শিশুচিকিত্সক সংকট
  2016-04-14 08:50:42  cri


প্রতি ১ হাজার শিশুর জন্য মাত্র ০.৫৩ জন শিশুচিকিত্সক। প্রতিজন শিশুচিকিত্সককে প্রতিদিন অন্তত ১৭টি শিশুকে চিকিত্সাসেবা দিতে হয়। শিশুচিকিত্সকের অভাবের কারণে কিছু হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে কেবল গুরুতর রোগীদেরই চিকিত্সা দেওয়া হয়। এটি চীনের একটি সাধারণ চিত্র। শিশুচিকিত্সক সংকট দেশের মানুষকে বেশ ভোগাচ্ছে বলা চলে।

 চিয়াং সি শিশু হাসপাতাল চীনের এ-প্রদেশটির একমাত্র সর্বোচ্চ রেটিংধারী শিশু হাসপাতাল। এ হাসপাতালের রেসপিরেটরি বিভাগ সবচেয়ে ব্যস্ত একটি বিভাগ। প্রদেশের অন্য কোনো হাসপাতালের কোনো বিভাগ এত ব্যস্ত নয়। চিয়াং সি শিশু হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৫৬। অথচ এটি একবারে ১২০ রোগীকে ভর্তি করায়। এর অর্থ হাসপাতালের করিডোরে অতিরিক্ত শয্যা পাততে হয়। বসন্ত উত্সবের সময় রেসপিরেটরি বিভাগের প্রধান লি লান ১০০টি শিশুকে চিকিত্সাসেবা দেন এবং ৭০টির বেশি শিশুকে ভর্তি করে নেন।

প্রদেশের জেলা হাসপাতালে শিশুবিভাগ নেই; শহরের অন্যান্য হাসপাতালেও শিশুদের জন্য আলাদা শয্যা নেই। অন্যদিকে বড় বড় হাসপাতালগুলোতে শিশুদের জন্য চিকিত্সাসেবা পেতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। পিতামাতা বা অভিভাবকদের জন্য এ এক কষ্টকর অভিজ্ঞতা।

নান ছাং শহরের বাসিন্দা তেং তুং সিয়াং। তিনি তার শিশুকন্যাকে নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে দেন হাসপাতালের করিডোরে স্থাপিত অতিরিক্ত শয্যায়। তিনি বলেন, করিডোরে অতিরিক্ত শয্যার ভীড়ে হাঁটাও মুশকিল। কিন্তু কোনো উপায়ও নেই। গোটা প্রদেশে এই একটি মাত্র শিশু হাসপাতাল। আর অন্য হাসপাতালে শিশুকন্যার ঠিক চিকিত্সা হবে কি না, এই নিয়ে সন্দিহান ছিলেন তিনি।

জাতীয় গণ কংগ্রেসে চিয়াং সি প্রদেশের প্রতিনিধি এবং শিশু হাসপাতাল পরিচর্যা বিভাগের উপ-পরিচালক হু মেই ইং বিগত কয়েক বছর ধরে চীনের 'দুই অধিবেশনে' দেশে আরও শিশু হাসপাতাল নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছেন। তিনি বলেন, শয্যা সংকটের পাশাপাশি হাসপাতালগুলোর শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের অভাবও প্রকট। যে হারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সে হারে চিকিত্সকের সংখ্যা বাড়ছে না। 

চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশনের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে বিশেষ শিশু হাসপাতাল আছে ৯৯টি এবং মোট ৩৫,৯৫০টি হাসপাতাল ও চিকিত্সাকেন্দ্র শিশুবিভাগ আছে। তা ছাড়া, চীনে নিবন্ধিত শিশুচিকিত্সক আছেন মাত্র ১ লাখ ১৮ হাজার। অথাৎ ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য প্রতি ১০০ জনে আছে মাত্র ০.৫৩ জন শিশুচিকিত্সক, যুক্তরাষ্ট্রে যে সংখ্যা ১.৪৬।

চিকিত্সকের অভাব সমাজে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের বিভিন্ন হাসপাতালের শিশুচিকিত্সা বিভাগগুলোকে প্রতি বছর ৪৭ কোটি ১০ লাখ রোগীকে চিকিত্সাসেবা দিতে হয়। অন্যভাবে বললে, চীনে রোগীদের ৯.৮৪ শতাংশই শিশু। প্রতিজন নিবন্ধিত শিশুচিকিত্সক প্রতিদিন গড়ে ১৭ জনকে চিকিত্সাসেবা দিয়ে থাকেন। অন্য কোনো বিভাগের চিকিত্সকদের দিনে গড়ে এত বেশি রোগী দেখতে হয় না।

