বিশেষ করে বাঙালির এ মহা উৎসবকে ঘিরে প্রতিবারের মতো এবারও বর্ণিল সাজে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা আয়োজন করতে প্রস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট। ফলে এখন সেখানে চলছে বর্ষবরণের কর্মযজ্ঞ। এখানে পুরোদমে প্রস্তুতি চলছে পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠান আয়োজনের। আঙিনাজুড়ে শিল্পকর্ম নির্মাণে ব্যস্ত চারুকলার বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির বর্ষবরণে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রতি বছর বর্ষবরণের সকালে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয় এই শোভাযাত্রায়।
প্রত্যেক বছর একটি শুভ কামনা নিয়ে বের করা হয় এই 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। প্রতিবছরের মতো এবারও চলমান সময়ের বিবেচনায় একটি বিশেষ ভাবনা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ বছরের শোভাযাত্রার ভাবনায় উঠে এসেছে মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং মা ও শিশুর সম্পর্ক। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে মায়ের হাতে সন্তানের মৃত্যু কিংবা সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অযত্ন অবহেলার প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত হয়েছে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল থীম। এছাড়া স্লোগানে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, "অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে..."। এবারের 'মা ও শিশুর সম্পর্ক' বিষয়কে সামনে রেখে বৈশাখী আয়োজনের মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও বেশ কিছু ভিন্নতা আনা হয়েছে। বিশেষ করে সমাজের নানা অবিচার ও অসঙ্গতি নানাভাবে তুলে ধরা হয়েছে। শিশু নির্যাতন, মা কর্তৃক শিশু হত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নানা বিষয় শোভাযাত্রার ভাবনায় আনা হচ্ছে। আলাদা ভাবনা নিয়ে বেশ কিছু আকৃতি বিশেষ করে মা ও শিশু, হাতি, ঘোড়া, মহিষ, হরিণ, ময়ূর পাখির নৌকা প্রভৃতির ফ্রেম তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া মুখোশ, পুতুলসহ সরাচিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পল্লীবধূর মুখচ্ছবি, সাপুড়ে, কাকতাড়ুয়া, হরেকরকম পাখি, হাতি, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, বিড়াল, বাঘ, রাখালসহ বৈচিত্র্যময় লোকজ নানা বিষয়। শোভাযাত্রার মূল ভাবনা মা ও শিশুর কাঠামো নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে।
চারুকলার শিক্ষার্থী ও এবারের বৈশাখ উদযাপন কমিটির ভাস্কর্য বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক মহিবুল ইসলাম আরিফ জানান, আমাদের দেশে 'মা ও শিশু'র সম্পর্কটি সব সময়ই মধুর এবং অনেক আবেগ আর ভালোবাসার। এই সম্পর্কটা সবসময় আমাদের সমাজে ইতিবাচক বিষয় হিসেবে বিবেচিত ছিল, এখনো আছে। কিন্তু কেন যেন এখন মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এই সম্পর্কটি ঠিক আগের মতো অটুট নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছি, মা ও সন্তানের সম্পর্কটা ফিকে হয়ে পড়ছে। বন্ধনটি কোথায় যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ক্রমাগত ঘটছে শিশু নির্যাতনের ঘটনা। পত্রিকার পাতায় এসব সংবাদ দেখে আঁতকে উঠে সবাই। ফলে এসব বিষয়কে সামনে রেখেই এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছে নানারকম ভাস্কর্য।
শোভাযাত্রায় থাকবে ১০ থেকে ১২টি শিল্প-কাঠামো বা ভাস্কর্য। বিশাল আকৃতির একটি কাঠামোয় দেখা যাবে, একজন 'মা' পরম যত্নে তার দুই হাত দিয়ে শূন্যে তুলে ধরে আছে ভালোবাসার অনন্যধন শিশুকে। ২৫ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্যটি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হবে বর্তমানের 'মা ও শিশু' নিয়ে নানান ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে।
চারুকলার ১৭-তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার দায়িত্বে রয়েছে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরাই প্রথম পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। সেই থেকে ধারাবাহিক ভাবে চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতি বছর শোভাযাত্রার আয়োজন করে আসছে।
এবার বৈশাখে চারুকলায় তিন দিন ধরে অনুষ্ঠান চলবে। আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তি, বৈশাখের দিন মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং পরের দিন যাত্রাপালা।
পয়লা বৈশাখ-কে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি দেখতে প্রতিদিন সাধারণ লোকজন সেখানে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। ফলে এখন থেকেই চারুকলায় শুরু হয়ে গেছে উৎসবের আমেজ।
এছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও বৈশাখের বেচা-কেনার ধূম পড়েছে। বিশেষ করে বৈশাখের লাল-সাদা জামা-কাপড় কিনতে মার্কেটগুলিতে ব্যাপক ভিড় শুরু হয়ে গেছে।
দিদারুল ইকবাল
চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই)
বাংলাদেশ।