20160729yinyue.mp3
|
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি আনন্দি বেইজিং থেকে আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এ পর্বের সুর ও বাণী আসরে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো চীনের চলচ্চিত্র সংগীত জগতের একজন বিখ্যাত সুরকার লেই চেন পাংয়ের সাথে। আপনাদের শোনাবো লেই চেন পাংয়ের সৃষ্টি করা কয়েকটি শ্রুতিমধুর গান।
সুরকার লেই চেন পাং আর তার মেয়ে লেই লেই
বন্ধুরা, লেই চেন পাং ছিলেন চীনের চলচ্চিত্র সংগীত সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান, চীনের চলচ্চিত্র সমিতির স্থায়ী সদস্য, ষষ্ঠ জাতীয় গণ রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্য।
ত্রিশ বছরের বেশি সময়ের সংগীত জীবনে তিনি শতাধিক চলচ্চিত্রের গান লিখেছেন। তিনি পাই, চুয়াং, ঈ, লাখু, তাজিখ এবং কোরীয় জাতিসহ নানা সংখ্যালঘু জাতির জন্য গান লিখেছেন। তার গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি সুর দিয়ে মানুষের প্রেম, বন্ধুত্ব ও স্নেহ ভালোভাবে প্রতিফলন করতে সক্ষম। গত শতাব্দীর ৫০ থেকে ৬০ দশক তার সংগীত জীবনের স্বর্ণ যুগ। তবে তার গানগুলো আজও চীনে বেশ প্রচলিত।
চলচ্চিত্র 'হিমশৈল থেকে আসা অতিথি'
প্রিয় শ্রোতা, লেই চেন পিংয়ের তৈরি করা গানের মধ্যে 'হিমশৈল থেকে আসা অতিথি' নামে সিনেমার গানগুলো সবচেয়ে বিখ্যাত। এ সিনেমা ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়। এ সিনেমায় চীনের সিন চিয়াং সীমান্ত অঞ্চলে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় গুপ্তচরদের মাঝের সংগ্রামের গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। সিনেমায় যোদ্ধা আমির এবং সত্য-মিথ্যা গুলানডাম নামে দুইজন মেয়ের প্রেমের কাহিনীও রয়েছে। এ সিনেমা ১৯৬৪ সালে ছাংছুন চলচ্চিত্র কোম্পানির শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পায়। এ সিনেমার থিম সং 'ফুল কেন এতো লাল' খুব দ্রুত দর্শকের মন জয় করে।
সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'ফুল কেনো এতো লাল' নামের গানটি। এ গানের সুর করেছেন লেই চেন পাং। গেয়েছেন সোং চু ইং। গানের কথা এমন, 'ফুল কেনো এতো লাল? যেন জ্বলন্ত আগুনের মতো। এটাই মৈত্রী ও পবিত্র প্রেমের প্রতীক। ফুল কেনো এতো টাটকা? অপূর্ব এ ফুল দেখে মন চলে যেতে চায় না। এ ফুল তারুণ্যের রক্ত দিয়ে সিক্ত করা হয়েছে।'
এ সিনেমায় দোতারা ও রেওয়াগু নামে সিনচিয়াংয়ের স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র এবং ঢোল ও বেহালার মাধ্যমে সিনচিয়াংয়ের লোকসংগীত বাজানো হয়। সিনেমার মূল সুর রোমান্টিক ও বেদনাদায়ক। এ সুর শুনে চোখের জল ঝরে। 'ফুল কেনো এতো লাল' গানটি এ সিনেমায় তিনবার প্রচারিত হয়েছে। এ সুর পুরো ছবিতে ছিল।
শ্রোতাবন্ধুরা, এবার শুনুন এ সিনেমার আরেকটি গান। এ গানের নাম 'সহযোদ্ধাদের স্মরণ'। লেই চেন পাং এ গানের সুর করেছেন এবং কথা লিখেছেন। গেয়েছেন লিউ হুয়ান।
এ গানে বলা হয়েছে, 'থিয়ান শান পাহাড়ের নিচে আমার প্রিয় জন্মস্থান। অ্যাসপান্ গাছের নিচে আমার প্রিয় মেয়েটি থাকে। সে বিদায় নেবার পর দোতারা দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ আর বাজায় না। প্রিয় সহযোদ্ধা, তুমি আর আমার বাজানো সুর ও গান শুনতে পাবে না। আমিও তোমার ওই স্নিগ্ধ চেহারা আর দেখতে পাবো না।'
