বীর চালক: হুয়াং কুই ছুয়ান
  2016-07-20 13:39:54  cri



চীনের সি ছুয়ান প্রদেশে পাহাড়ি ভূমিধসের কবলে পড়েছিল একটি গাড়ি। চালক ছিলেন অভিজ্ঞ। বহু বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন। তিনি বুঝে ফেললেন কী ঘটতে যাচ্ছে। তিনি গাড়ি থামালেন এবং ব্যাক গিয়ার দিয়ে গাড়ি পেছনের দিকে চালাতে লাগলেন। এভাবে গাড়িটি পাহাড়ি ধসের কবল থেকে বাঁচল, প্রাণে বাঁচলেন গাড়ির ৪২ জন যাত্রী। তার পেছনের গাড়িগুলোও ব্যাপারটা টের পায় এবং নিরাপদ দূরত্বে থাকে।

আমাদের এই হিরোর নাম হুয়াং কুই ছুয়ান। বয়স ৫৯। অভিজ্ঞ গাড়িচালক। তিনি সাধারণ একজন মানুষ এবং কখনও মহান কোনো কাজ করেননি। তবে তিনি একজন ভালো মানুষ; নিজের পেশা ও জীবনের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ আছে। নিজের প্রতি ও অন্যের প্রতি তার দায়িত্ববোধও প্রবল। আর এসব কারণেই অনেকগুলো মানুষের জীবন বাঁচল। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা সম্প্রতি চীনা ইন্টারনেটে জনপ্রিয় এ সংশ্লিষ্ট একটি ভিডিও এবং এ ভিডিওর পেছনের গল্প বলব।

সড়ক রাস্তার এক পাশে ছিল একটি বাস।অন্য পাশে খাঁড়া উঁচু দুরারোহ পর্বতশ্রেণী ও নদী। বাসের সামনে অদূরে একে পরে এক পাথর পাহাড়ের উপার থেকে পড়ছে। কিছু সেকেন্ডের পর পাহাড়ী ভুমিধস হয়েছে। পাহাড়ের পাথর জলপ্রপাতের মতো পড়ছে। ভিডিওতে প্রকম্পিত স্ক্রিনের সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায় চিৎকার ও কাঁদার শব্দ। চলচ্চিত্রের মতো ১৭ সেকেন্ডের এ ভিডিও সম্প্রতি চীনে ইন্টারনেটে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

গত ৮ জুলাই রাত ৮টা ০৬ মিনিটে ভিটিওচিত্রটি ধারণ করা হয়। এদিন ৪২ জন যাত্রী নিয়ে একটি বাস সি ছুয়ান প্রদেশের ছেং তু শহর থেকে কাং তিং শহরে যাচ্ছিল। বাসটি যখন ইয়া আন শহরের থিয়ান ছুয়ান জেলার সিয়াও হে উপজেলায় পৌঁছায়, ঠিক তখনই পাহাড়ী ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রায় ১১ হাজার ঘন মিটার মাটি রাস্তার ওপরে এসে পড়ে এবং রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের হিরোর বুদ্ধি, সাহস ও সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত অনেকগুলো মানুষের প্রাণ বাঁচায়।

যে ভিডিওচিত্রের কথা বলছি, সেটি ওই বাসের একজন যাত্রীর তোলা। ছেং ছিয়াং নামক এ যাত্রী বলেন, চালক হুয়াং সবাইকে বাঁচিয়েছেন। সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক সেকেন্ড দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। চালক বুদ্ধি করে গাড়িটিকে পেছনে সরিয়ে না-নিলে নিশ্চিতভাবে লক্ষ টন মাটির নিচে চাপা পড়তো।

চালক হুয়াং কুই ছুয়ানের বুদ্ধি আর সাহসের কথা এই ভিডিওচিত্রটির মাধ্যমে গোটা দেশে ছড়িয়ে পরে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ভিডিওটি দেখে হুয়াংয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। একজন লিখেছেন: 'আমি একবার কাং তিং শহরে গিয়েছিলাম। আমি জানি সেখানে রাস্তা খুবই সরু। রাস্তার একদিকে নদী আর অন্যদিকে খাদ। তাই এ রাস্তায় গাড়ি চালানো কঠিন।"

ভিডিওচিত্রটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর একজন সাংবাদিক ছেং তু বাস স্টেশনে চালক হুয়াং কুই ছুয়ানের সঙ্গে দেখা করেন। হুয়াং তখন গাড়ির ফিটনেস চেক করছিলেন এবং পরের দিন কাং তিন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তিন দিন আগে ওই ভূমিধসের প্রসঙ্গ তোলায় হুয়াংয়ের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। হুয়াং বললেন, তিনি নিজেও ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। ঘটনার পর দুঃস্বপ্নও দেখেছেন। দেখেছেন, গাড়িটি মাটিচাপা পড়েছে।

