মা দিবস
  2016-05-16 14:08:11  cri

গত ৯ মে রোববার ছিলো বিশ্ব মা দিবস। বিশ্বের সকল জীবিত ও মৃত মায়ের জন্য রইলো নারীকণ্ঠের পক্ষ থেকে হৃদয় উজার করা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

'মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে/মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে/...সেই যে আমার মা/ বিশ্বভুবন মাঝে যে তার নেইকো তুলনা/...প্রদীপ হয়ে মোর শিয়রে কে জেগে রয় দুঃখের রাতে/সেই যে আমার মা.../বিশ্বভুবন মাঝে যে তার নেইকো তুলনা...'।

হ্যাঁ বন্ধুরা, 'মা' সে তো অনন্ত বিশ্বস্ততার জায়গা। মার কোনো তুলনা হয় না। মার তুলনা 'মা' নিজেই। পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দ 'মা'। সবচেয়ে ভালোবাসার শব্দ 'মা'। বড় আশ্রয়ের জায়গা 'মা'। তার স্নেহধারায় স্নাত হয়ে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যায় সন্তান। মায়ের আশীর্বাদই সন্তানকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করে। মা শাশ্বত, চিরন্তন। মায়ের প্রতি সম্মান দেখাতেই প্রতি বছর মে মাসের প্রথম রোববার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা আয়োজনে পালিত হয় 'মা দিবস'। বাংলাদেশেও ঘরে ঘরে নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হয়। বাঙালি সন্তানদের হৃদয়ে দিবসটি এখন যেন উতসবে পরিণত হয়েছে। হাজার কষ্ট করে তিলে তিলে যে সন্তানকে বড় করে তুলেছেন একজন মা তাকে ঘিরেই চলে ব্যতিক্রমী উতসব উদযাপন। এ দিন একটি ফুল অথবা একটি কার্ড নিয়ে শুভেচ্ছা জানালে মা যেন তাতেই খুশি। মার চাহিদা তো এতটুকুই…!

সুপ্রিয় শ্রোতা, মা দিবসের ইতিহাস, আন্তর্জাতিকতা এবং এ দিনটির নানা দিক নিয়ে আজ আমরা কথা বলবো।

উত্কৃষ্ট প্রস্তাব। তাহলে চলো আমরা 'মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে/মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে/...এ গানটি শুনি।

প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা মাকে নিয়ে গাওয়া জগত বিখ্যাত ও হৃদয়গ্রাহী গানটি শুনলেন।

সভ্যতার প্রথম পর্যায় থেকেই 'মা'কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আঙ্গিকে নানা উতসবমুখর অনুষ্ঠান উদযাপন করা হচ্ছে। মা দিবসের আদি উতপত্তি প্রাচীন গ্রিসে। আদি পর্বে গ্রিক সভ্যতায় ধর্মীয় উতসব হিসেবে প্রতি বসন্তে 'মাদার অব গড' রিয়ার উদ্দেশে বিশেষ একটি দিন উদযাপন করা হতো। তবে ধর্মীয় উত্সব থেকে বেরিয়ে এসে মা দিবস সামাজিক উত্সবে পরিণত হয় ১৬শ' শতাব্দীতে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে মায়েদের প্রতি সম্মান জানিয়ে 'মাদারিং সানডে' নামে একটি বিশেষ দিন উদযাপন করা হতো। প্রথম দিকে দিবসটি শুধু শহুরে বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরে সাধারণ মানুষ;বিশেষত কাজের সন্ধানে শহরে ছুটে আসা মানুষের কাছেও পরিচিত হয়ে ওঠে মা দিবস। ফলে এ বিশেষ দিবসের আবেদন ছড়িয়ে পড়ে শহর ছেড়ে গ্রামে, সব জায়গায়।

এক সময় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মা দিবসকে আরও সার্বজনীন করে তোলেন আমেরিকারই নাগরিক জুলিয়া ওয়ার্ড। দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার জন্যে ১৮৭২ সাল থেকে তিনি ব্যাপক লেখালেখি শুরু করেন।

তবে দিবসটিকে জাতীয় উত্সবে পরিণত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন ফিলাডেলফিয়ার অপর নারী অ্যানা জার্ভিস। ১৯০৭ সালে মা দিবসকে স্বীকৃতি দিতে ব্যাপক প্রচার চালান তিনি। সে বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ছিল অ্যানার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। অ্যানা সেই দিবসটিতেই 'মা দিবস' পালন করেন। পরের বছর পুরো ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যেই বিশাল আয়োজনে ঐ একই দিনে পালিত হয় 'মা দিবস'। এক পর্যায়ে অ্যানা ও তার সমর্থকরা 'জাতীয় মা দিবস' ঘোষণা করার জন্য দেশের মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের চিঠি লিখতে শুরু করেন।

অবশেষে ১৯১১ সালে অ্যানা জার্ভিস সফলতা লাভ করেন। সে বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার আমেরিকাজুড়ে একই সঙ্গে পালিত হয় 'মা দিবস'। পরে ১৯১৪ সালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন দিবসটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেন। এরপর থেকেই বিশ্বের দেশে দেশে মা দিবস পালনের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে।

আমেরিকাকে অনুসরণ করে গত প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশেও প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার নানা আয়োজনে মা দিবস পালন করা হয়।

