সমস্যায় পড়েন এবং ৫১.৭ শতাংশ মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়েন।

৬২ বছর বয়সি মিঃ লি নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে বলেন, কিছুদিন আগে তার ছেলে তাকে একটি স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে। তবে ফোন, এস এম এস এবং উইচ্যাটের কিছু সেবা ছাড়া, তিনি এ ফোন অন্যান্য কাজে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানেন না।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রবীণরা সহজে সাহায্যও পান না। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, কেউ শিখিয়ে দেয়নি বলে অধিকাশ প্রবীণ ইন্টারনেট কেনাকাটা করেন না। কোন কোন প্রবীণ বলেন, তারাও নিজ নিজ ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার শিখতে চান। কিন্তু বাচ্চারা দ্রুত শেখাতে চায় এবং একসময় বিরক্ত হয়।

কোনো কোনো প্রবীণ মনে করেন, অনলাইন ব্যাংকিং, কেনাকাটা ও লেনদেনে ঝুঁকি আছে। তাদের ভয়, তাদের টাকা প্রতারকের খপ্পরে পড়তে পারে।

আর হুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ওয়াং ইউয়ন ফেই বলেন, "প্রবীণদের চাহিদা বিবেচনা করা উচিত। ইন্টারনেট ব্যাপকভাবে আমাদের জীবনে প্রবেশ করেছে। প্রবীণ ও যুবক-যুবতী—সবারই এর সুবিধা সমানভাবে উপভোগ করার অধিকার আছে। ব্যাংক, হাসপাতাল, বিদ্যুত বিভাগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রবীণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত।"

তিনি মনে করে, সমাজে প্রবীণদের প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা উচিত।

সাম্প্রতিক কালে অবশ্য কয়েকটি কোম্পানি প্রবীণদের সুবিধার জন্য বিশেষ পণ্য উত্পাদন করছে। যেমন একটি কোম্পানি এমন মাউস উৎপাদন করেছে, যা দিয়ে সহজে টাইপ করা যায়। আবার কোনো কোনো কোম্পানি প্রবীণদের জন্য বিশেষ ফোনও উৎপাদন করেছে। তবে এসব ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়।

নতুন কোনোকিছু শিখতে অধিকাংশ প্রবীণের বেশি সময় লাগে। তাই প্রবীণদের ইন্টারনেট প্রশিক্ষণ-ব্যবস্থায় ধৈর্য্যশীল প্রশিক্ষক লাগবে। তা ছাড়া, প্রবীণদের উপযোগী স্মার্ট ফোন ও অ্যাপ্লিকেশানও যথেষ্ট হওয়া দরকার। এতে আশা করা যায়, প্রবীণরা অধিক হারে ইন্টারনেট সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040