৫৯ বছর বয়সি হুয়াং কুই ছুয়ান সারাজীবন গাড়িচালক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৩ বছর আগে তিনি ব্যাংকের Armored car-এর চালক ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর তিনি বাস কোম্পানিতে কাজ নেন। সেখানে এখনও কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত ছেং তু-কাং তিং এ রুটে আসা-যাওয়া করেন। এ এলাকার মানুষ হুয়াং এবং এখানে বড় হয়েছেন, বাস করেন। তিনি বুঝতে পারেন এ রুট কত বিপজ্জনক। শীতকালে তুষারে ঢাকা থাকে সারা পাহাড়, রাস্তাও পিচ্ছিল।গ্রীষ্মকালে ঝড় হয় এবং মাঝে মাঝে ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। যে রুটে তিনি নিয়মিত গাড়ি চালান, সে রুটে কোথায় কোথায় ধস হয়, কোথায় কোথায় বাঁক বা উঁচুনিচু—সবই তার নখদর্পণে। তিনি বলেন, সময় বাঁচানোর জন্য দ্রুত চলার চেয়ে, এক-দুই মিনিট পর্যবেক্ষণ করে নিরাপদ থাকা জরুরি। তার এই সাবধানতাই তাকে আলোচ্য দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করেছে।

হুয়াং কুই ছুয়ান জীবনে কয়েক বার পাহাড়ী ভুমিধস দেখেছেন। কিন্তু এবারেরটা ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক। তিনি বলেন, এবার ঠিক আমার সামনে পাহাড়ধস ঘটে। ওই দিন টানা বৃষ্টি হয়। তার বাসের যাত্রীদের মধ্যে অর্ধেকই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ জন্য তিনি অতিরিক্ত সাবধান হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। রাত ৮টার দিকে তিনি সামনের পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়তে দেখেন। তিনি দ্রুত গাড়ি থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, 'আমি দেখি পাহাড়ে গাছ নড়ছে, অথচ তখন বাতাস ছিল না! আমি বুঝলাম পাহাড় কাঁপছে বলেই গাছও নড়ছে। আমি দ্রুত গাড়ি পিছনের দিকে দশ-বারো মিটার চালিয়ে নিলাম। তার পরপরই পাহাড়ি ধস শুরু হয়।

বাসের সব যাত্রীর কাছে হুয়াং তখন ত্রাণকর্তা। একজন যাত্রী বলেন, 'যদি হুয়াং ওই মুহুর্তে গাড়িকে পেছনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত না-নিত, তবে আমরা সবাই পাথরের নীচে চাপা পড়তাম।' ওই বাসের যাত্রীদলে একটি বিদেশি তরুণ দম্পতি ছিল। তারা হুয়াং কুই ছুয়ানকে আলিঙ্গন করেন এবং পরে WeChatয়ে দুজন আবারও হুয়াকে জানান ধন্যবাদ। তারা লিখেছেন 'thank you. we are so lucky'

Armored car চালকের চেয়ে যাত্রীবাহী বাসের চালকের দায়িত্ব আরও বেশি বলে মনে করেন হুয়া কুই ছুয়ান। কয়েক ডজন লোকের নিরাপত্তা ও তাদের পরিবারের সুখ তখন তার হাতে থাকে। তা হুয়াং বলেন, যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চালকের মূল দায়িত্ব। দুর্ঘটনার সময় তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। তিনি এর জন্য এতো প্রশংসা আশা করেননি।

হুয়াং কুই ছুয়ানের স্ত্রী বলেন, তার স্বামী নিজের কাজ ভালবাসেন এবং এক মাসে দশ-বারো বার বাইরে কাজ করেন।

হুয়াং কুই ছুয়ানের সহকর্মী চৌ ফেংও তার মতো নিয়ামিত ছেংতু-কাং তিংয়ের মধ্যে আসা যাওয়া করেন। তিনি বলেন, ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রুট উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। ভোরে রওয়ানা হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়। আর ট্রাফিক জ্যাম থাকলে কখনও কখনও দশ-বারো ঘন্টাও লেগে যায়। চৌ ফেং আরও বলেন, হুয়াং তিন বছর ধরে এ রুটে গাড়ি চালিয়ে আসছেন। প্রতিবার রওয়ানা হবার আগে তিনি নিজে বাসের সব যন্ত্রপাতি চেক করেন। এটা এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

যাত্রীবাহী বাসের চালক হিসেবে প্রতি বছর হুয়াংকে প্রায় ৪০-৫০ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এমন দূরত্ব অতিক্রম করলে মোটামুটি পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসা যায়। ১৩ বছর ধরে তিনি নিরাপদে বাস চালিয়ে আসছেন এবং এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটাননি। তার বাসের যাত্রীরা একবারও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি বা করতে পারেননি। তিনি একাধিকবার শ্রেষ্ঠ গাড়িচালকও নির্বাচিত হয়েছেন।

এ ভিডিওচিত্রটি দেখার পর একজন এমন মন্তব্য করেন: প্রতিদিন সাধারণ কাজগুলো ভালভাবে করাও অসাধারণ একটা কাজ। সাধারণ কাজ সঠিকভাবে সময়মতো করতে চান এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—এমন মানুষই আমাদের বীর। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040