বাংলাদেশে এই বিশেষ দিনে মাকে শুভেচ্ছা জানানো এখন একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। দিবসটিকে সামনে রেখেই শাড়ি, কার্ড, ফুলসহ বিভিন্ন গিফটের দোকানে ভিড় জমায় সবাই। মাকে এই দিবসে শ্রেষ্ঠ উপহারটি দেওয়া নিয়ে চলে নানা জল্পনা-কল্পনা। সব বয়সীরাই এই দিনটিতে তার মাকে একটি সুন্দর উপহার কিংবা একটু সঙ্গ দেয়ার জন্য আগে থেকেই নানা পরিকল্পনা করে থাকে। মাকে ঘিরে চলে খাওয়া-দাওয়াসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পূর্বপ্রস্তুতি। খাবারের দোকানগুলো এই বিশেষ দিবসে ভরে ওঠে মা ও সন্তানের আগমনে।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দিনে মা দিবস পালিত হয়। প্রাথমিকভাবে বলা যায়, মাদারিং সানডে-এর ব্রিটিশ প্রথা অনুযায়ী লেন্ট-এর চতুর্থ রোববার এবং মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস পালন করা হয় সাধারণত।

যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছুটির দিনটিকেই অনান্য দেশ এবং সংস্কৃতি গ্রহণ করে সেহেতু যুক্তরাজ্যে মাদারিং সানডে বা গ্রিসের মন্দিরে যিশুর প্রাচীনপন্থী পুজা-অর্চনার মত মাতৃত্বের সম্মানে পালন করা অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার জন্যই মূলত তারিখটিকে সুবিধামত পাল্টে নেওয়া হয়।

ক্যাথলিক দেশগুলোতে ভার্জিন মেরি ডে বা মুসলিম দেশগুলোতে নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর কন্যা বিবি ফাতেমার (রা:) জন্মদিনের মত। কিছু দেশে সেখানকার প্রধান ধর্ম অনুযায়ী তারিখটি পাল্টে দেওয়া হয়। বহু দেশে একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিনকে মা দিবস হিসেবে বেছে নেয়া হয়। যেমন বলিভিয়া যে তারিখটি ব্যবহার করে একসময় ওই তারিখে ওখানকার নারীরা একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আসলে বিশেষ কোনো দিন নয়, জীবনের প্রতিটি দিনই মার জন্য।

চীনের মা দিবস ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কার্নেশন বা গোলাপ ফুল সেখানে জনপ্রিয়তম উপহার এবং সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ফুল। ১৯৯৭ সালে দরিদ্র মায়েদের সাহায্য করার জন্য, বিশেষ করে পশ্চিম চীনের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মায়েদের কথা মানুষকে মনে করানোর জন্য, এই দিনটি চালু করা হয়।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র, পিপিল'স ডেইলি'র একটি নিবন্ধে এ বিষয়ে লেখা হয়, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হলেও, চীনের মানুষ বিনা দ্বিধায় এই দিনটিকে গ্রহণ করেছেন। কারণ এটি একদমই এই দেশের রীতি মাফিক - মানে গুরুজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা'।

সাম্প্রতিককালে মেং জি-র মা, মেং মুয়ের স্মৃতিতে মা দিবসের সরকারি অনুমোদনের সমর্থনে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লি হাংকি প্রচার করতে শুরু করেন এবং ১০০ জন কনফুসীয় পন্ডিত ও নীতিশাস্ত্রের অধ্যাপকদের নিয়ে চাইনিজ মাদারস' ফেস্টিভাল প্রমোশন সোসাইটি নামে একটি বেসরকারি সংগঠন তৈরি করেন। তারা বলেন, পাশ্চাত্যের কার্নেসানের (গোলাপ ফুল) বদলে দেওয়া হোক লিলি ফুল যা সন্তানরা বাড়ির বাইরে গেলে, প্রাচীন কালে চীন দেশের মায়েরা রোপন করতেন। চীনের কয়েকটি শহরে বেসরকারি অনুষ্ঠান হিসাবেই পালিত হয় মা দিবস।

বিভিন্ন তথ্য জেনে আমরা সমৃদ্ধ হলাম। এবার মা বিষয়ক একটি কবিতা হলে কেমন হয়। মান্না, তুমি তোমার লেখা একটি কবিতা আমাদের শোনাও। শ্রোতা, এখন মান্নার লেখা একটি মা বিষয়ক কবিতা শুনবো আমরা।

হারিয়ে যাওয়া মাকে/আইরীন নিয়াজী মান্না

মাগো তুমি শুনতে কি পাও!

আমি কড়া নাড়ি তোমার দরজায়।

সফেদ সাদা বিছানা পরে আছে শূন্য;

বাতাসে পাতা ঝরার শব্দ,

কানে বাজে সেই চির চেনা কণ্ঠস্বর,

বিলম্বিত হয় স্বপ্নধারা-

মুক্ত আকাশে তাকিয়ে মেঘদের

খেলা দেখি;

হৃদয়ের আহাজারি মিশে যায়

বিশ্বব্রহ্মান্ডে।

মাগো তুমি শুনতে কি পাও

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, তৃষ্ণার্ত আকুতি-

একটু ছুঁতে পারার; একবার শেষ

দৃষ্টি বিনিময়ের আক্ষেপ!

অতৃপ্ত আত্নার অন্তহীন কান্নার রোল

তুমি কি শুনতে পাও না মা?

বিষন্ন বিষাদে বিদির্ণ চিতকার তোমার

স্তব্দতাকে নাড়া দেয় না কেন?

এতটা অবিচল তুমি কি করে হলে!

বিস্ময় জাগানিয়া স্বপ্নরা পথ

চেনায় আমায়।

ভুল পথে ছুটে চলি আমি,

অনন্তহীনতার পথে।

তুমি কি দেখ না যন্ত্রনাদগ্ধ মুখখানা আমার!(মান্না)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040