রক্তাক্ত পদচিহ্নের পেছনে:আমাদের বীর ওয়াং ফেং

  2016-08-17 09:29:40  cri



দু'মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। তবে এখনও দেখা যায় রক্তাক্ত পদচিহ্ন। রক্তের সাথে মিশেছে বৃষ্টির পানি। একটি আবাসিক ভবন থেকে একটি সরু গলির শেষ পর্যন্ত প্রায় ৫০ মিটার পথে দেখা যাবে এই রক্তাক্ত পদচিহ্ন।

এক বিশেষ রাতে এক ব্যক্তি বিপদগ্রস্ত মানুষদের উদ্ধার করতে নগ্নপদে এ ৫০ মিটার আসা-যাওয়া করেছিলেন। তার পা রক্তাক্ত হয়েছে। সেই রক্তাক্ত পায়ের চিহ্ন রয়ে গেছে রাস্তায়। চীনা এই পুরুষ মানুষটির নাম ওয়াং ফেং। তিনি আমাদের বীর। আগুনের কবল থেকে তিনি তিন জনকে উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু নিজে এখন শুয়ে আছেন হাসপাতালের আসিইউ'তে। অন্যদের মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচালেও তিনি নিজেই এখন লড়ছেন মৃত্যুর সাথে।

হে নান প্রদেশের নান ইয়াং শহরের সি হুয়া গ্রামে, তিন তলা একটি ভবন নতুনভাবে পেইন্ট করার পর ভাড়া দেওয়া হয়। তবে ভবনে এখনও রয়ে গেছে অগ্নিকাণ্ডের চিহ্ন।

১৮ মে, রাতে ওয়াং ফেং হঠাত জেগে ওঠেন ঘুম থেকে। তিনি তার স্ত্রীকেও ডেকে তোলেন। তাকে তিনি বলেন, 'দেখ কোথা থেকে যেন ধোঁয়া আসছে‍!' ভবনের প্রথম তলার পাবলিক হল থেকে ঘন ধোঁয়া বের হচ্ছিল। ওয়াং ফেং চিৎকার করে উঠলেন 'আগুন' বলে। তিনি পোশাক না-পাল্টেই উদ্ধারকাজে লেগে গেলেন। প্রথমে তিনি তার স্ত্রী ও কন্যাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিলেন। তার পর ছুটলেন অন্যদের উদ্ধারে। আগুন ততক্ষণে গোটা ভবনে ছড়িয়ে পড়েছে।

'পুলিশকে ফোন কর'-স্ত্রীকে এ কথা বলে ওয়াং ফেং ভবনে ফিরলেন; আটকে পড়া অন্যদের উদ্ধারের জন্য।

(দুর্ঘটনার আগে ওয়াং ফেং ও তার সন্তান)

২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে ওয়াং ফেং ও তার স্ত্রী ভবনটির একটি তলা ভাড়া নেন। তারা এখানে একটি সেবা সেন্টার খুলেন। শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। ঘটনার রাতে দু'জন শিক্ষার্থী ও একজন শিক্ষকও সেন্টারে ছিল। ওয়াং ফেং তাদের উদ্ধার করার জন্য ভবনে ফিরে গেলেন।

শিক্ষক ইয়াও সুয়ে বলেন, "তখন ভেতর থেকে দরজা খুলতে পারছিলাম না আমরা। ওয়াং ফেং বাইরে থেকে দরজা ভেঙে আমাদের বের হতে সাহায্য করেন। তার পায়ে কোনো জুতো ছিল না। তিন জনকে উদ্ধার করার পরও ওয়াং ফেং তেমন আঘাত পাননি। কিন্তু এর পরও তিনি আবার ভবনে ফিরে গিয়েছিলেন। ওয়াং ফেং ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গিয়ে সবার দরজা ঠকঠক করার পর বাইরে আসেন। তখন তিনি রীতিমতো একজন কালো মানুষে পরিণত হয়েছেন। তিনি দৌঁড়াচ্ছিলেন আর চিৎকার করে বলছিলেন, উপরে মানুষ আছে, তাদেরকে উদ্ধার করুন। তার কণ্ঠ শুনে প্রতিবেশীরা অগ্নিনির্বাপন কাজে এগিয়ে আসে।"

পরে আসে দমকল বাহিনী। তারা ভবনটি খুঁজে পাচ্ছিল না। ওয়াং ফেং সরু গলির মাথায় গিয়ে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন। এসময় রাস্তায় তার রক্তাক্ত দু'পায়ের চিহ্ন পড়ে। এর পর তার শরীর অবস হয়ে যায়। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান।

এসময় যখন তাকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হচ্ছিল, তখন তিনি বলেন, 'আমি ঠিক আছি। অন্যদের হাসপাতালে পাঠান।' কিন্তু বাস্তবে তিনি ঠিক ছিলেন না। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন।

