চীনের বিদ্যুতচালিত গাড়ি তথা নতুন জ্বালানিচালিত গাড়িশিল্প
  2016-04-09 19:21:12  cri

আপনারা অনেকেই জানেন, গত বছরের ডিসেম্বরে বেইজিংয়ে দুই বার বায়ুদূষণসংক্রান্ত লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। এসময় সরকার প্রতিরোধমূলক যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল সেগুলো মধ্যে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা সীমিত রাখা ছিল একটি। তখন কিছুদিন বেইজিংয়ের রাস্তায় একদিন জোড় সংখ্যার গাড়ি ও একদিন বিজোড় সংখ্যার গাড়ি চলতে পারতো। তবে বিদ্যুতচালিত সব গাড়িই সেসময় রাস্তায় চলতে পেরেছে। কারণ, বিদ্যুতচালিত গাড়ি পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী নয়।

বস্তুত চীনে বিদ্যুতচালিত গাড়ির জনপ্রিয়তা এমনিতেই বাড়ছে। এখন পরিবেশ দূষণ মোকাবিলায় সরকার তেলচালিত গাড়ির চলাচল সরকার মাঝেমধ্যেই সীমিত করে বিধায়, বিদ্যুতচালিত গাড়ির জনপ্রিয়তা আরও বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর চীনে বিদ্যুতচালিত গাড়ি উত্পাদিত হবে দুই থেকে আড়াই লাখ, যা বিশ্বের মোট বিদ্যুতচালিত গাড়ির ৪০ শতাংশ। তাই বছরশেষে চীন বিশ্বের বৃহত্তম নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ির বাজারে পরিণত হবে।

বেইজিং শহরের হাইদিয়ান এলাকার মিস্টার ইয়াং হলেন শহরের বিদ্যুতচালিত গাড়ির মালিকদের একজন। তিনি বলেন, 'আমি গত নভেম্বরে গাড়ীটি কিনেছি। এক মাস ব্যবহার করার পর আমার মনে হচ্ছে, এটি খারাপ না। বেইজিংয়ের মধ্যে যে-কোনো স্থানে আমি এ গাড়ি দিয়ে যেতে পারি।'

আসলে মিস্টার ইয়াংয়ের তেলচালিত গাড়ি আগে থেকেই ছিল। কিন্তু তিনি আরেকটি বিদ্যুতচালিত গাড়ি কিনেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'নতুন জিনিস সম্পর্কে আমার আগ্রহ আছে। তা ছাড়া, বিদ্যুতচালিত গাড়ি সবসময় রাস্তায় নামানো যায়। বায়ুদূষণের সময়ও এক্ষেত্রে কোনো বাধা-নিষেধ থাকে না। নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি কেনার এটাও একটা কারণ।'

নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তেমন কড়া নয়। অথচ বেইজিংয়ে যখন ইচ্ছা তেলচালিত গাড়ি কেনা যায় না। পরিবেশের কথা চিন্তা করেই সরকার এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আর তাই বিদ্যুতচালিত তথা নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকছেন বেইজিংবাসী। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, বেইজিংয়ে নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি কেনার জন্য চলতি বছরের শুরুর দিকে আবেদন পড়েছে অনেক বেশি, যা ২০১৫ সালের প্রথম দিকে আবেদনের তিন গুণেরও বেশি।

মিস্টার ইয়াং জানালেন, নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ির খরচও কম। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আসলে নতুন জ্বালানিচালিত তথা বিদ্যুতচালিত গাড়ির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এর খরচ কম। আমি অনেকদিন ধরে গাড়ি চালাই। বলতে পারেন, আমি একজন দক্ষ চালক। আমার তেলচালিত গাড়ি প্রতি একশ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে প্রায় ৬ লিটার তেল পোড়ায়। এর জন্য ৪২ আরএমবি ব্যয় হয়। তার মানে প্রতি কিলোমিটারের জন্য এ গাড়িতে ০.৪ বা ০.৫ আরএমবি'র তেল লাগে। অন্যদিকে বিদ্যুতচালিত গাড়ি একবার চার্জ করলে ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে। এক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে খরচ মাত্র ০.১ আরএমবি।'

বিএআইসি মোটর কর্পোরেশন লিমিটেড-এর উপ-মহাব্যবস্থাপক চাং ইং বললেন, 'কেউ নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি কিনলে তাতে ভর্তুকি পেয়ে থাকেন। যেমন আমাদের নতুন গাড়ী ইইউ২৬০-এর দাম হল প্রায় আড়াই লাখ আরএমবি, কিন্তু ভর্তুকির কারণে একজন ক্রেতা মাত্র এক লাখ ৪০ হাজার আরএমবি দিয়ে কিনতে পারেন। তার মানে এ ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে এক লাখ ১০ হাজার আরএমবি। এ ছাড়া, নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ির জন্য কোনো কর দিতে হয় না।'

