কমলা ভট্টাচার্য : পৃথিবীর এক মাত্র নারী ভাষা শহীদ
  2016-05-22 14:32:35  cri

১৯ মে। ১৯৬১ সালের এই দিনে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরের এগারো জন বাঙালি মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য তথা বাংলায় কথা বলার জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ উত্সর্গ করেছিলেন। ১৯৫২ সালে বাংলাদেশে অর্থাত তত্কালীন পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এবং প্রাণ উত্সর্গ করেছিলেন সালাম, রফিক, সফিক, বরকত ও জব্বার। সেই ভাষা আন্দোলনের নয় বছর পর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন আরো একটি আন্দোলন হয়েছিল এবং সে আন্দোলনে একজন নারীসহ এগারোজন বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে প্রাণ উত্সর্গ করেছিলেন আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে, সে কথা আমাদের অনেকের এখনো হয়তো অজানা রয়ে গেছে। পৃথিবীতে একই ভাষার জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্রে এবং আলাদা সময়ে প্রাণ দেয়ার অনন্য ইতিহাস এটি।

১৯৬১ সালে ভারতের আসাম প্রাদেশিক সরকার বরাক উপত্যকার (বরাক ভ্যালি) কাছাড় জেলার বাঙালি অধ্যুষিত শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির বাংলাভাষাভাষীদের প্রাণের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণা দিলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালিরা এবং পরে তা আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৬১ সালের ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা ধর্মঘটের সময় শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে রেলপথ অবরোধের সময় আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ন বাংলাভাষা আন্দোলন কারীদের প্রতি নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে এবং ১১ জন ভাষাসৈনিক ঘটানাস্থলে শহীদ হন এবং আহত হন অর্ধশতাধিক।

প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেন শিলচর শহরে। রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় শিলচর রেলওয়ে স্টেশন ও আশেপাশের এলাকা এবং শোকে স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে যান বরাক উপত্যকার বাঙালিরা। সমগ্র বরাক উপত্যকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। ২০ মে শোকার্ত আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে শহীদদের লাশ নিয়ে শিলচর শহরে স্মরণকালের বৃহত্তম শোকমিছিল বের করে। মায়ের ভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১১ জন শহীদ হন, তারা হলেন- কমলা ভট্টাচার্য (পৃথিবীর এক মাত্র নারী ভাষা শহীদ), শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডিচরন সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, তারিণী দেবনাথ, সুনীল সরকার এবং সুকুমার পুরকায়স্থ। আসাম রাজ্য সরকার আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়।

কমলা ভট্টাচার্যর জন্ম ১৯৪৫ সালে, আসামের শ্রীহট্টে। রামরমণ ভট্টাচার্য ও সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের মধ্যা পঞ্চম কমলা। কমলারা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন। চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবেই তার বাবা মারা যান।

বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটতে থাকে কমলাদের পরিবারের। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে আসামের শ্রীহট্ট জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। কমলারা পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সার্বিক গণহত্যা আরম্ভ হলে তার রেশ শ্রীহট্টেও এসে পড়ে। কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে আসামে চলে আসতে বাধ্য হন। তারা শ্রীহট্টের পার্শ্ববর্তী আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নেন। শিলচরে কমলারা থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে। কমলার বড় দিদি বেণু নার্সের চাকরি পেয়ে শিমূলগুড়ি চলে যান প্রশিক্ষণ নিতে। কমলার মেজ দিদি প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। কমলার পরিবার তার মেজদিদির আয়ের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল।

শৈশবে কমলা ভর্তি হন শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইন্‌ষ্টিটিউটে। কিন্তু স্কুলের বই কেনার ক্ষমতা ছিল না কমলার। কমলা একবার বড়দিদি বেণুকে একটি অভিধান কিনে দিতে বললে তিনি সেটা কিনে দিতে পারেননি। কমলা তার সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার করে তার বিষয়বস্তু খাতায় টুকে নিতেন। ১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরিক্ষায় বসেন। তার ইচ্ছা ছিল পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি স্নাতকস্তর পর্যন্ত পড়বেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে তিনি টাইপরাইটিং শিখবেন বলে মনস্থির করেন।

মৃত্যু : ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরের দিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবীতে একটি পিকেটিংএর ডাক দেওয়া হয়। সেদিন সকালে, অর্থাত ১৯ মে সকালে কমলাও পিকেটিং-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সকালে স্নান করে মেজদিদির রাখা শাড়ীটা পড়ে নেন কমলা। মেজদিদি পিকেটিং-এ যেতে বারণ করলেও শোনেন না কমলা। এমন সময় ২০-২২ জনের একটি মেয়েদের দল কমলাদের বাড়িতে আসে কমলাকে নেওয়ার জন্য। কমলার মা উদ্বেগ প্রকাশ করলে তারা কমলার মাকে বুঝিয়ে রাজি করেন। কমলার মা কমলাকে এক টুকরো কাপড় দেন কাঁদানে গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কমলার সাথে বেড়িয়ে পড়ে কমলার ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল ও বড়দির ছেলে বাপ্পা।

দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই গিয়ে উপস্থিত হন রেল স্টেশনে। বকুল ও বাপ্পাকে একবার পুলিশ ধরেছিল আবার ছেড়েও দিয়েছে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসেন কমলা। মায়ের ধূলিধূসরিত পা ধুয়ে দিয়ে, শরবত খেতে দেন। মায়ের সমস্ত দুশ্চিন্তা নিবারণ করে মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধা হয়। যদিও অবস্থানের সময়সূচি ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। কিন্তু শেষ ট্রেনটি ছিল বিকেল ৪টা নাগাদ। যার পড়ে গণ অবস্থান স্বভাবতই শিথিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই আসাম রাইফেল্‌সের জওয়ানরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বেলা ২-৩৫ নাগাদ বিনা প্ররোচনায় তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পেটাতে থাকে। এলোপাথারি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিকবিদিকজ্ঞানশুন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যায়। ও সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিত্কার করতে থাকে। ইতমধ্যে আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা পলায়নরত জনতার উপর গুলিবৃষ্টি শুরু করে। মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে গেলে একটি গুলি তার চোখ ভেদ করে মাথা চুরমার করে দেয়। অন্যন্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখনেই তার মৃত্যু হয়। মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাস বাদে তার জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান।

২০১১ সালে ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদ কমলা ভট্টাচার্য মূর্তি স্থাপন কমিটির পক্ষ থেকে গোপা দত্ত আইচ ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে কমলার একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন।

(মান্না)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040