20160607yinyue.mp3
|
চীনা অপেরার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। চীনের হান, থাং, সোং আর কিন এ কয়েক রাজবংশ অতিক্রম করে অবশেষে অপেক্ষাকৃত সম্পূর্ণ রূপের অপেরা শিল্প গঠিত হয়েছে। অপেরার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, শিল্পকলা, মার্শাল আর্ট, দড়াবাজি এবং অভিনয় প্রভৃতি। চীনে ৩৬০টিরও বেশি ধরণের অপেরা আছে। এগুলোর মধ্যে পিকিং অপেরা, হোনান প্রদেশে প্রচলিত ইয়ু অপেরা এবং চেনচিয়াং প্রদেশে প্রচলিত ইউয়ে অপেরা চীনের স্থানীয় অপেরাগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে। তা ছাড়া আরো আছে খুনছুন, কুয়াংতোং প্রদেশে প্রচলিত ইউয়ে অপেরা, সিছুয়ান প্রদেশে প্রচলিত ছুয়ান অপেরা, শেনশি, শানশি ও কানসু প্রদেশে প্রচলিত ছিন ছিয়াং, আন হুই, হু পেই ও চিয়াং শি প্রদেশে প্রচলিত হুয়াং মেই অপেরাসহ আরো অনেক অপেরা।
শ্রোতাবন্ধুরা, এবার শুনুন চীনের কণ্ঠশিল্পী গোং লিন নার কণ্ঠে 'মিক্স অপেরা'। তিনি এ গানের মধ্যে ইউয়ে অপেরা 'আকাশ থেকে পড়েছে লিন নামে ছোট বোন', হুয়াং মেই অপেরা 'পরীর সঙ্গে প্রেম', হোনানের ইয়ু অপেরা 'কে বলে, নারী পুরুষের মতো সামর্থ্য নয়' এবং পিকিং অপেরা 'চেন শি মেই মামলা' এর অংশ বিশেষ ব্যবহার করেছেন। আপনারা অপেরার কথাগুলো বুঝতে না পারলেও শিল্পীর কণ্ঠ ও অভিনয় থেকে ভিন্ন অপেরার ভাব খুঁজে পাবেন।
চীনে নানা স্থানীয় অপেরা আছে। অবশ্য অপেরার অনুরাগীও কম নয়। তারা কেবল টেলিভিশন, থিয়েটার বা ডিস্কের মাধ্যমে অপেরা শোনেন তা নয়, বরং অনেকে নিজেও অপেরায় অভিনয় করেন। বেইজিংয়ের পার্কে গেলে আপনি দেখবেন, পার্কের অনেক কোণায় লোকেরা নানা আকারের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে বসে বাজান। সেখানে আপনি পিকিং অপেরা, খুনছু, পিং অপেরাসহ নানা অপেরা শুনতে পাবেন। হয়তো তারা কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মঞ্চে গিয়ে অভিনয় করার সুযোগ পাবেন না, তবে পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে অপেরা অভিনয় করেও যথেষ্ঠ মজা পান।
প্রিয় বন্ধুরা, এবার শুনুন লি চিয়ানের কণ্ঠে 'অপেরা অনুরাগীদের জীবন' নামে একটি গান। এ গানের কথা লিখেছেন জো ইয়ো, সুর করেছেন লি চিয়ান। তিনি গেয়েছেন, 'সুর বাজিয়ে পর্দা খুলেছে। আমি নাটকের চরিত্র হয়ে মঞ্চে উঠেছি। মঞ্চে আমি পৃথিবীর প্রেম ও ঘৃণা অভিনয় করি। নাটক এবং আমার জীবন ভাগ করা যায় না। আমি নাটকে আছি, তুমি স্বপ্নে আছো। আমি আর আমি নয়। তুমিও তুমি নয়। হাসি, কাঁন্না, সবই স্বপ্ন।'
চীনের ছিং রাজবংশের আমলে স্থানীয় অপেরার ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে পিকিং অপেরা। ছিং রাজবংশের সম্রাট থোংচি এবং কুয়াং শুই আমলে পিকিং অপেরার প্রথম প্রজন্মের বিখ্যাত সব শিল্পী এবং অভিনয়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিভিন্ন শাখার সৃষ্টি হয়। সে সময় থেকে পিকিং অপেরা সারা চীনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শাংহাই, থিয়েনচিনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে এ অপেরার। এখন পিকিং অপেরা চীনের জাতীয় অপেরার মর্যাদা পেয়েছে।
