ছিংহাই-তিব্বত রেলপথ: আকাশে স্থাপিত রেল
  2016-07-06 16:04:22  cri



মার্কিন পর্যটক পল থরু একবার বলেছিলেন, কুন লুন পর্বতমালা যতদিন থাকবে, ততদিন লাসা শহরে রেলপথ হবে না।

কিন্তু তার কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৬ সালের পয়লা জুলাই, ছিংহাই-তিব্বত রেলপথ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে এবং এটা রেলের ইতিহাসে একটি বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে মনে করা হয়। লোকেরা এ রেলপথকে 'থিয়ান লু' বা 'আকাশে স্থাপিত রেল' বলে ডেকে থাকে।

এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত সবচেয়ে লম্বা রেলপথ হিসেবে স্বীকৃত। চালু হবার পর দশ বছর পেরিয়ে গেছে। গত ১০ বছরে এ রেরপথের মাধ্যমে ছিংহাই-তিব্বত মালভূমির মানুষ নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা স্থানীয় বাসিন্দা ও এ রেলপথ সম্পর্কে নানা গল্প শুনবো।

থিয়ান লু'র আর্থিক গুরুত্ব

৫২ বছর বয়সি ওয়াং ফু হাই ১৬ বছর আগে ছিলেন একজন ট্রাকচালক। দেশের অন্যান্য স্থান থেকে ট্রাকে করে শাকসবজি ও ফল তিব্বতে নিয়ে আসা ছিল তার কাজ। ওয়াং ফু হাই বলেন, তখনকার তিব্বত ছিল যেন দূরবর্তী স্বর্গের মতো। ছিংহাই প্রদেশের রাজধানী সি নিং থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা যেতে সাধারণত কয়েকদিন লাগত। কখনও কখনও তুষারপাতের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত। তখন সময় লাগতো ১৫ দিনের মতো। এতে ট্রাকে রাখা শাকসবজি ও ফল নষ্ট হতো।

সে সময় তিব্বতে যাওয়া একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়ী রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখা যেত পরিত্যক্ত গাড়ি। ওয়াং ফু হাই বলেন, কোনো উপায় নেই। গাড়ি নষ্ট হলে হিটার কাজ করে না। শীতে জমে যাওয়া থেকে বাঁচতে চালক গাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যেতেন। কিন্তু এখন রেলপথ চালু হয়েছে; সি নিং থেকে লাসা যেতে এখন মাত্র একদিন লাগে এবং পরিবহনব্যয়ও অনেক কম হয়।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি মে মাস পর্যন্ত ছিংহাই-তিব্বত রেলপথ মোট সাড়ে ১১ কোটি যাত্রী ও ৪8.৮ কোটি টন মালামাল পরিবহন করে। তিব্বতের মালামাল পরিবহনের ৭৫ শতাংশ এ রেলের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। তা ছাড়া, ট্রাকের চেয়ে ট্রেনের পরিবহনক্ষমতা ৪০ গুণ বেশি।

গেল জুন মাসে চীনের বিখ্যাত ডেইরি কোম্পানি মেং নিউ লাসায় ২০ কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ করে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উচুতে অবস্থিত ডেইরি ফার্ম। এর আগেও অনেক কোম্পানি তিব্বতে বিনিয়োগ করেছে। এই একটি রেলপথ তিব্বতের অর্থনীতিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। ১০ বছরে তিব্বতের জিডিপি ২৪৯০ কোটি থেকে বেড়ে ১০,২৬০ কোটি ইউয়ান হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ১০ বা তারচেয়ে বেশি। ছিং হাই প্রদেশের জিডিপিও বেড়ে ৩ গুণ হয়েছে।

মানুষের সুখ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে থিয়ান লু'র গুরুত্ব

"সহপাঠির সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে বা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেইজিংয়ে পৌঁছাই। টিকিটের দামও বেশি না"—বললেন ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শির্খাথী মিমালামু। ২১ বছর বয়সি মিমালামুর জন্মস্থান তিব্বতের লিন চি শহরে। তার বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ার। বাবার চেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ, যখন তার বাবা সি'আন শহরে লেখাপড়া করতেন তখন তিব্বতে যাওয়ার রেলপথ ছিল না। তখন বিমানে গেলে অনেক টাকা লাগতো, আর বাসে গেলে বেশি লাগত সময়। তাই বাবা তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরে মাত্র একবার বাড়ি বেড়াতে যেতে পেরেছেন।

৫৬ বছর বয়সি তাচেনসিউচি ছিংহাই প্রদেশের হুয়াং ইউয়ান জেলার বাসিদা। সম্প্রতি তিনি ট্রেনযোগে সালার জোখাং মন্দির ও পোটালা প্রাসাদ পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, রেলপথ চালু হওয়ার আগে লাসা গিয়ে কয়েকদিন থাকতে হতো। এখন ট্রেনযোগে একদিন আর একরাতে পৌঁছানো যায়। তিনি নিজেকে ভাগ্যবান একজন মানুষ মনে করেন। তিনি বছরে অন্তত একবার ছিংহাই-তিব্বত ট্রেনে যাতায়াত করেন।

