এক্সপ্রেস ডেলিভারি ব্যবসায়ী সু লু
  2016-03-23 13:23:05  cri



সু লু নামের চীনা মেয়েটি সি ছুয়ান প্রদেশের সি ফাং শহরে এক্সপ্রেস ডেলিভারি সেবা দিয়ে থাকেন। এখানকার অনেকেই তাকে চেনেন। না, এক্সপ্রেস ডেলিভারি সেবার জন্য নয়। তাকে অনেকেই চেনেন খুবই ভালো ছাত্রী হিসেবে। তিনি হাই স্কোর নিয়ে চীনের সবেচেয়ে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। সেখানে সাফল্যের সাথে লেখাপড়াও শেষ করেছিলেন। চাকরিও জুটেছিল। কিন্তু বেইজিংয়ের আরামের জীবন ছেড়ে তিনি একসময় জন্মস্থানেই ফিরে যান এবং একটি ছোট্ট এক্সপ্রেস ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করেন। তিনি শুরুর দিকে নিজের বাইসাইকেলে চড়ে বিভিন্ন পণ্য ডেলিভারির কাজ করতেন।

স্বজনদের কাছে তিনি ছিলেন সম্ভাবনাময়। তারা ভেবেছিলেন, সু লু একসময় অনেক বড় হবে, বিখ্যাত হবে, দেশ-বিদেশের মানুষ তাকে চিনবে। সু লু এখন ট্রাক চালাতে পারেন, ৫০ কেজির বস্তা বহন করতে পারেন! শুরুতে তার এই এক্সপ্রেস ডেলিভারির ব্যবসার ঘোর বিরোধী ছিলেন তার বাবা। তবে সু লু দমার পাত্রী ছিলেন না। তার মতে, শিক্ষাগত যোগ্যতা তিনি বেইজিংয়েই ফেলে এসেছেন। এখন তিনি শুধুই একজন সাধারণ ব্যবসায়ী।

২০১৬ সালের শুরুতে সু লু'র এক্সপ্রেস ডেলিভারি ব্যবসা আরও জমে ওঠে। সি ফাং শহরে ইউয়ান থুং এক্সপ্রেস ডেলিভারি কোম্পানির সদর দপ্তরে সু লু ও তার সহকর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন অবিরাম। কখনও খানিকটা বিশ্রাম পেলে, সু লু সহকর্মীদের সঙ্গে রসিকতা করেন। ৩৪ বছর বয়সি সু লু এ কোম্পানির মালিক। কিন্তু সময় পেলে তিনি সাধারণ কর্মীর মতো তাদের সঙ্গে কাজ করেন। তার কর্মীদের মতে স্যু লু একজন পুরুষের মতো সব কাজ করতে পারেন--গাড়ি চালানো, ডেলিভারি ইত্যাদি সব।

অন্য ডেলিভারি কোম্পানিগুলোর চেয়ে ভিন্ন সু লু'র কোম্পানি খানিকটা ভিন্ন। কোম্পানির কর্মীরা প্রায়ই ব্যস্ততার কারণে খাওয়ার সুযোগ পান না দেখে অফিসেই একটি রান্নাঘর বানিয়ে দিলেন সু লু। এই রান্নাঘরে এখন নিয়মিত তৈরি হয় দুপুরের খাবার। এ খাবার সকল কর্মী বিনামূল্যে খেয়ে থাকেন। লিয়াং সিয়াও লং কোম্পানির একজন কর্মী। তিনি জানালেন, কোম্পানির সবাই সু লু'কে রসিক বলেই জানে এবং তার সঙ্গে কাজ করে আনন্দ পায়।

সু লু জানালেন, গত দু'বছর ধরে তিনি প্রতিদিন সবার আগে অফিসে আসছেন এবং রাত ৯টার পর বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। অনেকেই জানেন, গত ১১ নভেম্বর ছিল চীনে অনলাইন কেনাকাটা দিবস। সেদিন ডেলিভারি কোম্পানিগুলো বছরের ব্যস্ততম দিনটি কাটায়। তখন কয়েকটি দিন সু লু'কে প্রতিদিন প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। তিনি জানালেন, শরীর ক্লান্ত হতো, কিন্তু মন থাকতো প্রফুল্ল।

সু লু'র স্বামী ইয়ান ফেই একজন সৈনিক এবং তিনি ইউয়ুন নান প্রদেশে কাজ করেন। সাধারণত দু'জন ভিডিওফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সু লু বললেন, এ বছরের ১১ নভেম্বর স্বামী তাকে দেখার জন্য ইউয়ান নান থেকে ফিরে আসেন সি ফাংয়ে। কিন্তু সু লু'র হাতে স্বামীর জন্যে সময় নেই! উল্টো স্বামীই তাকে ডেলিভারির কাজে সাহায্য করতে থাকেন।

২০০০ সালে সু লু বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি সাংবাদিকতা শিখেছেন; শিখেছেন সংবাদ রচনা এবং সংবাদ বাছাই করার কৌশল। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর চীনা কেন্দ্রীয় টেলিভিশনে শিক্ষানবিশ কর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগও পান তিনি। তবে তিনি সে সুযোগ ত্যাগ করেন। কারণ, তিনি মনে করেন, সাংবাদিকতা তার উপযুক্ত কাজ নয়। পরে সু লু পর্যায়ক্রমে একটি বিখ্যাত একটি প্রযুক্তি কোম্পানি এবং একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে কাজ করেন। শেষ দিকে তিনি মাসে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ইউয়ান করে আয় করছিলেন। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে তিনি শেষপর্যন্ত জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলেন। বেইজিংয়ে ১০ বছরের তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক জীবন তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন মনের জোরে।