'হিমশৈল থেকে আসা অতিথি' নামের সিনেমাটি বিপ্লব, বীরত্ব ও রোমান্টিকতা সংমিশ্রণে নির্মিত একটি ক্ল্যাসিক সিনেমা। বহু বছর পরও এ সিনেমার কিছু দৃশ্য স্পষ্ট আমার মনে আছে। এ সিনেমায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সৈন্যদের বীরত্ব প্রশংসনীয়। সিনেমার গানগুলোতে সিনচিয়াংয়ের সংখ্যালঘু জাতির লোকসংগীতের প্রভাব রয়েছে। 'হিমশৈলের ওপর তুষার পদ্ম' নামে গানটিতে মালভূমির বরফের মধ্যে মোতায়েন করা যোদ্ধাদের দেশ রক্ষার পবিত্র কর্তব্য পালনের বীরত্ব প্রকাশিত হয়েছে।
লেই চেন পাং ১৯১৬ সালের মে মাসে বেইজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মান জাতির লোক। ছোটবেলা থেকে তিনি পিকিং অপেরা পছন্দ করেন। সাত আট বছর বয়স থেকে তিনি হুচিন দিয়ে পিকিং অপেরার অংশ বাজাতে পারেন এবং পিকিং অপেরাসহ অন্য কিছু গান গাইতে পারেন। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি জাপানে গিয়ে টোকিওয়ের একটি উচ্চ শ্রেণীর সংগীত কলেজে কম্পোজ বিভাগে ভর্তি হন। তিনি স্নাতক হওয়ার পর ১৯৪৩ সালে চীনে ফিরে আসেন।
লেই চেন পাং বেইজিং ছাত্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও হুইচো ছাত্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংগীত শিক্ষক ছিলেন। জাপানি আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধ জয়ের পর তিনি ৫০ জনের একটি অপেশাদার সিমফনি অর্কেস্ট্রা গঠন করেন। ১৯৪৯ সালের জুনে তিনি চীনের চলচ্চিত্র অর্কেস্ট্রায় যোগ দেন। তখন থেকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সিনেমার জন্য সংগীত তৈরি করা শুরু করেন।
১৯৬০ সালে চীনের দ্বিতীয় শত ফুল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে 'লিউ সান চিয়ে' নামে সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পুরস্কার পান। এটি লেই চেন পাংয়ের প্রতিনিধিত্বশীল কাজগুলোর অন্যতম। এ সিনেমা চীনের প্রথম সংগীত ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের আর্টফিল্ম। এ সিনেমায় লিউ সান চিয়ে নামে একজন সুন্দর মেয়ের গ্রামবাসীদের সঙ্গে পাহাড়ি গান গেয়ে দৈত্যাকার মানুষের সঙ্গে সংগ্রাম করার গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'লিউ সান চিয়ে' নামে সিনেমার গান 'পাহাড়ী গান বসন্তের নদীর পানির মতো'। গেয়েছেন সোং চু ইং। গানের সুর করেছেন লেই চেন পাং।
সুর করার জন্য লেই চেন পাং নানা জায়গায় গিয়ে লোকশিল্পীদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তার সংগীতের মধ্যে গভীরভাবে জাতিগত ও স্থানীয় সংগীতের প্রভাব রয়েছে। সংখ্যালঘু জাতির জীবনভিত্তিক সিনেমা 'পাঁচটি স্বর্ণ ফুল', 'লিউ সান চিয়ে', 'চিংপো জাতির মেয়ে' এবং 'লু শেং প্রেমের গান' এর জন্য তৈরি করা সুরগুলোতে এ সব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।
চলচ্চিত্র 'পাঁচটি স্বর্ণ ফুল'
