চীনে দুই সন্তান লালনপালনে ব্যয় কত?
  2016-04-06 10:24:50  cri



অনেকটা আকস্মিকভাবেই ইয়াং ইউন টেলিভিশনে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার সুযোগ সম্পর্কে জানতে পারেন। সাধারণত তিনি বিজ্ঞাপন দেখেন না। কিন্তু সরকারের 'দুই সন্তান নীতি'সম্পর্কিত বিজ্ঞাপনটি মন দিয়েই দেখলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার ব্যাপারটি এখন আর ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি এখন জাতীয় বিষয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। চীনা সমাজে এটি এখন একটি হট ইস্যু।

আসলে ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ থেকেই শুরু হয় চীন সরকারের 'দুই সন্তান নীতি' নিয়ে আলোচনা। কিন্তু তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এ নীতি গ্রহণ করা হয়নি। এ সংক্রান্ত আইন চালু হবার পর এখন চীনের অনেক পরিবারে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

নীতিটি গ্রহণের আগে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় একটি গবেষণা চালিয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, চীনে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে চায় এবং ৯০ শতাংশ মানুষ 'দুই সন্তান নীতি' সমর্থন করে।

আবার উল্টো চিত্রও আছে। গত শতাব্দীর সত্তুরের দশকে জন্মগ্রহণকারী অনেকেই দ্বিতীয় সন্তান নিতে আগ্রহী নন। কারণ, তারা মনে করেন, এতে তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ অনেক বেড়ে যাবে।

৩৮ বছরের ইয়াং ইউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর বেইজিংয়ে কাজ শুরু করেন। তার জন্মস্থান বেইজিং নয়। কিন্তু তিনি এখানে বিয়ে করেন এবং বাড়ি-গাড়ি কেনেন। তার আছে ৭ বছর বয়সী একটি ছেলে। ছেলে প্রাথমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। ইয়াং ইউনের মেয়ে পছন্দ। তাই তিনি একটি কন্যাসন্তান চান। এ ব্যাপারে স্বামীর সঙ্গে আলোচনাও হয়। আলোচনাকালে স্বামী-স্ত্রী গত ৭ বছরে ছেলের পেছনে তাদের ব্যয়ের একটি হিসেব বের করেন। ব্যয়ের অংক দেখে তারা নিজেরাই অবাক হয়ে যান। গত ৭ বছরে ছেলে লালন-পালনে তারা ব্যয় করেছেন ৩ লাখ ৪০ হাজার ইউয়ান। এর মধ্যে প্রথম চার বছরে প্রতি মাসের খরচ ৫ হাজার ইউয়ান এবং বাকি তিন বছরে প্রতি মাসের খরচ ৩ হাজার ইউয়ান।

ইয়াং ইউন বলেন, একটু হিসেব করেই তারা বুঝতে পারলেন যে, দ্বিতীয় সন্তান লালনপালনে তারা সমর্থ নন। সন্তান জন্মের পরপরই অনেক টাকা লাগে। ম্যাটারনিটি ম্যাট্রনের পেছনে প্রতি মাসে খরচ ৫ হাজার ইউয়ান, যা কিনা বেইজিংয়ে ১০ হাজার ইউয়ান। আসলে প্রথম সন্তান জন্মের পর ম্যাটারনিটি ম্যাট্রন নিয়োগের পরিকল্পনা ছিল না ইয়াং ইউনের। তিনি ভেবেছিলেন, তার এবং স্বামীর মায়েরা ছেলের যত্ন নিতে পারবেন। কিন্তু সন্তান জন্মের সময় তার সিজার করতে হয়। ফলে, মাসিক ৫ হাজার ইউয়ানে একজন ম্যাটারনিটি ম্যাট্রন নিয়োগ না-দিয়ে তার কোনো উপায় ছিল না।

প্রসূতি ছুটি শেষে ইয়াং ইউন আবার কর্মস্থলে যোগ দেন। তখন গৃহকাজে সাহায্যের জন্য একজন আয়া নিয়োগ করেন তিনি। ছেলের গুঁড়া দুধের জন্য আরেকটি বড় খরচ হয়। ৪ বছর বয়স পর্যন্ত ইয়াং ইউন নিজের ছেলের জন্য নিউজিল্যান্ডের গুঁড়া দুধ ক্রয় করেছেন। ইয়াং ইউন বলেন, তার সহকর্মী ও বন্ধুরাও দামী বিদেশি দুধ সন্তানদের খাইয়ে থাকেন।