হু মেই ইং জানান, আসলে নিবন্ধিত শিশুচিকিত্সকের সংখ্যা আরও কম। কারণ, ইতোমধ্যেই কোনো কোনো চিকিত্সক অন্য বিভাগে স্থানান্তরিত হয়েছেন বা অবসর গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে চীনে 'দুই সন্তান নীতি' গৃহীত হবার পর শিশুচিকিত্সক সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। অনেকেই এখন দ্বিতীয় সন্তান নিচ্ছেন এবং শিশুদের সংখ্যা তাই বাড়ছে। চিয়াং সি শিশু হাসপাতালে চিকিত্সক ও নার্সের সংখ্যা ৮১১ জন এবং গর্ভবতী নারী ও প্রসূতির সংখ্যা ১৫৬ জন। কোনো কোনো নার্সকে গত বছর টানা ১২০ রাত ডিউটি করতে হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, চীনে কেন শিশুচিকিত্সকের সংখ্যা এত কম?

হু নান প্রদেশের থাও ইউয়ান জেলার শিশুচিকিত্সা বিভাগের প্রধান সু চু ইউং বললেন, ইন্টার্নি বিভাগের ডাক্তার বা শল্য চিকিত্সকদের চেয়ে শিশুচিকিত্সকদের আয় কম। সু চু ইউং ১২ বছর শিশুচিকিত্সক হিসেবে কাজ করেছেন। তার সহপাঠীদের মধ্যে মাত্র ২ জন এখনও শিশুচিকিত্সক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন, বাকিরা অন্যান্য বিভাগে কাজ করছেন।

শিশুচিকিত্সকদের কাজটিও তুলনামূলকভাবে কঠিন। হু নান শিশুহাসপাতালের নবজাতক বিভাগের প্রধান কাও সি রোং জানালেন, প্রতিদিন ৮ ঘন্টা কাজ করে তিনি ৩০টি শিশুকে চিকিত্সাসেবা দিয়ে থাকেন। তাকে প্রতিদিন রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়।

হুনান শিশুহাসপাতালের প্রধান ইউয়াও সু বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে শিশুচিকিত্সা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা অনেক কঠিন কাজ। তাই, সারা প্রদেশের শিশুরোগীরা হুনান শিশুহাসপাতালে আসে। প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে শতাধিক রোগী হয়। এসময় শিশুচিকিত্সরা দম নেওয়ার সময় পান না।

আসলে শুধু হুনান প্রদেশ নয়, গোটা চীনে প্রায় একই অবস্থা। চি লিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম হাসপাতালের শিশুচিকিত্সক লিউ ইউ ফেই বলেন, শিশুরা ছোট এবং তারা বড় মানুষের মতো রোগের উপসর্গগুলো বর্ণনা করতে সক্ষম নয়। তাই চিকিত্সকদের অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে চিকিত্সা দিতে হয়। তাই তাদের বেশি সময় লাগে। তা ছাড়া, পিতামাতা ও অভিভাবকরা প্রায়ই চিকিত্সকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। তারা চান তাদের সন্তান দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। শিশুচিকিত্সকদের কাজের ঝুঁকি বেশি, খাটনি বেশি, অথচ আয় কম।

গত জানুয়ারি মাসে, চীনের রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সি ছুয়ান প্রদেশের কয়েকজন সদস্য যৌথভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। তারা প্রস্তাব দেন, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুচিকিত্সা বিভাগ খোলা হোক। তা ছাড়া, তারা তাদের প্রস্তাবে শিশুচিকিত্সকের অভাব দূর করতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের প্রস্তাব আমলে নিয়ে ৩৮টি উচ্চ পর্যায়ের চিকিত্সা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুচিকিত্সা বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আরও বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়। অনুমান করা হচ্ছে, এতে ২০২০ সাল নাগাদ এসব বিভাগে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হবে ১০ হাজার। এ ছাড়া, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিটি প্রদেশে অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুচিকিত্সকবিষয়ক স্নাতক ডিগ্রি চালুর সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে, ২০২০ সালে দেশে শিশুচিকিত্সকের সংখ্যা হবে ১ লাখ ৪০ হাজার এবং তখন প্রতি এক হাজার শিশুর জন্য চিকিত্সকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ০.৬ জনে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের শিশুচিকিত্সকদের মর্যাদা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, তাদের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই কেবল শিক্ষার্থীদের মাঝে শিশুচিকিত্সক হবার আগ্রহ বাড়তে পারে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040