বন্ধুরা, এখন শুনুন গায়ক সুন নানের কণ্ঠে 'বুদ্ধি করে ওয়েই হু পাহাড় দখল' নামের গানটি। এ গান আধুনিক পিকিং অপেরার একটি অংশ। সুন নান পিকিং অপেরার অভিনেতা নন, তিনি একজন পপ সংগীত গায়ক। চীনের টেলিভিশন কেন্দ্রের মধ্য-শরত্ উত্সবে এ পিকিং অপেরা নতুন করে সংযোজন করে গেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আধুনিক পিকিং অপেরার ভাব রয়েছে। তিনি এর সঙ্গে যোগ করেছেন রক সংগীতের ভাব। শুনুন, কেমন লাগে?
চীনের অপেরা, গ্রিসের কমেডি-ট্র্যাজেডি এবং ভারতের সংস্কৃত নাটক হলো বিশ্বের তিনটি প্রাচীন নাটক সংস্কৃতি। অপেরা একটি সার্বিক শিল্প। অপেরার সার্বিকতা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের অপেরা সংস্কৃতির অধিকারী অভিন্ন বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় অপেরার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অপেরার ভাষা ভিন্ন, অভিনেতাদের পোশাক ভিন্ন, অপেরার মূল সুর ও গাওয়ার কৌশলও ভিন্ন।
সুপ্রিয় বন্ধুরা, এবার শুনুন 'সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে' নামে একটি গান। এ গানটি তাইওয়ানের স্থানীয় অপেরা থেকে রূপান্তরিত হয়েছে। এ গানের বিষয়, শুয়ে পিং কুই এবং ওয়াং পাও ছুয়ানের কাহিনী। গানের কথা স্থানীয় অপেরার পুরোনো কথা। তবে বর্তমান যুগের সহজ কথা দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শুয়ে পিং কুই সাধারণ পরিবারের একজন ছেলে। ওয়াং পাও ছুয়ান এক মন্ত্রীর মেয়ে। কোনো এক সুযোগে এ দু'জনের বিয়ে হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শুয়ে পিং কুই সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। অনেকে মনে করে, শুয়ে পিং কুই যুদ্ধের ময়দানে মারা গেছে। আসলে তিনি কিছু বিপদ অতিক্রম করে অন্য দেশের রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে করেছেন এবং সে দেশের রাজা হয়েছেন। তার স্ত্রী বহু বছর ধরে নিজ বাসায় স্বামীর অপেক্ষায় ছিলেন। পরে যখন তিনি জানতে পারেন তার স্বামী মারা যান নি। তখন স্বামীকে খুঁজে বের করতে অনেক দূর থেকে ভিক্ষা করতে করতে সে রাজ্যে চলে এসেছেন। এটি এ গানের বিষয়। শুনুন তাহলে।
অপেরা হচ্ছে চীনের হান জাতির ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার অন্যতম আবিস্কার। অপেরায় অভিনয়ের চারটি মূল বিষয় হলো গান গাওয়া, কথা বলা, অভিনয় করা এবং লড়াই করা। পিকিং অপেরার মধ্যে শেং, তান, চিং ও ছো এ চারটি মূল চরিত্র আছে। পিকিং অপেরায় মুখের মেকআপ ভিন্ন ধরনের। পুরুষের মুখের রং দেখে বুঝা যায়, তার চরিত্র ভালো নাকি মন্দ।