সু লু বলেন, তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় তিনি বেইজিংয়ে কাটিয়েছেন। ২০১০ সালে যখন এ শহর থেকে বিদায় নেন, তখন তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এমনকি ফিরে যাওয়ার সময় তিনি বিমানে কাঁদছিলেনও।

কিন্তু কেন সি ফাংয়ে ফিরে আসা? এ প্রসঙ্গে সু লু বলেন, ২০১০ সালে তিনি বিয়ে করেন হাই স্কুলের সহপাঠীকে। স্বামীর পোস্টিং অন্য শহরে। এ অবস্থায় সি ফাংয়ে না-ফিরে তার কোনো উপায় ছিল না। দু'জনের বয়স্ক পিতা-মাতাকে দেখার কেউ ছিল না। সু লু দুটি পরিবারের মঙ্গলের কথা ভেবেই জন্মস্থানে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

সি ফাংয়ে ফিরে আসার পর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার চিন্তা করেছিলেন সু লু। তবে ভাল সুযোগ পাননি। তা ছাড়া, প্রতিদিন ঘড়ি ধরে কাজ করা তার ধাতে সয় না। একসময় চিন্তা করলেন, নিজেই ব্যবসা করবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ।

২০১৩ সালে আকস্মিক এক সুযোগে সু লু জানতে পারেন, যে সি ফাংয়ে একটি ডেলিভারি কোম্পানির শাখার মালিকানা বদল হবে। তিনি ভাবলেন, অনলাইন কেনাকাটা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ফলে এক্সেপ্রস ডেলিভারি একটি ক্রমবর্ধমান শিল্পে পরিণত হবে। তিনি ওই ডেলিভারি কোম্পানির শাখা কেনার সিদ্ধান্ত নিলেন।

পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পর সু লু শেষ পর্যন্ত কোম্পানিটি কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তবে ফোনে দায়িত্বশীল ব্যক্তি সু লু'র কণ্ঠ শুনে আগ্রহ দেখাননি। তিনি ভাবলেন সু লু একটি ছোট মেয়ে, এই ব্যবসা তার কাজ নয়। কিন্তু সু লু হাল ছেড়ে দেননি। তিনি সিছুয়ান প্রদেশের রাজধানী ছেং তুতে যান এবং ওখানে তিনি খুজেঁ বের করেন এ কোম্পানির সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল ব্যাক্তি মিঃ কু'কে। মিঃ কু সু লুকে তার ধারণা ও পরিকল্পনা ব্যাখ্যার জন্য ৩০ মিনিট সময় দিলেন। সু লুর বক্তব্য মিঃ কু'র ভালো লাগলো। তিনি সু লু'র কাছে তার কোম্পানির শাখার মালিকানা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলেন। সি ফাংয়ে ফিরে যাওয়ার পর সু লু আগের মালিকের হাত থেকে এ কোম্পানির সি ফাং শাখার মালিকানা বুঝে নেন।

নিজের বাসা বন্ধক রেখে ৩ লাখ ৮০ হাজার ইউয়ান হাতে পান সু লু। পরে তিনি আরও ১ লাখ ২০ হাজার ইউয়ান বিনিয়োগ করেন। যখন সু লু ব্যবসা শুরু করেন তখন তার কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১০ জন। শুরুর দিকে কর্মীরা সু লু'কে বিশেষ একটা পাত্তা দিত না, তার কথাও মাঝেমাঝে শুনতো না। এ অবস্থা দেখে সু লু অনেক কষ্ট পেলেন। তিনি ভাবলেন, কোম্পানি ঠিকমতো রান করাতে হলে, তাকে কঠোর নিয়মকানুন চালু করতে হবে।

পাশাপাশি তিনি একজন সাধারণ কর্মচারীর মতো কাজ করা শুরু করেন এবং একজন একজন করে নতুন কর্মচারী নিয়োগ দিতে থাকেন। সময়মতো পণ্যের ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে, সু লু নিজে ফোন করে ক্লায়েন্টদের কাছে কৈফিয়ত দিতেন। তার এক বন্ধুও নিজের কাজ শেষে সু লু'কে সাহায্য করা শুরু করে।

শুরুর দিকে সু লু'র কোম্পানির ১০ জন কর্মী প্রতিদিন প্রায় ১০০টি প্যাকেজ গ্রহণ করতো এবং ৬ থেকে ৭ শত প্যাকেজ ডেলিভারি দিতে পারতো। বর্তমানে তার কোম্পানিতে কর্মী সংখ্যা ২০। তারা প্রতিদিন ৩০০টির বেশি প্যাকেজ গ্রহণ করে এবং তিন হাজারের বেশি প্যাকেজ ডেলিভারি দিয়ে থাকে।

চলতি মার্চ মাসে সু লু তে ইয়াং শহরের Woman Pace-Setter পুরস্কার পান। বেইজিং ছেড়ে সি ফাংয়ে ফেরার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে স্যু লু বলেন, তিনি এজন্য পরিতাপ করেন না। কারণ, বেইজিংয়ে তার জীবন আরামদায়ক হলেও, তিনি সেখানে ছিলেন একা। সি ফাংয়ে ফিরে তিনি পরিবার পেয়েছেন, যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040