শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে বাংলাদেশের নারী
  2016-08-21 21:01:24  cri

বাংলাদেশে শ্রমশক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু সাধারণভাবে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব সীমিত। বাংলাদেশ সরকার ও এনজিওগুলো দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নানারকম কর্মসূচি নিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের একটি উপায় হচ্ছে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। বিশেষ করে এমন সব প্রকল্পের মাধ্যমে যেগুলি নারীদের শিল্পোদ্যোগের মাধ্যমে আয় সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত করতে পারে।

উন্নত ও উন্নয়শীল সব দেশেই শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশেও নারীরা এখনও শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের মূল ধারায় আসে নি। শুধু ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে নারীর কিছু উপস্থিতি রয়েছে। অন্য সব ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি একেবারেই কম। অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তাই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। তারা প্রধানত গ্রামাঞ্চলের বাজারে কেন্দ্রীভূত অনানুষ্ঠানিক শিল্প খাতে কাজ করেন। তবে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো পরিকল্পিত ও সংগঠিত শিল্প খাতেও কিছু সংখ্যক নারী উদ্যোক্তার উপস্থিতি নজরে পড়ে।

শিক্ষার অভাবে ও চলাফেরায় সামাজিক বাধানিষেধের কারণে অধিকাংশ নারীই নিজেদের ক্ষমতা ও ব্যবসায়িক সুযোগের সদ্ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন নন। সকল যোগ্যতা থাকলেও নারীরা প্রায়শই ব্যবসায়িক উদ্যোগে ঝুঁকি নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ পায় না, বা পুঁজির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাছাড়া এমন কিছু আইনগত বাধা ও সামাজিক রীতিনীতি রয়েছে যেগুলি শিল্প ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

নারীরা যদি সামান্য কিছু ঋণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির কাছে আবেদন করে তাহলে তাদের অন্তত একজন পুরুষ অংশীদার থাকতে হবে। এ কারণে নারী উদ্যোক্তারা যদি অপেক্ষাকৃত বড় কোনো ব্যবসায়িক কর্মকান্ড শুরু করতে চায় তাহলে তাদের পুরুষের সঙ্গে যৌথভাবে তা করতে হয়। একইভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ লাভের ক্ষেত্রে শর্তাদি সম্পর্কে দরকষাকষিতে নারীদের সামর্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে সমাজে প্রচলিত লিঙ্গ সম্পর্কিত ধ্যানধারণা ও মানসিকতা।

নারী উদ্যোক্তাদের সামনে কিছু বিশেষ ধরনের সমস্যাও রয়েছে। পুরুষেরা নারী উদ্যোক্তাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চায় না। নারীদের ওপর এর একটা নিরাশাব্যঞ্জক প্রভাব রয়েছে। পুরুষ উদ্যোক্তাদের প্রাধান্যে পরিচালিত বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা নারী উদ্যোক্তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। চলাফেরার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক বিধিনিষেধের কারণেও নারী উদ্যোক্তারা অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলোচনা বা দরকষাকষিতে যেতে আগ্রহী হয় না।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রণীত বাংলাদেশ বিষয়ক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাড়তি অসুবিধা সৃষ্টি করে এমন কিছু বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণভিত্তিক কর্মকান্ডের বাইরে প্রধানত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা জরিপের ওপর ভিত্তি করে এই বিষয়গুলি চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, একই ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করার আগে পুরুষ উদ্যোক্তাদের কাজের অভিজ্ঞতা নারী উদ্যোক্তাদের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। পুরুষদের অভিজ্ঞতা গড়ে ৪.৯ বছর। আর নারীদের অভিজ্ঞতা গড়ে মাত্র ০.৮ বছর। অধিকাংশ পুরুষ উদ্যোক্তা (জরিপকৃতদের ৭৩.৮ শতাংশ) নিজেদের সঞ্চয় থেকে একটা মোটামুটি অঙ্কের নিট নিজস্ব মূলধন সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে নারীদের মধ্যে মাত্র ৪০.১ শতাংশ সামান্য কিছু সঞ্চয় করতে পারে। ফলে নারীরা ব্যাংকের ঋণ সমমূলধনের অনুপাতের শর্ত পূরণে সমস্যার সম্মুখীন হয়। যার ফলে নারীরা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হয়।

নারী উদ্যোক্তাদের চলাফেরায় সীমাবদ্ধতার কারণে নারীর মালিকানাধীন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় বাসস্থানের সীমানার মধ্যে। এর ফলে নারীরা প্রায়শই বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে তা হলো কোনো ব্যবসায়ে উদ্যোগ নিতে একজন নারী উদ্যোক্তার প্রাথমিক পুঁজি একই ধরনের ব্যবসার শুরুতে একজন পুরুষ উদ্যোক্তার প্রাথমিক পুঁজির মাত্র এক ষষ্ঠাংশ।

