'প্রতিবন্ধীর বন্ধু' আশ্রয়কেন্দ্র
  2016-07-13 15:18:56  cri

লিউ ইউয়াং


সিন চিয়াং উইগুর স্বায়ত্বশাসিত এলাকার খা সি শহরের উপকণ্ঠের একটি পরিষ্কার ও শান্ত উঠান। এ উঠানটি উইগুর জাতির ঘরবাড়ির মধ্যেই অবস্থিত। তারা এই উঠানসমৃদ্ধ বাড়িটিকে ডাকে 'প্রতিবন্ধির বন্ধু' বলে।

জায়গাটা সুন্দর। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগবে সবার।এ বাড়ির মালিক হান জাতির একজন প্রতিবন্ধি, যার নাম লিউ ইউয়ং। তিনি খাসির প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য এই বাড়িতে গড়ে তুলেছেন একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র।

২০১১ সালে, লিউ ইউয়াং সেন চেং থেকে সিন চিয়াংয়ে আসেন। তখন তার শরীরের অংশ হয়ে আছে ২টি ইস্পাতের বার, ৩২টি ইস্পাতের তার এবং একটি স্প্রিং।এ জিনিষগুলো তাকে বহন করতে হয়। তবে দুর্বল এ শরীর নিয়েও লিউ ইউয়াং সিন চিয়াংয়ের প্রতিবন্ধীদের কিছু করতে চান। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা লিউ ইউয়ং এবং তার 'প্রতিবন্ধীর বন্ধু' প্রশিক্ষণকেন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত হব।

উঠানে প্রবেশ করেই দেখা গেল লাল কাপড় পরা একটি ইউগুর মেয়ে হুইলচেয়ারে বসে অন্য প্রতিবন্ধিদের গান শোনাচ্ছে। শ্রোতারাও গান শুনছে আর তুমুল করতালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করছে। এ মেয়ের নাম মা ই লা। ২৫ বছর বয়সি মা ই লা এখন খাসি প্রতিবন্ধী বন্ধু কোম্পানির প্রশাসনিক পরিচালক। তিনি কোম্পানির দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা এবং অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পালন করেন। গতমাসে তিনি খাসি শহরে অনুষ্ঠিত একটি গল্প বলা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং তার গল্পের শিরোনাম ছিল 'আমার দ্বিতীয় বাড়ি'।

তবে ৫ বছর আগে তার জীবন পুরোপুরি অন্য রকম ছিল।

তখনকার খাসিতে ছিল না 'প্রতিবন্ধীর বন্ধু'র মতো কোনো আশ্রয়কেন্দ্র; ছিল না মা ই লা ও তার প্রতিবন্ধী বন্ধুরা। তখন তার জীবন ছিল একঘেয়েমিপূর্ণ। তার দিন কাটতো একইভাবে, বৈচিত্র্যহীন। তখন তার কাছে জীবনের কোনো অর্থ ছিল না। তিনি ভাবতেন, এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।তিনি প্রথম পর্যায়ের তথা সবচেয়ে গুরুতর প্রতিবন্ধীতা পর্যায়ের একজন মানুষ। মা ইলা প্রায়ই ভাবতেন মৃত্যুই তার সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে পারে।

বিশেষ রোগের কারণে মাইলার শরীরের ত্বক এবং হাড় সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন। তিনি আয়নায় নিজের মুখ দেখতে চান না স্বাভাবিকভাবেই। রাতের বেলায়ই কেবল বাইরে বের হন। অন্য মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করেন না। একটি মেয়ের জন্য এর চেয়ে কঠিন অবস্থা আর হতে পারে না।

আসলে যারা 'প্রতিবন্ধীর বন্ধু' আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন, তাদের প্রায় সবার অবস্থাই মোটামুটি এরকমই। জীবনের প্রতি তাদের কোনো প্রত্যাশা নেই। তারা ভাবতেন, বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই এবং তারা কোনোদিন বিয়ে করে সংসার করতেও অক্ষম।

