ইন্টোরনেট চিকিত্সাব্যবস্থা
  2016-03-16 13:50:22  cri



চলতি বছরের বসন্ত উত্সব চলাকালে, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে-পড়া একটি ভিডিও ফুটেজ ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ভিডিওটিতে বেইজিংয়ের হাসপাতালগুলোতে সক্রিয় দালালচক্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখা যায় একজন চীনা তরুণীকে। এই তরুণী বেইজিং কুয়াং আন মেন হাসপাতালের বাইরে পরপর দু'দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও নিবন্ধন করাতে পারেননি। দালালরা তাকে নিবন্ধনের জন্য সাড়ে চার হাজার ইউয়ানের প্রস্তাব দেয়। তার মানে, দালালদের সাড়ে চার হাজার ইউয়ান দিলে, তারা তাকে নিবন্ধন করিয়ে দেবে। হাসপাতালের একটি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক দেখানোর জন্য নিবন্ধন করাতেই সাড়ে চার হাজার ইউয়ান! বিষয়টি সত্যিই অবাক করার মতো। আর তাই তরুণী ভিডিও ক্লিপটি ইন্টারনেটে দেওয়ার পর একদিনেই এক কোটি ৪০ লাখ ব্যবহারকারী এটি দেখে ফেলে।

আসলে বেইজিংয়ে এ তরুণীর অভিজ্ঞতা কোনো ব্যতিক্রম নয়। সাধারণভাবেই বেইজিংয়ের হাসপাতালগুলোতে নিবন্ধনের জন্য লাইনে এক ঘন্টা, নির্দিষ্ট চিকিত্সক দেখাতে আরও প্রায় এক ঘন্টা, চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র পাবার পর ওষুধের দাম পরিশোধ করতে আরও এক ঘন্টা, এবং সবশেষে ওষুধ গ্রহণের জন্য আরও প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। এই হিসেবে কমবেশি হতে পারে। তবে, হাসপাতালে যে সাধারণ মানুষকে ঘন্টার পর ঘন্টা বিভিন্ন লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়, তা হচ্ছে একটি বাস্তবতা।

আগে চীনের মানুষকে ব্যাংকগুলোতেও লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এখনও হয়, তবে সে লাইন এখন অনেক ছোট হয়েছে। কারণ, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের সুযোগ গ্রহণ করছেন অনেকেই। ব্যাংকিং খাতে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি, চিকিত্সাসেবা খাতেও ইন্টারনেটের সুবিধাবিষয়ক দু'টি ধারণার কথা শোনা যায় ২০১৪ সালে। 'ভবিষ্যত হাসপাতাল' ও 'ওয়াইজ মেডিকেল' ধারণা দুটো নিয়ে সাধারণ মানুষের সামনে তখন হাজির হয় চীনের দু'টি বিখ্যাত কোম্পানি 'আলিবাবা' ও 'টেনসেন্ট'।

আলিবাবা'র 'চেংচিয়াং অ্যান্ট স্মল অ্যান্ড মাইক্রো ফাইন্যানসিয়াল গ্রুপ', যেটি সংক্ষেপে 'এএনটি ফাইন্যানসিয়াল' নামে পরিচিত, একটি অনলাইন পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার। এ গ্রুপের চিকিত্সা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ওয়াং পো বলেন, "বর্তমানে চীনে মাথাপিছু চিকিত্সাসম্পদ খুব কম। এক্ষেত্রে চীন উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। সাধারণ মানুষ চিকিত্সাসেবা নিতে গিয়ে অনেক ঝামেলার শিকার হচ্ছেন এবং কখনও কখনও সুচিকিত্সা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে লম্বা লাইনে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কখনও কখনও রোগীদের সঙ্গে চিকিত্সকদের সম্পর্কও খারাপ হচ্ছে। এ সব সমস্যা সমাধানের জন্য একদিকে চিকিত্সাসম্পদ বাড়ানো উচিত এবং অন্যদিকে বিদ্যমান সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।"

এএনটি ফাইন্যানসিয়াল-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ চীনের ৯০ শতাংশ প্রদেশের মোট ৪০০টি হাসপাতাল 'ভবিষ্যত হাসপাতাল'প্রকল্পে যোগ দিয়েছে এবং ৫ কোটিরও বেশি মানুষকে সেবা দিয়েছে। 'ভবিষ্যত হাসপাতাল' প্রকল্পের মাধ্যমে চিকিত্সাগ্রহণ প্রক্রিয়ার সময় ৫০ শতাংশ কমে যায়।

ওয়াং পো আরও বলেন, "ভবিষ্যতে হাসপাতালগুলো শুধু রোগ নির্ণয়ের কাজ করবে। রোগী 'চি ফু পাও' (আলিবাবা'র মোবাইল ব্যাংক অ্যাপ)-এর মাধ্যমে হাসপাতালে প্রয়োজনীয় নিবন্ধন এবং এর জন্য টাকা জমা দিতে পারবেন। কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি থাকলে, এই অ্যাপের মাধ্যমে খাবারও অর্ডার দিতে পারবেন।"

২০১৪ সালে উইচ্যাট চালু করে 'ওয়াইজ মেডিকেল' সেবা। জানা গেছে, বর্তমানে সারা চীনে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার উইচ্যাট ব্যবহারকারী এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে চিকিত্সাসেবা নিচ্ছে। এই অ্যাপ ব্যবহার করে রোগীরা হাসপাতালে নিবন্ধন ও টেস্টের ফলাফল নেওয়াসহ বিভিন্ন সেবা ভোগ করতে পারেন।