কম দাম ও পরিচালনা ব্যয় কম হওয়ায় বিদ্যুতচালিত গাড়ির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। তবে, এ ধরনের গাড়ির কিছু সমস্যাও রয়েছে। প্রথমত এ ধরনের গাড়ি নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া যায় না এবং যে-কোনো স্থানে এ ধরনের গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করা যায় না। মিস্টার ইয়াং এ সম্পর্কে বলেন, 'আমার এক সহকর্মীর সন্তান একবার অসুস্থ হয়ে গেল। তাকে নিয়ে বিদ্যুতচালিত গাড়িতে হাসপাতালে যাওয়ার পথে ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যায়। তিনি পরে বাড়িতে ফিরে তেলচালিত গাড়ি চালানো শুরু করেন।'

মিস্টার ইয়াং আরও জানালেন, বিদ্যুতচালিত গাড়ির বিক্রেতা কোম্পানি তার বাড়িতে চার্জিং ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু বাইরে চার্জ করতে গেলেই সমস্যায় পড়তে হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এখনও বাইরে গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করতে কমবেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কারণ, চার্জিং-স্টেশানের সংখ্যা খুবই কম।'

অবশ্য ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনায় নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি ও সংশ্লিষ্ট চার্জিং ব্যবস্থা উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনার আওতায় একটি উত্সাহ ভাতার ঘোষণাও প্রকাশিত হয়। এর পরই ঘোষিত হয় বেইজিংয়ে বিদ্যুতচালিত গাড়ির চার্জিং ব্যবস্থায় বিনিয়োগ পরিকল্পনা। বিএআইসি মোটর কর্পোরেশন লিমিটেড-এর উপ-মহাব্যবস্থাপক চাং ইং একে তার কোম্পানির জন্য সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, 'চলতি বছর আমরা আরও বেশকিছু চার্জিং-স্ট্যাশান গড়ে তুলবো। আমাদের লক্ষ্য ৭ হাজার চার্জিং-স্ট্যাশান প্রতিষ্ঠা করা। বেইজিং সরকার এক্ষেত্রে কিছু সুবিধা দেবে। যেমন, গত ২৩ ডিসেম্বরে বেইজিং সরকার কয়েকটি ব্যবস্থা নেয়। অদূর ভবিষ্যতে বেইজিং, শাংহাই ও কুয়াংচৌ-এর মতো বড় শহরগুলোতে নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ির চার্জিংয়ের কোনো সমস্যা থাকবে না। আমি বিশ্বাস করি, আগামী দুই বছরেই এক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হবে।'

বস্তুত এসব ব্যবস্থা শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে উত্সাহ দেওয়ার পাশাপাশি নাগরিকদের জন্যও কল্যাণকর প্রমাণিত হবে। বর্তমানে বেইজিংয়ে প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা, হাসপাতাল, পার্ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে একে একে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বিদ্যুতচালিত গাড়ির চার্জিং-স্ট্যাশান।

তবে মিস্টার ইয়াং মনে করে শুধু চার্জিং-স্ট্যাশান স্থাপন করলেই হবে না, ব্যাটারির মানও উন্নত করতে হবে। তিনি বলেন, 'চার্জিং-স্ট্যাশান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটারির মান উন্নত করার ব্যাপারটি। আমরা জানি, যত দিন যায় ব্যাটারির লাইফ কমে আসে। তখন বিদ্যুতচালিত গাড়িগুলো সংকটে পড়ে। যেমন আমার গাড়ি প্রথম দিকে একবার চার্জ দিলে ২শ কিলোমিটার যেতো। কিন্তু পাঁচ বছর পর হয়তো তা মাত্র ২০ কিলোমিটার হবে।'

বিএআইসি মোটর কর্পোরেশন লিমিটেড-এর উপ-মহাব্যবস্থাপক চাং ইং এ সম্পর্কে বলেন, 'আমরা গাড়ির মান উন্নত করার চেষ্টা করছি। গত বছরের শেষ দিকে আমরা এমন গাড়ি উত্পাদন করেছি যা একবার চার্জ দিলে ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত যাবে। আর ২০১৬ সালে আমরা একবার চার্জে ৩০০ কিলোমিটার চলতে পারবে এমন গাড়ি উত্পাদনের চেষ্টা করবো। তবে আমাদের মূল লক্ষ্যে এমন গাড়ি উত্পাদন করা যা একবার চার্জ দিলে ৪০০ কিলোমিটার যাবে। আমরা উচ্চমানের অথচ স্বল্পদামের গাড়ি উত্পাদনের চেষ্টা করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'ত্রয়োদেশ পাঁচসাল পরিকল্পনা চীনা গাড়িশিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ বয়ে এনেছে। তেলচালিত গাড়ির আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা অন্যান্য দেশের ব্রান্ডের তুলনায় পিছিয়ে আছি। কিন্তু বিদ্যুতচালিত গাড়ির বাজারে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী এবং এক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানে ওঠার ব্যাপারে আমরা আত্মবিশ্বাসী। চীন সরকারও নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ির উন্নয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। তা ছাড়া, জ্বালানি সাশ্রয় ও পরিবেশ দূষণ কমাতে চীনে বিদ্যুতচালিত গাড়িশিল্পের উন্নয়ন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এখন নতুন জ্বালানিচালিত গাড়ি হচ্ছে বিএআইসি মোটর কর্পোরেশন লিমিটেড-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।'

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040