প্রিয় বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'পাঁচটি স্বর্ণ ফুল' নামে সিনেমার প্রধান সুর। এ সিনেমা ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। এটি হচ্ছে পরিচালক ওয়াং চিয়া ইয়ের পরিচালিত একটি রঙিন দৃশ্য ও নৃত্যগীত ফিল্ম। এ সিনেমার প্রধান চরিত্র আফেং তার বান্ধবী চিন হুয়াকে খুঁজে বের করার গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। এ সিনেমার স্যুটিং করা হয় ইয়ুননান প্রদেশের দালি স্বায়ত্তশাসিত বিভাগে। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম। ছাং পাহাড়, এর সাগর আর প্রজাপতি ঝরণার কারণে বিশ্ববিখ্যাত এ এলাকা। সেখানে বসবাসরত পাই জাতির মেয়েদের সাধারণত চিন হুয়া দিয়ে নামকরণ করা হয়। প্রতি বছরের মার্চ মাসে চাং পাহাড়ের নিচে 'মার্চ সড়কে' মহাসম্মেলনের আয়োজিত করা হয়। গ্রামবাসীরা চারদিক থেকে এসে সেখানে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় এবং নানা বিনোদন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। যুবক যুবতীরা এখানে বন্ধুত্ব স্থাপন করে বা প্রেমের বীজ বপন করে। বন্ধুরা, শুনুন 'মার্চ মাসে দালির সুন্দর দৃশ্য' নামে একটি সুর।
'প্রজাপতি ঝরণার তীরে' হচ্ছে 'পাঁচটি স্বর্ণ ফুল' নামক সিনেমার একটি গান। সুরকার লেই চেন পাং পাই জাতির লোকসংগীতের ভিত্তিতে এ গানের সুর করেছেন। গানের কথা লিখেছেন চি খাং। দু'জন প্রেমিক ও প্রেমিকার কথোপকথন-ই এ গানের কথা। তারা প্রজাপতি ঝরণার তীরে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে হৃদয়ের কথা বলে।
'লুশেং প্রেমের গান' হচ্ছে চীনের লাঘু জাতির প্রেমের গল্প। লাঘু জাতি ইয়ুননান প্রদেশের লানছাং নদী অববাহিকায় বসবাস করে। তারা সাহসি, পরিশ্রমি ও সরল। প্রাচীনকাল থেকে ক্ষমতাসীন শ্রেণীর নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়ে তাদের প্রতিরোধ করার চরিত্র গড়ে উঠেছে। গণপ্রজাতন্ত্র চীন প্রতিষ্ঠার আগে কুওমিনতাং পার্টির শাসন আমলে প্রতি বছর ফলনের সময় কুওমিনতাং পার্টির সৈন্যরা এসে তাদের ফসল ছিনিয়ে নিয়ে যেত। এ সিনেমায় সেই কালো যুগের এক প্রেমের গল্প বলা হয়েছে।
বন্ধুরা, এবার শুনুন 'লুশেং প্রেমের গান' নামে সিনেমার প্রধান গানটি। এ গানের নাম 'বিয়ের ব্রত'। গেয়েছেন হাং হো ও সুন নান। গানে প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে গভীর ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। তারা টাটকা ফুল ও মৌমাছির মতো। তাদের কোনো ভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
চলচ্চিত্র 'লুশেং প্রেমের গান'
শ্রোতাবন্ধুরা, পরিতাপের বিষয় হলো মহাসাংস্কৃতিক বিপ্লব সুরকার লেই চেন পাংয়ের জীবনের পথ একদম পরিবর্তন করে দেয়। গত শতাব্দীর ৭০'র দশকের শেষ দিকে তার সুরকার জীবন শেষ হয়ে যায়। পরে তার মেয়ে লেই লেইও তার মতো একজন সুরকার হয়েছেন। বাবার সঙ্গে কিছু টেলিভিশন নাটক ও সিনেমার জন্য সুর করেছেন।
আজকালের তরুণ-তরুণীরা হয়তো লেই চেন পাংয়ের নাম খুব বেশি জানে না। কিন্তু তার রচিত গানগুলো এখনো নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে বার বার পরিবেশিত হয়। সংগীত এমন জিনিস তার সঙ্গে সম্পর্কিত সব লোক এ পৃথিবী থেকে সরে গেলেও সে সুর থেকে যায় বছরের পর বছর।
সুপ্রিয় বন্ধুরা, এ পর্বের 'সুর ও বাণী' আসরে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছি চীনের সিনেমা জগতের বিখ্যাত সুরকার লেই চেন পাংয়ের সাথে। আশা করছি তার গানগুলো আপনাদের ভালো লেগেছে।
আজ এ পর্যন্তই। আমি বিদায় নিচ্ছি। সবাই ভালো থাকুন। আবার কথা হবে। (ইয়ু/মান্না)