রাজা সিয়াং ইয়ু আর তার উপপত্নি
শ্রোতাবন্ধুরা, এবার শুনুন 'বা ওয়াং বিয়ে জি' অর্থাত্ 'রাজা সিয়াং ইয়ুয়ের তার উপপত্নির সঙ্গে বিদায়' নামের গানটি। এ নামে একটি ঐতিহ্যবাহী পিকিং অপেরা ছিল। ১৯৯৬ সালে গায়ক থু হোং কাং এ অপেরার কাহিনী থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে এ গান রচনা করেন। রাজা সিয়াং ইয়ু যুদ্ধ হেরে গেলে বাধ্য হয়ে যুদ্ধের ময়দানে প্রিয় উপস্ত্রীকে বিদায় দেওয়ার সময় তার মনের বেদনা প্রকাশিত হয়েছে এ গানে।
প্রাচীনকালে চীনে কোনো মেয়ে অপেরায় অভিনয় করতেন না। অপেরায় সব চরিত্রে পুরুষরা অভিনয় করতেন। যেমন পিকিং অপেরার চারজন সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেতা মেই লান ফাং, চেং ইয়ান ছিউ, শাং সিয়াও ইয়ুন এবং শুন হুই শেং। তারা সবই নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। নারী চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। তারা পিকিং অপেরার নারী অভিনয়ের চারটি বিখ্যাত শাখার প্রতিষ্ঠাতা। তাদের অভিনয় দর্শকদের কাছে গভীর ছাপ ফেলেছে।
এখন চীনে লি ইয়ু কাং নামে একজন গায়ক, তিনিও পুরুষ ও নারী উভয় চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। এমন কি তিনি পুরুষ ও নারীর কণ্ঠে গান গাইতে পারেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিনি 'নতুন মাতালের উপপত্নি' অ্যালবাম প্রকাশ করেন। 'মাতালের উপপত্নি' ছিল মেই লান ফাংয়ের বিখ্যাত পিকিং অপেরা। অপেরায় থাং রাজবংশের সম্রাট থাং শুয়েন চোংয়ের সবচেয়ে প্রিয় উপপত্নি ইয়াং ইয়ু হুয়ান ফুল বাগানে মদ খেতে খেতে মাতাল হয়ে মনের কথা বলার দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এ অপেরার ভিত্তিতে 'নতুন মাতালের উপপত্নি' গানটি রচিত হয়েছে। এ গান লি ইয়ু কাংয়ের প্রতিনিধিত্বশীল একটি কাজে পরিণত হয়েছে। বন্ধুরা, গানটি শুনুন।
লি ইয়ু কাং
বন্ধুরা, এতোক্ষণ আপনারা শুনলেন লি ইয়ু কাংয়ের গাওয়া 'নতুন মাতালের উপপত্নি' নামে গান। তিনি পুরুষ ও নারী দুই রকম কণ্ঠে গান গেয়েছেন। এটা পিকিং অপেরার বিশেষ কৌশল বলা যায়। পিকিং অপেরার আরেক ঐতিহ্য আছে, তা হলো অভিনেত্রী পুরুষ চরিত্র অভিনয় করেন। তারা পুরুষের পোশাক পড়েন এবং মুখে দাড়ি লাগায়, তারা পুরুষের মতো মোটা কণ্ঠে অপেরা অভিনয় করেন।
প্রিয় বন্ধুরা, এ পর্বের সুর ও বাণী আসরে আপনাদের চীনের অপেরার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছি। পাঁচ হাজার বছর ইতিহাসের চীনে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। আমি ধাপে ধাপে আপনাদের পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করবো। আশা করি, গান শোনার পাশাপাশি আপনারা চীনের সংস্কৃতির নানা তথ্যও জানতে পারবেন।
বন্ধুরা, সুর ও বাণী আজকের মতো এখানে শেষ করছি। ভালো থাকুন সবাই, আবার কথা হবে। (ইয়ু/মান্না)