১০ বছর আগে, সিং হাই হু চু জেলার বাসিন্দা সি ইউয়ু সিউ রেল চালুর পর নিজের বাড়িতে গ্রাম-পর্যটন ব্যবসা শুরু করেন। এ থেকে তিনি অনেক আয়ও করছেন। প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে তিনি ৭০-৮০ হাজার ইউয়ান আয় করেন।

১০ বছরে ছিংহাই-তিব্বত রেলপথ দু'প্রদেশের পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে। এখানকার বহু কৃষক তাদের পেশা পরিবর্তন করে পর্যটনশিল্পকে বেছে নিয়েছে। ফলে তাদের আয় বেড়েছে, জীবনমানও বেড়েছে। এখন তারা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সুখী।

আধুনিক সমাজ গঠনে থিয়ান লু'র গুরুত্ব

তিব্বত না ছু জেলার চুও মা ছুও এখন লাসা শহরে একটি বার খুলে ব্যবসা করছেন।তিনি মাঝে মাঝে ট্রেনে ছেং তু বা বেইজিং শহরে যান। ওখান থাকে নিত্যনতুন ধারণা এনে নিজের বারে প্রয়োগ করেন। এ কারণে তার বার অভ্যতরীণ পর্যটক ও বিদেশি পর্যটকের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

চুও মা ছুও বলেন, লাসা শহরে ট্রেন চালু হবার পর বাইরে থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা লক্ষ্যনীয়ভাবে বেড়েছে।তার জন্মস্থান না চু জেলাও আগের চেয়ে সরগরম। স্থানীয় মেয়েরা পর্যটকদের কাছ থেকে নিত্যনতুন ফ্যাশন শিখছে। তার জেলার তিব্বতি মেয়েদেরও এখন শহরের মেয়েদের মতো লাগে।

১৩০০ বছর আগে, ওয়ে ছেং নামে একজন রাজকুমারী তখনকার রাজধানী সি আন থেকে ৩ বছরে লাসায় পৌঁছেছিলেন। এখন একটি রেলপথ হওয়ায় সেই দূরত্ব একদিনেই অতিক্রম করা যাচ্ছে। রেলপথের ফলে ছিংহাই ও তিব্বতের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ যেমন বেড়েছে, তেমনি বাকি বিশ্বের সাথে এই দুটি প্রদেশের যোগাযোগও বেড়েছে।

এখন বাইরে থেকে তিব্বতে সহজে প্রবেশ করা যায় এবং তিব্বতিরাও চীনের অন্য জায়গায় যেতে পারে সহজে। তাদের মনের দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে এবং যুব সমাজের ওপর এর প্রভাব পড়েছে অনেক বেশি। তারা আধুনিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। লাসা শহরে এখন চীনা অন্য বড় শহরের মতোই ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্ট, বার, ক্যাফে, ফিটনেস ক্লাব, থিয়েটার ইত্যাদি আছে। এ সবই এই রেলপথের অবদান।

এই রেলপথের মাধ্যমে এখন সহজে তিব্বতের ঐতিহ্যিক খাবার, ওষুধ, সূচিকর্ম ইত্যাদি বাইরের দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে।

স্বপ্নের থিয়ান লু

তিব্বত পরিবহন ম্যাপে নজর বুলালে আপনি দেখবেন, রেল, সড়কপথ ও বিমানপথ নিয়ে গড়ে উঠেছে অঞ্চলটির পরিবহনব্যবস্থা।

২০১৬ সালের দুটি অধিবেশনে, ১৩তম পাচঁশালা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর অন্যতম হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সি ছুয়ান- তিব্বত রেলপথকে। প্রস্তাবিত এ রেলপথ চালু হওয়ার পর সি ছুয়ানের রাজধানী ছেং তু থেকে লাসা যাওয়ার সময় ৪৮ ঘন্টা থেকে ১৩ ঘন্টায় কমে আসবে।

বর্তমানে, প্রতিদিন ৩০ বারের মতো ট্রেন আসা-যাওয়া করে ছিংহাই-তিব্বত রেলপথে। প্রতিদিন ৯ হাজার ১০০ যাত্রী তিব্বতে প্রবেশ করে বা তিব্বত থেকে বাইরে যায়। চীনের বিভিন্ন জায়গার খাদ্য, বিল্ডিং উপকরণ, তেল, পণ্যসহ নানা মালামাল তিব্বতে আসে এবং হাজার টন তিব্বতি ঐতিহ্যিক পণ্যও দেশের নানা জায়াগায় পাঠানো হয়। এভাবেই একটা রেলপথ তিব্বতিদের স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040