তবে লিউ ইউয়াং এভাবে ভাবেননি। তিনি প্রতিবন্ধী বন্ধুদের বার বার এ কথা বলেন, নিজকে ভাল না মনে করা একটা বড় মিথ্যা কথা এবং নিজের জীবনের কোনো অর্থ নেই মনে করা একটা বড় প্রতারণা। পাশাপাশি তিনি নিজে চাইলেন, প্রতিবন্ধী বন্ধু কোম্পানি ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত করে প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ করতে। তখন থেকে এ কাজ তিনি নিজের দায়িত্বের অংশ হিসেবে মনে করতে থাকেন।

 'প্রতিবন্ধীর বন্ধু' আশ্রয়কেন্দ্র

অন্য কোম্পানির চেয়ে ভিন্ন লিউ ইউয়ংয়ের কোম্পানি। তিনি চাকরির উপযুক্ত মানুষ নিয়োগ করেন না, বরং মানুষ নিয়োগ করার পর তাকে চাকরির উপযোগী করে তোলেন। যেমন, কেউ কেউ এখানে এসে কম্পিউটার প্রযুক্তি শিখেছেন এবং পরে তারা ইন্টারনেটসংক্রান্ত কাজ করছেন। কেউ কেউ তার কাছে এসে ছবি তোলা শিখেছে এবং পরে ভিডিও ও গ্রাফিকস্ ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। আবার কেউ কেউ হস্তশিল্প কলা শিখেছে, কোনো কোনো গুরুতর প্রতিবন্ধী কম্পিউটার বা ফোনের সামনে বসে গ্রাহকসেবা দিতে পারে।

মা ই লা হান ভাষা ভালভাবে বলতে পারেন দেখে লিউ ইউয়ং তাকে হান ভাষার চলচ্চিত্র দেখতে ও বই পড়তে উত্সাহ দেন। দ্রুত এ মেয়ে উইগুর বন্ধুদের অনুবাদক হিসেবে কাজ করার উপযোগী হয়ে ওঠেন এবং দু'ভাষায় বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করতে পারেন।

এভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার মাধ্যমে মা ই লা নিজের জীবনের অর্থ খুঁজে পান; খুঁজে পান আত্মবিশ্বাস। দু'বছর আগে তিনি বিয়েও করেন।

গত ৫ বছরে প্রতিবন্ধী বন্ধু কোম্পানি ১২০০ জনের বেশি প্রতিবন্ধীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং তাদের অধিকাংশই বর্তমানে সে প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।

কেন সিন চিয়াংয়ে আসলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে লিউ ইউয়ং বলেন, প্রতিবন্ধীদের উপকার করা যেন নিজেকে উপকার করা। তিনি নিজেও সমাজে নানান বৈষম্যের শিকার হয়েছেন; নানান কষ্ট পেয়েছেন। তিনি প্রতিবন্ধীদের অবস্থা বুঝতে পারেন এবং ভাবলেন সিন চিয়াংয়ের প্রতিবন্ধীদের তার সাহায্য বেশি প্রয়োজন।

১৯৭৪ সালে একটি সৈনিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লিউ ইউয়ং। যখন তার বয়স ৩ বছর, তখন একটি ভুগর্ভস্থ ভাণ্ডারে পড়ে গিয়ে তিনি মেরুদণ্ডে আঘাত পান। তখন থেকেই তার গ্রোথ থেমে যায়, তিনি আর লম্বা হননি। সারা জীবনের জন্য হুইলচেয়া তার সঙ্গি হয়ে যায়। তার মা তখন চাইতেন, তার একমাত্র ছেলেটি বেঁচে থাক। মা তার প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বাইরেও বের হতেন না।

মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর লিউ ইউয়ং ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন। তিনি একটি পত্রিকার দোকান খুলতে চেয়েছিলেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাকে সে অনুমতি দেয়নি। তাদের যুক্তি, একজন প্রতিবন্ধী রাস্তার পাশে বসে ব্যবসা করা মানে শহরের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়া। পরে সেন চেন প্রতিবন্ধী কমিটি লিউ ইুউয়ংকে একটি কোম্পানিতে কাজ খুঁজে দেয়। তবে মাত্র দু'মাস পর এ কোম্পানি দেউলিয়া হয়। লিউ ইউয়ং আবার বেকার হয়ে যান।

অবশেষে তার জীবনেও সুযোগ আসে। ইন্টারনেটযুগ তার ভাগ্য খুলে দেয়। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট লিউ ইউয়ংকে নতুন একটি জগত দেখায়। তিনি আবিষ্কার করেন, এ জগতে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা কোনো বাধা নয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তিনি অন্য একজন প্রতিবন্ধী চেং ওয়ে নিংয়ের সঙ্গে পরিচিত হন এবং দুজন একসাথে একটি ইন্টারনেট ক্যাফে খোলেন। পরে আরও বেশি প্রতিবন্ধীকে সঙ্গে নিয়ে ছুং হুয়া প্রতিবন্ধী সেবে ওয়েবসাইট গড়ে তোলেন। তারা আবিষ্কার করেন যে, ইন্টারনেট থেকে প্রতিবন্ধীরা আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। যারা কায়িক পরিশ্রম করতে পারেন না, তারাও ইন্টারনেটের মাধ্যমে টাকা আয় করতে পারেন। সেন চেনতে লিউ ইউয়ংয়ের কোম্পানি দিন দিন বড় হতে থাকে। ২০১০ সালে চীন সরকার সিনচিয়াং খাসিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এলাকা প্রতিষ্ঠার সিন্ধান্ত নেয়। তখন লিউ ইউয়ং সিন চিয়েং খাসিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

যাওয়ার আগে তার বন্ধু তাকে বলেন, 'তুমি খাসিতে ভ্রমণ করতে পার, তবে ওখানে কোম্পা্নি চালানো অনেক কঠিন। হান ও উইগুর জাতির সংস্কৃতি ও ভাষা ভিন্ন বলে উইগুর যুবক-যুবতীরা তোমার কোম্পানিতে কাজ করতে আগ্রহী হবে না।' তবে লিউ ইউয়ং এ কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি বলেন, 'আমাদের মধ্যে অন্তত তিনটি মিল আছে: আমরা সবাই প্রতিবন্ধী, সবাই চীনা নাগরিক এবং আমরা সবাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই।'

খাসিতে একটি নামতালিকা বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিবন্ধীদের খোঁজ নেওয়া শুরু করেন লিউ ইউয়ং; তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এক মাস পর ৬৮ জন প্রতিবন্ধী তার কোম্পানিতে আসেন এবং ৫ বছরে এ সংখ্যা ১২০০ জন ছাড়িয়ে যায়।

৫ বছরে প্রতিবন্ধী বন্ধু কোম্পানি খাসিতে মোট ৫২ লাখ ইউয়ান বিনিয়োগ করে। কোম্পানির সি ই ও ছেং ওয়ে নিং বলেন, 'সেন চেনে আমরা সফল। আমাদের আয় যথেষ্ট। এতে আরও বেশি মানুষকে সাহায্য করা আমাদের জন্য সহজ হচ্ছে।'

লিউ ইউয়ং সিন চিয়াংকে ভালবাসেন এবং তার ছোট মেয়েকে 'চিয়াং চিয়াং' 'ডাক নাম দেন। তার মেয়ে সিন চিয়াংয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা এখন একটি সুখী পরিবার। 'প্রতিবন্ধীর বন্ধু' আশ্রয়কেন্দ্র বা প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অন্যান্য বাসিন্দারা সে পরিবারেরই সদস্য।(শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040