হু সিয়ান সুন হু পেই প্রদেশের একজন সাধারণ নাগরিক। তিনি 'ভবিষ্যত হাসপাতাল' প্রকল্পের আওতায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে তার গ্রামের থাও পাও সেবাকেন্দ্রে যান এবং সেখান থেকে উ হান কেন্দ্রীয় হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে হু সিয়ান সু নিজের শারীরিক পরীক্ষার ফলাফল এবং অন্যান্য তথ্য উ হান কেন্দ্রীয় হাসপাতালের চিকিত্সককে জানান। চিকিত্সক তাকে কিছু প্রশ্ন করেন। পরে তিনি একটি ব্যবস্থাপত্র দেন। এর পর এ ব্যবস্থাপত্রে নির্দেশিত সকল ওষুধ হু সিয়ান সুনের বাড়িতে পাঠানো হয়।

রাজধানীতে না-গিয়ে এবং গ্রামে নিজের বাড়িতে বসে হু সিয়ান সুন শহরের বড় ও উন্নত হাসপাতালের চিকিত্সা গ্রহণ করছেন দেখে গ্রামবাসী অবাক এবং খুশি। হু সিয়ান সুনের গ্রামে চালু 'ভবিষ্যত হাসপাতালের' প্রকল্পটি একটি পাইলট প্রকল্প। এখানকার মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় ১০ হাজার ইউয়ানের বেশি। অথচ এখানে চিকিত্সক আছেন মাত্র ৪ জন। এই চিকিত্সকরা চারটি গ্রামের ৬ হাজার গ্রামবাসীর চিকিত্সাসেবা দিতে এতোদিন হিমশিম খাচ্ছিলেন। আর এখানকার চিকিত্সাকেন্দ্রে Sphygmomanometer এবং থার্মোমিটার ছাড়া কোনো মেডিকেল সরঞ্জাম নেই এবং ওষুধও আছে মাত্র ৬০ ধরনের।

২০১৫ সালের জুন মাসে আলিবাবা ও উ হান কেন্দ্রীয় হাসপাতালের মধ্যে ইন্টারনেটে চিকিত্সাসেবা দেওয়াসংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে অগাস্ট মাস থেকে এ চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। পরের তিন মাসে সিস্টেম যুক্ত করা, চিকিত্সক ও বিভাগ বাছাইয়ের কাজ চলে। আর ২০১৫ সালের নভেম্বরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে চিকিত্সাসেবা দেওয়ার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

এই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল ব্যাক্তি বললেন, এ প্রকল্পের আওতায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ চিকিত্সাবেসা পাচ্ছে। এর অর্থ গ্রামে চিকিত্সাসম্পদের অভাব পূরণ হয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। 'ইন্টারনেটে চিকিত্সা' নতুন কোনো ধারণা নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, শহরাঞ্চলে এ ধারণার তেমন একটা বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না। আশা করা হচ্ছে, গ্রামে এর চাহিদা বাস্তবতার কারণেই বেশি হবে।

আসলে, অনেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে চিকিত্সাসেবা নিতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন না বাস্তব কারণে। চীনে এখনও ইন্টারনেটে চিকিত্সাসেবা বীমার আওতায় আসেনি। কেউ ইন্টারনেটে চিকিত্সাসেবা নিলে বীমা কোম্পানি তার ব্যয় বহন করে না বা এখনও সে ব্যবস্থা চালু হয়নি।

নাম-প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিত্সক সিআরআইকে জানিয়েছেন, চিকিত্সা বীমা খাত এ ব্যাপারে এখনও পিছিয়ে আছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য হাসপাতালগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন।

তবে, খুশির খবর হচ্ছে, বিরূপ বাস্তবতা সত্ত্বেও, ইন্টারনেটে চিকিত্সাসেবা প্রকল্প ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছে। গত ৭ ডিসেম্বর 'মাইক্রো মেডিকেল গ্রুপ'-এর উদ্যোগে চীনের প্রথম ইন্টারনেট হাসপাতাল 'উ চেন ইন্টারনেট হাসপাতাল' প্রতিষ্ঠিত হয়। এ হাসপাতাল চে চিয়াং প্রদেশ ও ও চেন জেলার যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। জানা গেছে, ভবিষ্যতে এ হাসপাতাল প্রতিবছর ১ কোটিরও বেশি মানুষকে চিকিত্সাসেবা দিতে পারবে। তা ছাড়া, মাইক্রো মেডিকেল গ্রুপের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ১৬০০টির বেশি হাসপাতাল ও ২ লাখ চিকিত্সক বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জনগণকে চিকিত্সাসেবা দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে।

চীনের রোগীদের অনেকেই হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত। তাদেরকে দীর্ঘকাল ধরে, এমনকি সারাজীবন ধরে ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। তারা কী ওষুধ লাগবে তা জানেন। অথচ ওষুধ শেষ হয়ে গেলে, তাদের প্রতিবার হাসপাতলে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। ইন্টারনেট হাসপাতাল এ ধরনের রোগীর দুর্ভোগ কমাতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনে গোটা দেশব্যাপী একটি সার্বিক ইন্টোরনেট চিকিত্সাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আরও ৮ থেকে ১০ বছর লাগবে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040