চীনের শিক্ষার্থী ভান ইয়াও: দক্ষিণ মেরুর গবেষক
  2016-07-27 09:02:39  cri

 



১.৫ টন সরঞ্জাম নিয়ে দশ-বারো হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করে দক্ষিণ মেরুর সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থিত খুন লুন গবেষণালয়ে পৌঁছান চীনের শিক্ষার্থী ভান ইয়াও। সেখানে তিনি কিছু মৌলিক গবেষণা করেন। বরফের ২০০ মিটার নিচে তাকে গবেষণা করতে হয়েছে।

১৮ জুলাই। দক্ষিণ মেরু থেকে ফিরে আসার পর ভান ইয়াওয়ের প্রথম গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখা প্রায় শেষ। প্রবন্ধের শিরোনাম 'দক্ষিণ মেরুতে চীনা গবেষণালয় জুং সান ও খুন লুন: বরফের ২০০ মিটার নিচের কাঠামো'।

১৯৯২ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভান ইয়াও। তিনি এখন থাই ইউয়ান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তড়িৎ ও পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র। পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে তিনি আরামে-আয়েশে বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময়ই তিনি দক্ষিণ মেরু যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দক্ষিণ মেরুর কঠোর পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তিনি নিয়মিত কঠোর শরীরচর্চা শুরু করেন। তিন বছর ধরে তিনি প্রতিদিন অন্তত ৪০০০ মিটার দৌড়াচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি স্নাতক পর্যায়ে তার টিউটর হিসেবে মেরু বিশেষজ্ঞ তো ইন খ্য-কে বেছে নেন এবং তার কাছ থেকে মেরু সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন।

২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ভান ইয়াওয়ের সুযোগ আসে। তার টিউটরের কাছে দক্ষিণ মেরুতে গবেষণা করার সুযোগ আসে। তিনি ৬০ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে ভান ইয়াওকে সে সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভান ইয়াও ৩২তম চীনা দক্ষিণ মেরু গবেষণা দলের সবচেয়ে তরুণ সদস্য হিসেবে দক্ষিণ মেরুতে কাজ করেন। এ সময়কালে তিনি ৫টি আইস সাবস্ট্যান্স প্রসেস মনিটরিং সিস্টেম, একটি বরফের উপরিতলের বৈশিষ্ট্য সনাক্তকরণ সিস্টেম, ২টি Glacier movement monitoring system, একটি এক্সপ্লোরেশন বরফ রাডারসহ মোট ১.৫ টন ওজনের সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করেন।

৫ জানুয়ারি। তিনি দক্ষিণ মেরুর সর্বোচ্চ স্থান, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০৯৩ মিটার উঁচুতে দাঁড়িয়ে গায়ের ওভারকোট খুলে ছবি তোলেন।

দক্ষিণ মেরুতে ভ্রমণ অন্য দশটা সাধারণ ভ্রমণের মতো নয়। এখানে কঠোর পরিবেশের সাথে রীতিমতো লড়াই করে বাঁচতে হয়। মাথার উপরে প্রবল তুষারঝড়, পায়ের নীচে বরফের ফাটল। মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দক্ষিণ মেরুর সর্বোচ্চ স্থানে যাওয়া সহজ কাজ নয়।

প্রতিকূল পরিবেশেই সেখানে ভান ইয়াওকে কাজ করতে হয়। আইস সাবস্ট্যান্স প্রসেস মনিটরিং সিস্টেমের মূল অংশ একটি আয়রন তাক। এ তাকের উচ্চতা এক তলা ভবনের সমান। এ তাকটি গড়ে তুলতে এক একটি স্ক্রু লাগাতে হয়। অথচ হাতের গ্লাভস্‌ পরে এ কাজ করা সম্ভব নয়। তাই কাজটি করার সময় ভান ইয়াওকে গ্লাভস্‌ খুলে রাখতে হয়। এতো নিম্ন তাপমাত্রায় খালি হাতে লোহার তাক স্পর্শ করা আর হাতের মধ্যে লোকার পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া—একই কথা। ভান ইয়াও হাসতে হাসতে বলেন, এ কাজ করতে গিয়ে কখনও কখনও গোটা হাতে ফোস্কার পড়েছে। তা ছাড়া, যেসব জিনিষপ্রত্র নিয়ে ভানকে কাজ করতে হয়েছে, সেগুলো অনেক ভারী। যেমন, এক্সপ্লোরেশন বরফ রাডারের ব্যাটারির ওজন ১০০ কেজি। ভান ইয়াওকে প্রতিদিন অন্তত দু'বার এ ব্যাটারি পরিবর্তন করতে হয়েছে।