ভবনটিতে ওয়াং ফেং ছাড়া ২০ জন মানুষ ছিলেন। তারা কেউই গুরুতর আহত হননি। কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশি আঘাত পেলেন।

চিকিৎসক জানালেন, ওয়াং ফেংয়ের শরীরের ৯৮ শতাংশ পুড়ে গেছে এবং ফুসফুস ও দুটি চোখও গুরুতরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। দু'টি হাতের কিছু অংশ ছাড়া তার বাকি শরীর আগুনে পুড়ে যায়।

নান ইয়াংয়ের সরকার ওয়াং ফেংয়ের কথা শুনে তার যথাযথ চিকিৎসার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার শ্বাসযন্ত্র গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সার্জারির পর তার ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। তখন তাকে বেইজিংয়ের একটি বড় হাসপাতালে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। জরুরি অবস্থায় সরকার হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে। এই প্রথম নান ইয়াং শহর থেকে বিশেষ হেলিকপ্টারে কোনো সাধারণ মানুষকে বেইজিংয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

১২ জুলাই, দেড় ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে হেলিকপ্টার পৌঁছায় বেইজিং। বেইজিংয়ের চিকিসকরা ওয়াং ফেংকে বাঁচাতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকেন। ৫৫ দিন পর, ওয়াং ফেংয়ের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হয়। কিন্তু তিনি অধিকাংশ সময়ই ঘুমের ঘোরে থাকেন।

তার গল্প শোনার পর অনেক মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। জনৈক নারী ওয়াং ফেংয়ের স্ত্রীকে বলেন, "আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার মেয়ে ও ছেলের যত্ন নেবো। তাদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব আমার।"

হাসপাতালের একজন ক্লিনার তার মাসিক বেতন ১০০০ হাজার ইউয়ান ওয়াং ফেংকে দান করেন। তবে তিনি তার পরিচয় জানাতে অস্বীকার করেন।

সাংহাইয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মহিলা ও তার ৮ জন সহকর্মী ৭৯০০ ইউয়ান দান করেন।

প্রতিদিন ওয়াং ফেংয়ের স্ত্রী ভান পিন অসংখ্য ফোন পান। তিনি এ পর্যন্ত ২৪ লাখ ইউয়ান ডোনেশন পেয়েছেন। তবে ওয়াং ফেংয়ের চিকিৎসা ব্যয় হয়তো কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে যাবে।

৪ অগাস্ট ছিল ওয়াং ফেংয়ের স্ত্রীর ৩৪তম জন্মদিন। তবে তিনি স্বাভাবিকভাবেই তা পালন করেননি। তিনি গোটা দিন স্বামীর সঙ্গে ছিলেন। সেদিন তার স্বামীর শরীরে পঞ্চম সার্জারি করেন চিকিৎসকরা।

দুর্ঘটনার আগে, ৩৮ বছর বয়সী ওয়াং ফেং সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং পরিবারের তৃতীয় সন্তান। তার বাবা-মা এবং ভাই-বোন আছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন একজন শান্ত ছেলে। তার প্রিয় একটি উপন্যাস, 'সাধারণ পৃথিবী'-তে একটি কথা আছে: "যুবক, যে কোনো বিপদ আসুক না কেন, বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাও। তোমার সুযোগ আছে; নিজের জীবন পুর্ননির্মাণের সুযোগ।"

নিজের চেষ্টায় ওয়াং ফেং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পরে দীর্ঘ সময় মালয়েশিয়ায় কাজ করেন। তিনি দু'ছরের মতো তেলক্ষেত্রে কাজ করেন। তার কাজ পরিশ্রমের ছিল। কিন্তু তিনি কখনও অভিযোগ করতেন না।

এখন তিনি আইসিইউতে শুয়ে আছেন। মাঝে মাঝে জেগে উঠেন তিনি। তখন তিনি নার্সকে বলেন, "আমার প্রকৃত অবস্থা আমার স্ত্রীকে বলবেন না। তার বয়স কম। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েনি। ও হয়তো আপনাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারে। প্লিজ আপনারা তাকে কিছু বলবেন না।"

ভান পি নিজের জন্মদিনে উইশ করেছেন। তার উইশ হচ্ছে, স্বামীর দ্রুত সুস্থতা।

একজন মানুষ হঠাৎ করে বীরে পরিণত হতে পারে না। যারা ওয়াং ফেংকে চেনেন, তারা সবাই জানেন ওয়াং ফেং বিপদে মানুষের সাহায্যে সবসময়ই এগিয়ে আসতেন। ভান পিন তার স্বামীকে ভালোভাবে জানেন। তিনি বলেন, "যদি আবার ওই রাতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ হতো, আমার স্বামী এই একই কাজ করতেন।" (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040