20160720yinyue.mp3
|
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি আনন্দি, বেইজিং থেকে আপনাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এ পর্বের সুর ও বাণী আসরে চীনের নতুন যুগের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটকের জনপ্রিয় সুরকার চাও চি পিংয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো এবং তার কয়েকটি গান শুনাবো।
চাও চি পিং
বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন 'বীরদের গান'। এ গানটি হলো টেলিভিশন নাটক 'জলসীমা' এর থিম সং। গানের কথা লিখেছেন ই মিং, সুর করেছেন চাও চি পিং, গেয়েছেন লিউ হুয়ান। গানের মুল সুর চীনের শানতোং, হোনান ও হোপেই প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত লোকসংগীতের সুরের সমন্বয়। চাও চি পিং চীনের লোকসংগীতের ভিত্তিতে এ গানকে নতুন প্রাণ দিয়েছেন এবং বিরাট সাফল্য অর্জন করেছেন। এ গানটি বিংশ শতাব্দীর সর্বোত্কৃষ্ট চীনা গান।
চাও চি পিং ১৯৪৫ সালের অগাস্ট মাসে কানসু প্রদেশের পিং লিয়াংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চীনের কেন্দ্রীয় সংগীত ইনস্টিটিউটের কম্পোজ বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি চীনের সংগীতজ্ঞ সমিতির সভাপতি ও শানসি প্রদেশের সাহিত্য ও শিল্পকলা ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৪ সালের পর তিনি চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্রের জন্য সুর করেছেন। তার বহু সংগীত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে পুরস্কার পেয়েছে।
চীনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক চাং ই মৌ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের সুর সৃষ্টি করার দায়িত্ব দেন চাও ছি পিংকে। কারণ তিনি ভালো করে জানেন, চাও ছি পিং চীনের ঐতিহ্যবাহী সুর দিয়ে সবচেয়ে সুন্দর আধুনিক গান সৃষ্টি করতে পারেন। 'লাল সরগাম' হচ্ছে চাং ই মৌর বিখ্যাত একটি চলচ্চিত্র। এটি নোবেল সাহিত্য পুরস্কারজয়ী মো ইয়ানের একই নামের উপন্যাসের ভিত্তিতে তৈরি। চলচ্চিত্রে জাপানি আগ্রাসনবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় চীনের শানতোং প্রদেশের কাও মি অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রতিরোধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে এ ছবি ৩৮তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে 'স্বর্ণ ভালুক' পুরস্কার জিতে নেয়। এ চলচ্চিত্রের সবগুলো সংগীত তৈরি করেন চাও ছি পিং।
এজন্য তিনি চীনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন। তিনি ৩০টি সোনা, চারটি শেং আর একটি বড় ঢাক দিয়ে 'ছোট বোন, তুমি সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাও' নামের প্রধান গানে সুরারোপ করেন। তার সুর শত্রুদের বিরুদ্ধে চীনা নাগরিকদের প্রাণের হুংকার হিসেবে ফুটে ওঠে। শুনুন গানটি।
চাও চি পিং দীর্ঘকাল পশ্চিম চীনের শানসি প্রদেশে বাস করেছেন। তার বাড়ি সিআন পাথর-ফলকের বন জাদুঘরের পাশে। ছোটবেলা থেকে চীনের ইতিহাস ও জাতিগত শিল্পকলা তাকে মুগ্ধ করত। জাদুঘরে প্রদর্শিত চীনের থাং রাজবংশের নানা সামগ্রী দেখে ধারণা হয় যে, সে সময় থাং রাজত্ব বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ছিল। বিভিন্ন দেশের লোক চীনে আসত। সিআন ছিল রেশমপথের সূচনাস্থল। বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি সিআনে এসে মিলিত হত। জাদুঘরের দেয়ালচিত্রে পুরানো দিনের জাতীয় বাদকদল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৮২ সালে তিনি 'রেশমপথের সুর' আর 'স্বপ্নে মহা থাং রাজত্বে প্রত্যাবর্তণ' নামে সিমফনি সৃষ্টি করেন। এ সুরগুলো সিআনের মহা থাং বাগানে বহুবার পরিবেশন করা হয়।
চাও চি পিং সংগীতের জন্য হাজার হাজার বই পড়েছেন, হাজার হাজার মাইল পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসংগীতের পুষ্টি ও আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন।