এ ছাড়াও তাদেরকে অন্যরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হয়েছে। দক্ষিণ মেরুতে গবেষণার সময় যেটি গবেষকদের জন্য বড় বিপদ হিসেবে দেখা দেয় সেটি হচ্ছে বরফের ফাটল। এবার গবেষণাদল দক্ষিণ মেরু অভিযানের বেইজ ক্যাম্প থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে একটি জায়গায় কয়েক হাজার মিটার গভীর একটি বরফ ফাটল আবিষ্কার করে। কেউ কল্পনাও করেনি যে, ক্যাম্পের এতো কাছে এতো বড় ফাটল থাকতে পারে! একবার এ ফাটলে পড়লে আর রক্ষা নাই!!

এন্টার্কটিকা মহাদেশে ৫৫ দিন ছিলেন ভান ইয়াও। জুং সান গবেষণাকেন্দ্র থেকে খু লুন গবেষণাকেন্দ্রের দূরত্ব ১৩০০ কিলোমিটার। এখানে ভানকে কাজ করতে হয়েছে নিরলসভাবে।

একের পর এক বিভিন্ন সরঞ্জাম স্থাপন করেছেন তিনি। বরফের ওপরে বাটালি মেরে একের পর এক গুহা তৈলি করেছেন। তার পরিশ্রমে দক্ষিণ মেরুর বরফের ২০০ মিটার নীচের কিছু মূল্যবান উপাত্ত পাওয়া গেছে। যখন সাংবাদিক থাই ইউয়ান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভান ইয়াওয়ের সঙ্গে দেখা করেন, তখন ভান দক্ষিণ মেরু থেকে আনা বিভিন্ন উপাত্ত নিয়ে কাজ করছিলেন।

তার শিক্ষক তো ইন ছুখ্য সাংবাদিককে জানান, আগে দক্ষিণ মেরুর বরফ সম্পর্কে আমাদের গবেষণা উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এসব তথ্য-উপাত্তে ভুলের হারও বেশি থাকতো। দক্ষিণ মেরুর হিমবাহ প্রতি বছর ১.৫ থেকে ২ মিটার করে গলছে। কিন্তু এ তথ্যে ভুলের হার ছিল বেশি। এখন ভান ইয়াওয়ের স্থাপন করা সরঞ্জামের সাহায্যে এ হিসেবের ত্রুটি কয়েক সেন্টিমিটারে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

দক্ষিণ মেরুতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বসিয়ে আরও সঠিক উপাত্ত পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এর জন্য সংশ্লিষ্ট গবেষকদের প্রাণের ঝুঁকি নিতে হয়। আবার এধরনের গবেষণার বাজারদর কম হওয়ায়, অনেক শিক্ষার্থী এ কাজটি করতেও চায় না। অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত গবেষণার জন্য উপাত্ত প্রয়োজন, সরঞ্জাম প্রয়োজন। তো ইন খ্য বলেন, ৯০ দশকে জন্মগ্রহণকারীদের একজন হয়েও মৌলিক ক্ষেত্রে গবেষণা করতে আগ্রহ দেখিয়েছে ভান ইয়াও, যা খুব প্রশংসনীয়। সে উপাত্তভিত্তিক কাজ করতে চায়, যা তরুণ গবেষকদের জন্য একটি ভালো দৃষ্টান্ত।

বর্তমানে ভান ইয়াও ও তার শিক্ষক দক্ষিণ মেরু থেকে পাওয়া নানান উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করছেন। গত ৪০ হাজার বছরে দক্ষিণ মেরুর বরফের পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে তারা কাজ করছেন। তাদের গবেষণা সফল হলে একদিন হয়তো দক্ষিণ মেরুতে বরফের পরিবর্তন প্রক্রিয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আরও নিখুঁতভাবে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হবে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040