তবে সবচেয়ে বেশি খরচ শিক্ষার পেছনে। নিজের ছেলেকে একটি ভাল কিন্ডারগাটেনে ভর্তি করানোর জন্য ইয়াং ইউন বেইজিংয়ের পঞ্চম রিং রোডের পার্শ্বে অবস্থিত তার বড় বাড়িটি বিক্রি করে দেন এবং তৃতীয় রিং রোডের কাছে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট বাড়ি ক্রয় করেন। ছোট বাড়িতে নিজের মা বা শাশুড়ির থাকার উপায় নেই। ফলে ইয়াং ইউন ও তার স্বামীকেই ছেলের যত্ন নিতে হয়। তা ছাড়া, সরকারি কিন্ডারগার্টেনের নীতি অনুযায়ী, প্রতি বছরের ৩১ অগাস্টের আগে শিশুর বয়স ৩ বছর না-হলে ভর্তি করানো যায় না। ইয়াং ইউনের ছেলের জন্মদিন অক্টোবর মাসে। তাই তিনি বাধ্য হয়ে একটি বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন বাছাই করেন। সাধারণত বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের খরচ আরও বেশি। প্রতি মাসে কিন্ডারগার্টেনের খরচ ৩৫০০ ইউয়ান। আর ছেলের জন্য অন্য প্রশিক্ষণ ক্লাসের খরচও অনেক বেশি।

আসলে চীনে, বিশেষ করে রাজধানী বেইজিংয়ে সন্তান লালন-পালন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ইয়াং ইউন বলেন, সন্তান ১৮ বছর বয়সী হওয়া পর্যন্ত তার পেছনে লক্ষ লক্ষ ইউয়ান খরচ হয়ে যায়। আর যদি সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়, তবে খরচ আরও অনেক বেশি।

অনেকেই জানেন, ১৯৮২ সাল থেকে চীনে 'এক সন্তান নীতি' চালু হয়। এর ফলে চীনের ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিগত ৩০ বছরে চীনা সমাজে দেখা দেয় অন্য এক সমস্যা। সমস্যাটি হচ্ছে, চীনে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা দিন দিন কমছে এবং বাড়ছে প্রবীণের সংখ্যা। এ পটভূমিতেই চীন সরকার 'দুই সন্তান নীতি' গ্রহণ করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিগত ৩০ বছরে মানুষের চিন্তা-ভাবনাও অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। ইয়াং ইউন বলেন, তার আশেপাশের মানুষদের বেশিরভাগই এক সন্তান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চান। তারা তাদের সকল অর্থ, সময় ও উদ্যম ব্যয় করতে চান একটি সন্তানের পেছনে। তাদের ধারণা, একটি সন্তানকে ভালোভাবে গড়ে তোলাই বুদ্ধিমানের কাজ। তারা মনে করেন, একটি সন্তানকে যতটা যত্ন নিয়ে লালন-পালন করা যাবে, দুটি সন্তানকে তা করা যাবে না। তা ছাড়া, বিগত ৩০ বছরে একটি সন্তান নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতেই তারা শিখেছেন। এ শিক্ষাও তাদের চিন্তা-ভাবনার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।

২০১৫ সালে চীনা সরকার একটি মধ্যবর্তী নিয়ম চালু করেছিল। এ নীতি অনুসারে, যদি কোনো দম্পতির অন্তত একজন তার পিতামাতার একমাত্র সন্তান হয়, তবে ওই দম্পতি দুটি সন্তান নিতে পারবে। তবে এ নীতি গ্রহণের এক বছর পর দেখা গেল মাত্র ৭ লাখ যোগ্যতাসম্পন্ন দম্পতি দ্বিতীয় সন্তান নিয়েছে। এখন সার্বিকভাবে 'দুই সন্তান নীতি' কতোটা কার্যকর হবে, তা দেখার বিষয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২০ সালে চীনে প্রবীণের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বাড়বে এবং কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। এটা চীনা অর্থনীতির জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় 'দুই সন্তান নীতি' সফল হওয়া জরুরি।

আসলে শুধু চীনে নয়, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একদিকে প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে, এবং অন্যদিকে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমছে। কোনো কোনো দেশ এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী গ্রহণ করছে, তাদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করছে। ভবিষ্যতে চীন এমন নীতি গ্রহণ করবে কি না, আমরা এখনও জানি না। তবে, দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণের ব্যাপারে বহু চীনা মানুষের অনাগ্রহ, চীন সরকারকে বিদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানিতে উত্সাহিত করতে পারে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040