চীনের সহযোগিতায় পদ্মা সেতুতে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে যুক্ত হচ্ছে রেলসেতু
  2016-08-22 11:10:20  cri



বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প, বহুল আলোচিত এবং স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখি সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলগাড়ি চলাচল নিশ্চিত করতে 'পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প' সংক্রান্ত চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

চলতি মাসের ৮ তারিখে রাজধানীর রেল ভবনে এ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপ‌রিচালক মো: আমজাদ হো‌সেন এবং চীনের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)'র ডেপু‌টি জেনা‌রেল ম্যানেজার ঝ্যাং জুই কাই নিজ নিজ পক্ষে চু‌ক্তিতে স্বাক্ষর ক‌রেন।

বর্তমানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে কুষ্টিয়া হয়ে যশোর-খুলনায় রেল যোগাযোগ রয়েছে। মাওয়ায় পদ্মা সেতু হলে ফরিদপুর হয়ে ট্রেন যাবে যশোরে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে রেল লাইন নির্মা‌ণ প্রক‌ল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৮৮.৮৬ কো‌টি টাকা। চীন সরকারের সহায়তায় (জি টু জি) এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। চুক্তি অনুযায়ী ২ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদে ২৪ হাজার ৭৪৯.০৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে চীন সরকার এবং বাকি ১০ হাজার ২৩৯.৮১ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। প্রকল্পটি চার ধাপে ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে।

'পদ্মা সেতু রেল সংযোগ' প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে কেরানিগঞ্জ হয়ে মাওয়া পর্যন্ত অংশের বেশির ভাগই হবে উড়াল পথে।

বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোর নির্মাণ কাজ চলছে এখন। ২০১৮ সাল নাগাদ এই সেতু চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার।

রেল মন্ত্রী মো. মুজিবুল হক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজটি শেষ করার অনুরোধ করেছেন। যাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালুর প্রথম দিন থেকেই ট্রেন চলাচলও শুরু করা সম্ভব হয়, এ বিষয়টি নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। একইভাবে এ প্রকল্পে সহায়তার জন্য চীন সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানান রেল মন্ত্রী মুজিবুল হক।

তিনি সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু ও কাজের ক্ষেত্রে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ জানান।

নতুন এ রেলপথ কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে গেন্ডারিয়া হয়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে মূল পদ্মাসেতু হয়ে যাবে জাজিরায় এবং জাজিরা থেকে ফরিদপুরের ভাঙা হয়ে যশোরে গিয়ে শেষ হবে।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফিরোজ সালাহ উদ্দিন, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিং চিয়াং, সিআরইসি গ্রুপের চেয়ারম্যান লি চ্যাং জিনসহ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প চালুর মধ্য দিয়ে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর এবং নড়াইল জেলা নতুন করে রেল লাইনের অন্তর্ভুক্ত হবে। রেলের যাত্রী সেবার মান বাড়বে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে বরিশাল ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে রেল সংযোগের সঙ্গে যুক্ত করতে এই রুটে দ্বিতীয় লাইন নির্মাণ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে চীন একাধিক বাংলাদেশ-চীন মৈত্রীসেতু, মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র, পদ্মা রেলসেতু সহ বিভিন্ন উন্নয়ন ক্ষেত্রে যেভাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে সেটিকে বাংলাদেশ সরকার কিভাবে মূল্যায়ন করছে তা আমরা জানার চেষ্টা করেছি সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এম.পি'র সাথে কথা বলে।

(অডিও: অর্থমন্ত্রী--3_REC_000321_Abul Maal Abdul Muhith M.P, Hon'ble Finance Minister)

উল্লেখ্য, গত ৩ মে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। রাজধানী ঢাকা শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা এ মেগা প্রকল্পের অনুমোদন দেন।

একনেক বৈঠকে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প অনুমোদন দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কোন মূল্যে ২০১৮ সালের মধ্যেই পদ্মা সেতু এবং ২০২২ সালের মধ্যে রেল সংযোগের কাজ সমাপ্ত করার নির্দেশ দেন।

২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় রেলখাতে চীন সরকারের বিনিয়োগের বিষয়টি দু'দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণের জন্য মোট ৪টি সেকসনে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সেকসন ১ ঢাকা-গেন্ডারিয়া। সেকসন ২ গেন্ডারিয়া-মাওয়া। সেকসন ৩ মাওয়া-ভাঙ্গা জংশন- মাওয়া এবং সেকসন ৪ ভাঙ্গা জংশন-যশোর।

রেল সংযোগ প্রকল্পটি প্রথম পর্যায়ে বিদ্যমান ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে শুরু হয়ে গেন্ডারিয়া-মাওয়া হয়ে-নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে-ভাঙ্গা জংশন স্টেশন পর্যন্ত সংযুক্ত করবে। প্রকল্পের ২য় পর্যায়ে ভাঙ্গা জংশন থেকে বিদ্যমান কাশিয়ানী জংশন স্টেশন হয়ে পদ্মবিল জংশন হয়ে ওয়াই (Y) কানেকশনের মাধ্যমে বিদ্যমান রূপদিয়া এবং সিঙ্গিয়া স্টেশনকে সংযুক্ত করবে। ঢাকা-গেন্ডারিয়া সেকশনে ৩ কিলোমিটার ডবল লাইনসহ প্রকল্পের আওতায় মোট ১৭২ কিলোমিটার নতুন ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ করা হবে। এর ফলে ঢাকা-যশোর, ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-দর্শনার মধ্যকার দূরত্ব যথাক্রমে ১৮৪.৭২ কিলোমিটার, ২১২.৫ কিলোমিটার, ৪৪.২৪ কিলোমিটার হ্রাস পাবে এবং যাতায়াতের সময়ও বাঁচবে।

প্রকল্পের আওতায় আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, ১৪টি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ ও ৬টি বিদ্যমান স্টেশন উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ করা। নতুন ১৪টি স্টেশন হচ্ছে-কেরানীগঞ্জ, নিমতলা, শ্রীনগর, মাওয়া, জাজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা জংশন, নগরকান্দা, মুকসুদপুর, মহেশপুর, লোহাগড়া, নড়াইল, জামদিয়া ও পদ্মবিল। এ ছাড়া ঢাকা, গেন্ডারিয়া, ভাঙ্গা, কাশিয়ানী, রূপদিয়া ও সিঙ্গিয়া ৬টি বিদ্যমান স্টেশনের বিদ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা। ৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সেতু, ২৪৪টি ছোট সেতু নির্মাণ, একটি হাইওয়ে ওভারপাস, ২৯টি লেভেল ক্রসিং, ৪০টি আন্ডারপাস, ২০টি স্টেশনে টেলিযোগাযোগসহ কম্পিউটার বেজ রেলওয়ে ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম-এর জন্য অপটিক্যাল ফাইবার লাইন স্থাপন করা এবং ১০০টি নতুন ব্রডগেজ যাত্রীবাহী রেল বগি কেনা।

সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ঢাকা-যশোর ব্রডগেজ রেল সংযোগ নির্মাণ বাংলাদেশের পরিবহন অবকাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে যাচ্ছে।

দিদারুল ইকবাল

চীন আন্তর্জাতিক বেতার

বাংলাদেশ।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040