ক্ষুদ্র ঋণভিত্তিক ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের বাইরে একটা নতুন প্রবণতা ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাণিজ্যিক ও সেবা খাতে নারীদের গৃহীত উদ্যোগের সংখ্যা বাড়ছে। এসব নারী মূলত ধনী পরিবার থেকে আগত এবং তারা কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। বড় বড় শহরে এখন নারীদের মালিকানায় পরিচালিত অনেক বাটিক, বিউটি পারলার, রেস্তোরাঁ প্রভৃতি দেখা যায়। নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের অনেকেই এখন পুরুষ পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করার পরিবর্তে নিজেরাই কনসাল্টিং ব্যবসা শুরু করছেন।

তা ছাড়া মনোহারি দোকান, স্বাস্থ্য ক্লিনিক, কোল্ড স্টোরেজ, ভ্রমণ ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার মতো নানা ধরনের ব্যবসা নারীরা চালাচ্ছেন এমন দৃশ্যও এখন আর বিরল নয়। অনেক নারী উদ্যোক্তা বিদ্যালয়, বিশেষত ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়, টিউটোরিয়াল স্থাপনেও আকৃষ্ট হচ্ছেন। একজন নারী উদ্যোক্তা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সংখ্যায় কম হলেও নারীদের প্রতিষ্ঠিত তৈরি পোশাকের কারখানাও রয়েছে। ১৯৮০ সালে একজন নারী উদ্যোক্তা বৈশাখী গার্মেন্টস নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করেন যা এ দেশে প্রাচীন গার্মেন্টসগুলোর অন্যতম।

নারী উদ্যোক্তারা সামাজিক পুঁজি সংগঠনের জন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। ঢাকার নারী উদ্যোক্তারা একটি সমিতি গঠন করেছেন যার মাধ্যমে শিল্পে ও ব্যবসায়ে নারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দানের প্রয়াস চলছে। নারীদের শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে পৃষ্ঠপোষকতার উদ্দেশ্যে মাইডাস (Micro Industries Develpoment Assistance Society) দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নারী উদ্যোক্তার নেতৃত্বে একটি নারী উদ্যোগ উন্নয়ন কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি জামানত ছাড়া ঋণ দানের মাধ্যমে নারীদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণে সহযোগিতা দিয়ে আসছে।

ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশের নারীরা অনেক ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে থাকেন, বিশেষত গৃহস্থালী ও খামারভিত্তিক অর্থনেতিক কর্মকান্ডে ঐতিহ্যগতভাবেই তাদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। তারা নিজেদের পুঁজি বা ধার করা পুঁজি খামার গড়া বা শাকসবজির বাগান করার কাজে লাগিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করে থাকেন। এই অর্থে তাদের উদ্যোক্তাই বলা যায়। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা প্রচলনের পর থেকে এই শ্রেণীর নারী উদ্যোক্তারা অত্যন্ত দৃশ্যমান হয়ে উঠেছেন। পৃথক পৃথকভাবে এসব উদ্যোগের আকার বেশ ছোট বটে। কিন্তু গোষ্ঠী হিসেবে সাকুল্যে তারাই বাংলাদেশের বৃহত্তম নারী উদ্যোক্তা শ্রেণী।

শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে সাফল্যের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যজ্ঞান, শিক্ষাগত মান এবং শিল্প ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে উন্নয়ন সাধনের সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায় হচ্ছে নারী উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ। নারী উদ্যোগ বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের মধ্যকার সহযোগিতামূলক সম্পর্কে উত্সাহিত করে। নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা বাধাবিপত্তি ছাড়াও একটা প্রধান বাধা হচ্ছে নারীদের ঋণ লাভের সুযোগের অভাব। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির সাফল্যের পর তাদের অনুসরণে ব্যাপক সংখ্যক এনজিও ও জাতীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ক্ষুদ্র অর্থায়নের ফলে নারীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলির মাধ্যমে নারীরা নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা পাচ্ছেন। এখন অনেক নারীই অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করার পরিবর্তে আত্ম-কর্মসংস্থান বেশি পছন্দ করেন।

চাকুরির কঠোর শর্তাবলি, শিশুদের দেখাশোনা করার সুযোগের অভাব, অগ্রহণযোগ্য কাজের পরিবেশ, কাজের নির্দিষ্ট সময়ের অনমনীয়তা, চাকুরিক্ষেত্রে হতাশা, লিঙ্গ বৈষম্য ইত্যাদি কারণে অনেক নারীই এখন অন্যের প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতে আগ্রহী নন। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রচলিত কিছু আইন সংশোধনের শর্তারোপ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাপারে সামর্থ্য সৃষ্টিতে সহায়তা যোগানোর উদ্দেশ্যে সরকার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা তৈরি করেছে। (মান্না)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040