চলচ্চিত্রের সংগীত তৈরির পাশাপাশি তিনি চীনের কিছু জনপ্রিয় টেলিভিশন নাটকের সংগীতেও সুর দিয়েছেন। যেমন 'ছিয়াও পরিবারের অঙ্গন' টিভি নাটকের প্রধান গানে সুর দিয়ে প্রধান চরিত্র ছিয়াও ছি ইয়োং-এর অসাধারণ ব্যবসায়ী জীবনকে তুলে ধরেছেন। এ গানে শানসি প্রদেশের লোকসংগীতের প্রভাব রয়েছে। এখন শুনুন এ গানটি।
২০০৭ সালে 'লান তো হোয়া' নামে ৩৫ পর্বের টেলিভিশন নাটক সারা চীনে প্রচারিত হয়। এটা চাও চি পিং এবং পরিচালক ইয়ু রোং কুয়াংয়ের সহযোগিতার ফসল। এ নাটকের সংগীতে হোয়াংহো অববাহিকার লোকসংগীতের প্রভাব রয়েছে। সুর করার আগে তিনি শানসি ও শায়ানসি এর উত্তরাঞ্চল ভ্রমণ করেন এবং স্থানীয় লোকসংগীত শোনেন। এরপর ফিরে এসে তিনি গানের সুরারোপ শুরু করেন। পরবর্তীতে দর্শকরা তাদের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, 'এ নাটকের থিম সং শুনে চোখে জল আসে। সংগীতগুলো খুবই হৃদয়স্পর্শী।' বন্ধুরা, শুনুন 'লান তো হোয়া' গানটি। গেয়েছেন হোং শুয়ে।
চলচ্চিত্র সংগীত মহলে চাও চি পিং সর্বোচ্চ মূল্যায়ন ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তিনি চীনের চলচ্চিত্র সংগীত জগতে সর্বাধিক পুরস্কারজয়ী সুরকার। ১৯৯৬ সালে সুইজারল্যান্ডে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সংগীত উত্সবে অংশ নেন তিনি। এ চলচ্চিত্র সংগীত উত্সবে তিনিই ছিলেন একমাত্র এশীয় সংগীতজ্ঞ। বিখ্যাত ওয়ার্নার মিউজিক কোম্পানি সে সময় তার ডিস্ক প্রকাশ করে।
বন্ধুরা, এখন আপনারা শুনছেন গায়িকা হু সিয়াও ছিংয়ের কণ্ঠে 'বড় পরিবার' নামে টিভি নাটকের গান। এ টিভি নাটকের সবগুলো সুর করতে চাও চি পিং মাত্র ১০ দিন সময় নিয়েছেন। কিন্তু গায়িকা হু সিয়াও ছিং বলেন, 'তার গানের মধ্য দিয়ে আমার বহু বছরের সব কষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। তার গানগুলো গাওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। একটি গানে পিকিং অপেরা, পিং অপেরা, ইয়ু অপেরা, লোকসংগীত ও পপ সংগীতসহ সংগীতের নানা উপাদানের সমন্বয় ঘটেছে। তিনি সত্যিই অসাধারণ।"
চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকে সুর করার পাশাপাশি চাও চি পিং জাপানের আগ্রসনবিরোধী যুদ্ধ আর বিশ্ব ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধজয়ের ৬০তম বার্ষিকী এবং নানচিং গণহত্যার জন্য বড় আকারের সিমফনি 'শান্তির প্রশংসা' তৈরি করেন। ২০০৫ সালের মে মাসে মহাগণভবনে তা পরিবেশিত হয়। চীনের সংগীত মহল এ সম্পর্কে বলেছে, পশ্চিমা বিটোফেনে 'আনন্দের প্রশংসা' আছে আর, চীনে চাও চি পিংয়ের 'শান্তির প্রশংসা' আছে।
বন্ধুরা, এখন শুনছেন 'পাও দা শুয়াং দেং' নামে চলচ্চিত্রের মূল সুর। চাও চি পিং বাঁশি ও অর্কেস্ট্রার সমন্বয়ে হোয়াংহো নদী তীরের এক গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মালিক ও দাসের মধ্যে প্রেমের বিয়োগান্তক গল্প তুলে ধরেছেন। শুনুন।
২০০৩ সালে চাং চি পিং যুক্তরাষ্ট্রে একক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যা দর্শকদের প্রশংসা পায়। তারা বলেন, 'চীনের সংগীত অনেক সুন্দর। আর চাও চি পিংয়ের সংগীত হলো চীনাদের অহংকার।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের শেষে শুনুন চাও চি পিংয়ের আরেকটি সুর 'কুয়ান শা ইয়ু'। চীনা বংশোদ্ভূত আমেরিকান চেলো বাদক মা ইয়ো ইয়ো সারা বিশ্বে এ সুর বাজিয়েছেন।
বন্ধুরা, এ পর্বের সুর ও বাণী আসরে আপনাদের জন্য চীনের বিখ্যাত সুরকার চাও চি পিংয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেছি। তার সৃষ্টি করা সুরগুলো আপনাদের কেমন লেগেছে? ভালো লাগলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না।
আজ তাহলে আমি বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকুন সবাই। আবার কথা হবে।
(ইয়ু/তৌহিদ)